ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চিকিৎসকের অভাবে চিকিৎসা ব্যাহত

প্রকাশিত: ০৪:৩২, ২২ জানুয়ারি ২০১৯

চিকিৎসকের অভাবে চিকিৎসা ব্যাহত

আবুল হোসেন, বেনাপোল থেকে ॥ শার্শা উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষের একমাত্র চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র ৫০ শয্যার যশোরের শার্শা উপজেলা নাভারণ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সেবা প্রদানের জন্য দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ সরকারী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখন কয়েকজন চিকিৎসক রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা ও বাইরের পছন্দের বেসরকারী ক্লিনিকের সঙ্গে কমিশন বাণিজ্যের। এছাড়াও সার্জারি যন্ত্রপাতি অপ্রতুল, অপরিচ্ছন্নতা, ওয়ার্ডে পানি ও বিদ্যুতের সমস্যা, ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত বাথরুম, রোগীদের ওষুধ না দেয়া, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা রোগীদের কাছ থেকে ভিজিট নেয়া, সরকারী ওষুধ চোরাই পথে বিক্রিসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। শার্শার ১১টি ইউনিয়নের প্রায় ৩ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ভরসা ৫০ শয্যা বিশিষ্ট বুরুজবাগান স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। ১৯৬২ সালে নির্মিত এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটির নামকরণ করা হয় শার্শার আদর্শ গ্রাম বুরুজবাগানের নামে। প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে নির্মিত সুপ্রাচীন এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি এখন শার্শা ও ঝিকরগাছা উপজেলার ৩ লাখ মানুষের চিকিৎসা নির্ভরতার প্রতীক। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি। লোকবল, যন্ত্রপাতি চিকিৎসা সামগ্রীসহ সবকিছু রয়েছে পুরনো ধাঁচের। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রতিদিন প্রায় দুইশ রোগীর সমাগম ঘটে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গড়ে পাঁচ থেকে আট জন রোগী ভর্তি থাকে। অন্যরা বহিঃবিভাগে চিকিৎসা নেন। এখানে ডাক্তারদের অবহেলার কারণে কোন রোগীকে ভর্তির পর পরই রোগীর অবস্থা ভাল নয়। এই কথা বলে যশোর জেনারেল হাসপাতালসহ বিভিন্ন ক্লিনিকে পাঠিয়ে দেন। এদিকে বিপুলসংখ্যক রোগীর চাপ, অন্যদিকে ডাক্তার নার্স ও স্টাফদের সঙ্কটের কারণে চিকিৎসাসেবা হচ্ছে বিঘিœত। তার ওপর রয়েছে ডাক্তার নার্সদের অবহেলা। ২০১৫ সালের ৩ মার্চ থেকে শার্শা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও তিন বছরেও এখানে কোন জনবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। জনবলের অভাবে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। ১৬টি শূন্য পদ নিয়ে চলছে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা ব্যবস্থা। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২২ জন ডাক্তারের পদ থাকলে মাত্র ৬ জন ডাক্তার এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত আছেন। যা প্রতি ৫০ হাজার মানুষের জন্য একজন মাত্র ডাক্তার। প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে ২শ’ রোগী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহিঃবিভাগে চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। বহিঃবিভাগে প্রত্যেক রোগীর কাছ থেকে টিকেটের জন্য ৫ টাকা করে আদায় করা হলেও রোগীরা কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছেন না। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোলে কয়েক হাজার শ্রমিক আমদানিকৃত পণ্য নামানো উঠানোর কাজ করে এই বন্দরে। প্রায় সময়ে শ্রমিকরা আহত হয়। ডাক্তারের অভাবে মুমূর্ষু রোগী নিয়ে যেতে হয় বেনাপোল থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে যশোর জেনারেল হাসপাতালে। যেতে যেতে পথে রোগী মারা গেছে এমন অভিযোগও রয়েছে। সরেজমিনে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, সকাল সাড়ে ৮টা থেকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে ১০টার আগে কোন চিকিৎসককে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দেখা মেলে না। আবার বেলা ১টা বাজলে কোন ডাক্তারকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে খুঁজে পাওয়া যায় না। সঙ্গে আছে ডাক্তার, নার্স ও টেকনিশিয়ানদের চরম দুর্ব্যবহার। গত দুই দিনে সিজার করা রোগীর ড্রেসিং হয়নি এমন রোগীও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বেডে শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখা গেছে। দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ডাক্তার না পেয়ে চলে যাচ্ছে। উপজেলার আমতলা-গাতিপাড়া গ্রামের বৃদ্ধা রওশনারা (৬০) ও তাহেরা বেগম (৫৫) বলেন, সকাল ৮টায় টিকেট কেটে ডাক্তারের অপেক্ষায় বসে আছি। ১০টা বাজতে চললো এখনও কোন ডাক্তার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেনি। নাভারণের ফরিদুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অশোক কুমার সাহা নিজেই বাইরের পছন্দের বেসরকারী ক্লিনিকে রোগী পাঠানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আবার কখনও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকের দায়িত্ব পালন করেছেন। উপজেলার লক্ষণপুর গ্রামের নয়নতারা (২৭) জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরী বিভাগ থেকে সহকারী কমিউনিটি মেডিক্যাল অফিসার নিজামুল ইসলাম কয়েকটি রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বাইরের পছন্দের বেসরকারী ক্লিনিক থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিয়ে আসতে বলেন। আমরা গরিব মানুষ, বেসরকারী হাসপাতালে ভাল ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে গেলে অনেক টাকা লাগে তাই নাভারণের এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসেছি। কিন্তু ডাক্তারের অভাবে আমরা ভাল চিকিৎসা পাচ্ছি না। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিপর্যস্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা অশোক কুমার সাহা আনীত অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২২টি ডাক্তারের পদ থাকলেও এখানে মাত্র ৬ জন ডাক্তার নিয়োগ দেয়া আছে। আমি সবাইকে বলে দিয়েছি আজ থেকে কোন রোগী আর বাহিরে পরীক্ষার জন্য না পাঠাতে। সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তারের সঙ্কট রয়েছে, কোথাও দুই তিনজনের বেশি ডাক্তার নেই। সরকারীভাবে নতুন করে নিয়োগ দিলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে তিনি জানান।
×