ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মানসিকতা বদলানোর ওপর বিশিষ্টজনদের অভিমত

যৌতুকের রোষানলে ফিকে হচ্ছে প্রেম, ভাঙছে সংসার

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২১ জানুয়ারি ২০১৯

 যৌতুকের রোষানলে ফিকে হচ্ছে প্রেম, ভাঙছে সংসার

ওয়াজেদ হীরা ॥ প্রেম মানে না বাধা। ভালবাসার টানে পরিবারের অমতে লাভলু নামে এক যুবককে বিয়ে করেন অরুণা মল্লিক। স্বামীর অর্থলোভে বিয়ের তিন বছরেই ওই ভালবাসা এখন চক্ষুশূল। যদিও রয়েছে ১১ মাসের কন্যা সন্তানও। তাতে কি! যৌতুক নামক অর্থের লোভে স্ত্রীকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল লোভী স্বামী। এটি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার একটি সাম্প্রতিক ঘটনা। ভাগ্য সহায় হওয়ায় মল্লিক বেঁচে গেছে। তবে ক্রমাগত অত্যাচারিত নওগাঁর ছালমাকে (২৫) পাষ- স্বামী হত্যাই করেই পালিয়েছে। শহর কিংবা গ্রাম, দেশের নানা প্রান্তে প্রায়ই যৌতুকের শিকার নারীরা। কেউ স্বামী কেউ বা স্বামীর স্বজনদের যৌতুকের বলি হয়ে প্রাণ হারাচ্ছেন। কেউবা ক্রমাগত অত্যাচার সহ্য করে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। আবার কোন নারী মুখবুঁজে সংসারে প্রতিনিয়তই সহ্য করে যাচ্ছেন অত্যাচার। যৌতুক নিরোধে আইন-বিচার সবই আছে। আছে সচেতনতাবোধও। কিছু অশিক্ষিত মানুষের পাশাপাশি শিক্ষিতরাও যৌতুক আদায় করতে নানামুখী চাপ সৃষ্টি করছে। এতে কারো কারো সংসার নীরবেই ভেঙ্গে যাচ্ছে। তবু থেমে নেই নারীর প্রতি যৌতুকের রোষানল। একাধিক সাম্প্রতিক ঘটনার কেসস্টাডি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যৌতুক বা স্ত্রীর বাবার বাড়ি থেকে উপঢৌকন পাওয়ার আশায় প্রায়ই স্ত্রীর সঙ্গে স্বামী বা স্বামীর পরিবারের লোকজনের ঝগড়া লেগে থাকে। হাতাহাতি হয়। কখনও কখনও স্বামীর স্বজনরাও যৌতুক আদায় করতে স্বামীদের উসকে দেয়। যৌতুক নিয়ে সংসারে অশান্তি কখনও বৈবাহিক বয়সের ওপরও নির্ভর করে না। বিভিন্ন কেসস্টাডিতে দেখা গেছে বিয়ের ৫ বা ৭ বছর পর একাধিক সন্তান থাকা অবস্থায়ও যৌতুক নিয়ে ঝগড়া লেগেই থাকছে। যৌতুক আদায় করাটা অনেক পুরুষ ‘প্রাপ্য অধিকার’ মনে করে। অনেক সময় দেখা যায় মেয়ের সুখের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন উপঢৌকন দেয়া হচ্ছে। টিভি, ফ্রিজ, মোটরসাইকেল, ঘর সাজানোর বিভিন্ন ফার্নিচার কিংবা নগদ টাকাও। তাতে অনেকের মন ভরে ওঠে না। আরও চাই, বেশি চাই নীতিতে লোভী মানুষগুলো মরিয়া হয়ে ওঠে। আর এজন্য সহজ কৌশল হিসেবে স্ত্রীর ওপর চড়াও হয়। হত্যা করছে যৌতুকলোভী স্বামীরা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন গণমাধ্যমের কারণে যতটুকু জানা যাচ্ছে তার বেশির ভাগই আড়ালে থেকে যাচ্ছে। গত ১১ জানুয়ারি বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে যৌতুকের দাবি পূরণ করতে না পারায় সাথী আক্তার (২৭) নামে এক গৃহবধূর শরীরের বিভিন্ন অংশে সিগারেটের আগুনের ছ্যাঁকাসহ ওই গৃহবধূর মাথার চুল কেটে দিয়েছে পাষন্ড স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যরা। গুরুতর আহত অবস্থায় মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন নির্মম নির্যাতনের শিকার ওই গৃহবধূ। এদিকে নেত্রকোনায় স্ত্রীর দায়ের করা যৌতুক মামলায় পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মাজহারুল ইসলামকে (৩৫) কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পুলিশ যেখানে রক্ষক সেখানে কতিপয় সদস্য ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ! বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালে যৌতুকের জন্য বলি হয়েছেন ১০২ জন। যৌতুকের জন্য নির্যাতিত হয়েছেন ২১২ জন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে এক হাজার ৪৪৬ নারীকে শুধু যৌতুকের কারণে স্বামী ও স্বজনরা হত্যা করেছে। এর বাইরে একই সময়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আরও এক হাজার ২১৭ নারী। এদিকে মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৮ নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) চলতি মাসে সংস্থার জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক আবু আহমেদ ফয়জুল ফরিদ জানান, ২০১৮ যৌতুকের কারণে ও পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ১৯৫ নারী। একাধিক গণামাধ্যমের প্রকাশিত রিপোর্ট বিবেচনায় নিয়ে বেসরকারী সংস্থাগুলো এই তথ্য উপস্থাপন করলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন বাস্তবতায় নিরবে নিভৃতে আরও অনেক বেশি নারী এই যৌতুকের রোষানলের শিকার। ফলে অনেক সময়ই সংসার ভেঙ্গে গেলেও যার অনেকটাই গণমাধ্যমে উঠে আসে না। সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, দেখুন আমাদের সমাজে একজন শিক্ষিত ব্যক্তিকেও দেখি যৌতুকের লোভে স্ত্রীর ওপর চড়াও হতে। সেখানে অশিক্ষিত নিম্ন শিক্ষিত ব্যক্তিদের বোঝানো আরও কঠিন। আমরা যা শুনি প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর ভয়াবহতা আরও বেশি। অনেক সংসার শুধু এই লোভের কারণে ভেঙ্গে যাচ্ছে যা আমরা খবরই রাখি না। একাধিক আইনজীবীদের মতে, যৌতুক মামলাগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের হয়। কোন মামলায় প্রথমে বাদী যত উৎসাহের সঙ্গে শুরু করেন অনেক সময়ই সেই উৎসাহ আর শেষপর্যন্ত ধরে রাখতে পারেন না। কেননা প্রায়ই দেখা যায় সাক্ষী হাজির হন না। পলাতক থাকেন অনেক আসামি। আবার আদালতের বাইরে কেউ কেউ মামলা আপোস করে ফেলেন। এর ফলে মামলায় সাজার হারও কমে যায়। মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানুর মতে, শুধু যারা যৌতুক দিচ্ছে, তারা নয়। যারা দিচ্ছে, তারাও অপরাধী। এটা একটি সামাজিক ব্যাধি। আমাদের সমাজে মেয়েদের যেভাবে দেখা হয়, সেই দৃষ্টিভঙ্গি তো বদলায়নি। বিয়েতে যৌতুক দেয়া এবং নেয়া আমাদের সমাজে এখনো প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে কিন্তু যৌতুকবিরোধী আইন আছে। অথচ যারা যৌতুক দিচ্ছে এবং নিচ্ছে তারা কিন্তু এই আইনের তোয়াক্কা করছে না। যারা যৌতুক দিচ্ছে বা নিচ্ছে তারা সামাজিকভাবে অপরাধী। তাদের বয়কট করতে হবে। এই চর্চাটা শুরু করা দরকার বলেও জানান তিনি। ইউএনডিপি পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৫০ শতাংশ বিবাহিত নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জনকণ্ঠকে বলেন, দুর্বল ভেবে নারীদের উপর সুযোগ নেয় কিছু পুরুষ। সমাজের কিছু মানুষ স্ত্রীর বাবার বাড়ি থেকে কিছু আদায় করাটা অধিকারই মনে করে। এমনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করেও এটি বুঝতে পারে না এটি একটি সামাজিক ব্যাধি। একটা সময়ের চেয়ে অনেকটা কমে এসেছে তবে বর্তমানে যৌতুক আদায়ের ধরনটাও একটু ভিন্ন। আমাদের উচিত হবে স্ব স্ব অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখা। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হকও মনে করেন, সমাজের সবারই যৌতুক দেয়া এবং নেয়ার বিষয়ে মানসিকতা পরিবর্তন জরুরী। তিনি আরও বলেন, মেয়েরা এখন অনেক এগিয়ে যাচ্ছে, সমাজ পরিবর্তন হচ্ছে। কেউ যৌতুক চাইলে বা কেউ দেয়ার আগ্রহ পোষণ করলে সামাজিকভাবেও প্রতিহত করা যায় বলে জানান। মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, নারীনেত্রী, সমাজবিজ্ঞানীসহ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌতুক নেয়া-দেয়া চলছেই। একে অপরাধ মনে না করে ‘স্বাভাবিক বিষয়’ হিসেবেই মেনে নেয়া হচ্ছে। মেয়েকে ‘যোগ্য’ পাত্রের হাতে ভুলে দেয়া বা ভাল বিয়ে দিতে মেয়ের জন্মের পর থেকেই মা-বাবা টাকা জমাতে থাকেন। মেয়েকে বিয়ে দেয়ার সময় যে মা-বাবা যৌতুক দিতে বাধ্য হচ্ছেন, তারাই তাদের ছেলের বিয়েতে যৌতুক নিয়ে ক্ষতি পোষাতে চাইছেন। কিন্তু আধুনিক এই দেশের নিরব ঘাতক হিসেবে কাজ করা এই যৌতুক পুরোপুরি নির্মূলে নিজ অবস্থান থেকেই ভূমিকা রাখা বেশি প্রয়োজন বলে মত বিশিষ্টজনদের। যদিও দেশে ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনে যৌতুকের কারণে গুরুতর জখম ও বিভিন্ন অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদন্ডসহ কঠোর সাজার কথা বলা আছে। এছাড়াও গতবছর বিবাহে যৌতুক দাবি, গ্রহণ বা প্রদানের পাশাপাশি এক্ষেত্রে সহায়তা করার অপরাধে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদন্ডের বিধান রেখে সংসদে ‘যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৮’ পাস করা হয়। এছাড়া যৌতুকের অভিযোগে মিথ্যা মামলা করলেও ৫ বছরের জেল ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। বিশিষ্টজনদের মতে, শরীর অসুখ হলে তার যেমন পরিচর্যা দরকার তেমনি সামাজিক ব্যাধি যৌতুক নির্মূল করতে সচেতনতার সঙ্গে স্ব স্ব অবস্থানের ভূমিকা বেশি প্রয়োজন। কিছু ভুল গোটা পরিবারের স্বপ্ন ধ্বংস করে দিচ্ছে। সারাজীবনেও শোধরানো যাচ্ছেনা। লোভের ফাঁদে পা না দিয়ে মানসিকতা দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত করলে প্রতিটি পরিবার হতে পারে এক একটি আদর্শ পরিবার। আর সুখী ও আদর্শ পরিবার গড়তে পারিবাবিক শিক্ষার সঙ্গে নিজেকেই পাল্টানোর কথা বলছেন দেশের সচেতন ব্যক্তিরা।
×