ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গ্রাম বাংলায় শীতকালীন উৎসবের অনুষঙ্গ

লোকজ ঐতিহ্য, চিরায়ত বাংলার সংস্কৃতিতে পিঠা-পায়েস

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ২২ জানুয়ারি ২০১৯

লোকজ ঐতিহ্য, চিরায়ত বাংলার সংস্কৃতিতে পিঠা-পায়েস

শেখ আব্দুল আওয়াল ॥ শীতের পিঠাপুলি বাঙালীর আদি খাদ্য সংস্কৃতির অংশ। বাংলার চিরায়ত লোকজ খাদ্য সংস্কৃতিতে পিঠা-পায়েস বিশেষ স্থান দখল করে আছে। প্রতিবছর শীতকালে দেশজুড়ে পিঠা তৈরির ব্যস্ততা চোখে পড়ে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বাড়ি বাড়ি ধুম পড়ে যায় পিঠা বানানোর। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর বা সন্ধ্যায় গাঁয়ের বধূরা চুলার পাশে বসে পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটান। অতিথি বিশেষ করে মেয়ে জামাইদের দাওয়াত করে পিঠা খাওয়ান গৃহস্থরা। দেশের অন্যান্য জেলার মতো ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠার প্রচলন রয়েছে। কালের বিবর্তনে কিছু পিঠা হারিয়ে গেলেও, কিছু আবার নতুন আঙ্গিকে তৈরির পর ফিরে আসছে, পরিবেশিতও হচ্ছে। এবার পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মাঘ মাসের প্রথম দিনেই গফরগাঁওয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তপায়রা খেলাঘর আসর ও সূর্যসারথি খেলাঘর আসর ব্রহ্মপুত্র নদের চরে আয়োজন করে পিঠা উৎসবের। উৎসবে প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তা থেকে বিভিন্ন স্তরের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ ২ শতাধিক মানুষ অংশগ্রহণ করে। বিকেল ৩টা থেকে শুরু করে সন্ধা ৭টা পর্যন্ত চলে এ পিঠা উৎসব। তখনও সকাল হয়নি, ভোর। ছোট্ট শিশু নুহাশ বাবার হাত ধরে কলেজ রোডের রাস্তা দিয়ে হাঁটছে ফুটপাথে। শীতের ভাপা পিঠা দেখে বাবাকে পিঠা কিনে দেয়ার জন্য বায়না ধরেছে। বাবা এদিক ওদিক তাকিয়ে পিঠার দোকানে গিয়ে ভাপা পিঠা না পেয়ে শীতের চিতই পিঠা কিনে দিলো। এমন দৃশ্য শীতে দেখা দিলেও মাঘের শুরুতে চোখে পড়ে গফরগাঁওয়ের পৌর এলাকাসহ গ্রামাঞ্চলে। পিঠা উৎসবের বিষয়ে আব্দুর রহমান ডিগ্রী কলেজের উপাধ্যক্ষ শফিকুল কাদির বলেন, দেশের ঐতিহ্য পৌষপার্বণসহ সারা বছরই বাংলাদেশের ঘরে ঘরে রকমারি পিঠা গ্রামের বধূরা তৈরি করে থাকে, তবে পৌষ-মাঘ মাসে উৎসব হিসেবে পিঠার বিষয়টি ‘ঐতিহ্যে জাগো বাঙালী’ নামকরণ করে আমরা পিঠা উৎসবের আয়োজন করে থাকি প্রতিবছর। বাংলাদেশের একেক অঞ্চলে রয়েছে একেক রকম পিঠা। দেশের উত্তরাঞ্চলে পিঠার যে ধরন, তার থেকে আলাদা ধরনের মধ্যাঞ্চলের পিঠা। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের পিঠা কিংবা পূর্বাঞ্চলের পিঠার মধ্যেও রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। আবার একই পিঠা একেক এলাকায় একেক নামে পরিচিত। যেমন তেলের পিঠাকে উত্তরবঙ্গের অনেক এলাকায় বলে (পাকান পিঠা)। বাংলাদেশে শতাধিক বা তার বেশি রকমের পিঠা থাকলেও মোটামুটি ২৫/৩০ ধরনের পিঠার প্রচলন রয়েছে বৃহত্তর ময়মনসিংহে : ভাপা পিঠা, নকশি পিঠা, চিতই পিঠা, রস পিঠা, ইলশে পিঠা, ডিম চিতই, পাটিসাপটা, পাকান, মুঠি পিঠা, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, পাতা পিঠা, চাঁদ পাকান, সুন্দরী পাকান, পুলি, পানতোয়া, মালপোয়া, মেরা পিঠা, মালাই, কুশলি, ক্ষীরকুলি, গোলাপ ফুল, লবঙ্গ লতিকা, ঝালপোয়া, ঝুরি, ঝিনুক, সূর্যমুখী, নারকেলি, সিদ্ধপুলি, ভাজা পুলি ও দুধরাজ। চালের গুঁড়া, নারকেল, খেজুরের গুড় দিয়ে বানানো হয় ভাপা পিঠা। গোল আকারের এ পিঠা পাতলা কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে ঢাকনা দেয়া হাঁড়ির ফুটন্ত পানিতে ভাপ দিয়ে তৈরি করা হয়। এ কারণেই এর নাম ভাপা পিঠা। গুড় গোলানো চালের আটা তেলে ছেড়ে দিয়ে যে পিঠা তৈরি করা হয়, তার নাম তেলের পিঠা। চালের গুঁড়া পানিতে গুলিয়ে মাটির হাঁড়িতে ভাজা হয় চিতই পিঠা। অতি সাধারণ এই পিঠা গুড় বা ঝাল শুঁটকি ভর্তা দিয়ে খেতে খুবই মজা। এই চিতই পিঠাকেই সারারাত দুধে বা গুড়ের রসে ভিজিয়ে তৈরি দুধ চিতই বা রস পিঠা। আরেকটি চমৎকার পিঠা হলো নকশি পিঠা। এই পিঠার গায়ে বিভিন্ন ধরনের নকশি আঁকা হয় বা ছাঁচে ফেলে পিঠাকে নানা রকম আদলে তৈরি করা হয় বলেই এই পিঠার নাম নকশি পিঠা। ছাঁচগুলো সাধারণত পাথর, কাঠ বা ধাতু দিয়ে তৈরি হয়। এসব ছাঁচের ভেতর দিকে নক্সা আঁকা থাকে। রস পাকান তৈরি হয় শুকনো সুজি, ডিম আর চিনি দিয়ে। সারাদেশেই পুলি পিঠা বেশ জনপ্রিয়। গুড় দিয়ে তৈরি হালকা বাদামি অথবা চিনির তৈরি সাদা রঙের পাটি সাপটা আরেকটি সুস্বাদু পিঠা। শীতকালে বিভিন্ন ধরনের পিঠার সঙ্গে পায়েশ ও ক্ষীরেরও রয়েছে অন্যরকম আবেদন। গ্রামাঞ্চলে শীতের পিঠা তৈরিকে যেমন উৎসব হিসেবে গণ্য করা হয় সে তুলনায় শহরে খুব কমই চোখে পড়ে পিঠাপুলির ব্যবহার। ইদানীং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আয়োজিত শীতের পিঠা উৎসব সাড়া ফেলেছে শহুরে জীবনে।
×