ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আরও সুন্দর হবে অমর একুশে গ্রন্থমেলা

হেঁটে শাহবাগ থেকে বাংলা একাডেমি, দুর্ভোগ বোঝার আগাম চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২১ জানুয়ারি ২০১৯

হেঁটে শাহবাগ থেকে বাংলা একাডেমি, দুর্ভোগ বোঝার আগাম চেষ্টা

মোরসালিন মিজান ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলা, আহা, কী আবেগের! অদ্ভুত ভাললাগার। ভালবাসার। সময়টি, হ্যাঁ, চলে এসেছে। আর মাত্র ক’দিন পর ফেব্র‍ুয়ারি। ভাষার মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়ে যাবে বইমেলা। শুধু তো বইমেলা নয়। বাঙালী সংস্কৃতির উৎসব। উজ্জীবন। প্রস্তুতিটাও বড়সড়ো। মাসব্যাপী আয়োজন সামনে রেখে যথারীতি ব্যস্ত সময় পার করছে আয়োজক বাংলা একাডেমি। কিন্তু এবারও কি সেই চেনা ব্যস্ততা? পুরনো গৎবাঁধা হুড়োহুড়ি, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্টল কমানো বাড়ানো, ক্ষণে ক্ষণে নক্সা পরিবর্তন, টেলিভিশনে ঘন ঘন ইন্টারভিউ? নাকি দৃশ্যমান কোন পরিবর্তন আনার সচেতন প্রয়াস? অনেক প্রশ্ন। তবে উত্তর খুঁজতে গিয়ে মোটামুটি আশাবাদী হওয়া গেল। একটি পরিবর্তনের আভাস স্পষ্ট। অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে সুন্দর একটি মেলা উপহার দিতে পারবে একাডেমি। প্রস্তুতি ঘুরে দেখে, সংশ্লিষ্ট সব মহলের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা হয়েছে। বাংলা একাডেমিতে এবার নতুন মহাপরিচালক। দীর্ঘকাল পর অচলায়তন ভাঙ্গার সুযোগ। সমকালীন ভাবনা যোগ করার উপযুক্ত সময়। সাহিত্যের মানুষ স্বনামধন্য কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী দায়িত্ব পেয়েছেন। এই ক’দিন আগে কাজ শুরু করেছেন তিনি। তবে মেলার প্রস্তুতি দেখে সেটি মনে হয় না। অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক আগেভাগেই কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে স্টল বিন্যাস। যেখানে খুশি যেভাবে খুশি বাঁশ পোঁতা হচ্ছে না। বিচ্ছিন্নভাবে একে জিজ্ঞস করে, তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে সাজানো হচ্ছে না মেলা প্রাঙ্গণ। বরং বাংলাদেশের নামকরা একজন স্থপতির শরণাপন্ন হয়েছে একাডেমি। নক্সা প্রণয়নের মূল কাজটি করেছেন এনামুল করিম নির্ঝর। প্রাথমিকভাবে নক্সাটি দেখে মনে হয়েছে, অপেক্ষাকৃত সুন্দর ও নান্দনিক একটি আর্কিটেকচারাল ভিউ, একটি আর্কিটেকচারাল হেরিটেজ পাওয়া যাবে এবার। বাড়বে সুযোগ সুবিধাও। রবিবার বিকেলে শাহবাগ থেকে বাংলা একাডেমি পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার সময় কয়েকদফা হোঁচট খেতে হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় গর্ত। কোন কোন অংশ ভেঙ্গে এমনভাবে নিচে নেমে এসেছে যে, হাঁটতে গেলে বিপদের আশঙ্কা শতভাগ। নড়বড়ে টাইলসে পা পিছলে যাওয়ার উপক্রম হয়। আর ফুটপাথ দখলে নিয়ে দোকানদারি তো আছেই। রাস্তাটা তাই কোথাও কোথাও অর্ধেক হয়ে গেছে। কোথাও বরই গাছের কাঁটা ভর্তি ডাল এসে জামা ছিঁড়ে দিচ্ছে। শাহবাগ থানা ঘেঁষা ফুটপাথের ওপরে আবর্জনার ভাগাড়। নিচ দিয়ে হেঁটে যাবেন? বড় ডাস্টবিন হা করে আছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন ফুটপাথের অন্তত পাঁচটি স্থানে দাঁড়িয়ে জল বিয়োগ করছেন তথাকথিত ভদ্রলোকেরা। সেই জল গড়িয়ে মূল সড়কে নেমে আসছে! এ দৃশ্য বলে বোঝাবার মতো নয়। অনেকে নাকে রুমাল চেপে, না, আসলে ঠিক রুমাল নয়। শার্টের কলার টেনে নাক পর্যন্ত নিয়ে আসছেন। চেপে ধরছেন। টিএসসি পেড়িয়ে বাংলা একাডেমির দিকে সামান্য এগোতেই চোখে পড়ে একটি বড় কন্টেনার। পড়ে আছে তো আছেই। এটি সামান্য আড়াল দিচ্ছে যেহেতু, এখানেও কিছুক্ষণ পর পর দাঁড়িয়ে যাচ্ছে কান্ডজ্ঞানহীনরা। এবং বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব নোংরা দৃশ্য দেখতে দেখতে ভাঙ্গা ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতেই মেলায় পৌঁছতে হয়। এতকাল তা-ই হয়েছে। এবার? বইপ্রেমীদের দুর্ভোগ নিয়ে ভাবছে কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ভাবছে। বছরের পর বছর ধরে এড়িয়ে চলা দুর্ভোগ লাঘবে জরুরী পদক্ষেপ নিচ্ছে একাডেমি। ফুটপাথ ও আশপাশের এলাকা সরেজমিন দেখতে কয়েকদিনের মধ্যেই মাঠে নামছেন খোদ মহাপরিচালক। সংশ্লিষ্ট সকলকে সঙ্গে নিয়ে ফুটপাথগুলো পরিদর্শন করবেন তিনি। না, একা বাংলা একাডেমির একার কাজ নয়। তাই সংশ্লিষ্ট সকলের সহায়তা চাওয়া হবে। সে লক্ষ্যে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামানকে। সবাই মিলে সমস্যাগুলো নিজ চোখে দেখবেন। চিহ্নিত করবেন। এবং মেলা শুরুর আগেই শুরু হবে ফুটপাথ সংস্কার ও ঝকঝকে তকতকে করার কাজ। মেলার ভেতরের অংশের পাশাপাশি বাইরেও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে একাডেমির মহাপরিচালক হাবিবুল্লাহ সিরাজী জনকণ্ঠকে বলেন, বই মেলার মূল ভেন্যু সব দিক চিন্তা করে সুবিন্যস্ত করা হচ্ছে। এর পাশাপাশি মেলায় আসার পথে যত দুর্ভোগ পোহাতে হত, এবার তা পোহাতে হবে না। এ জন্য কয়েকদিনের মধ্যেই শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পায়ে হেঁটে দেখব আমরা। একজন সাধারণ পাঠক যেভাবে শাহবাগ বা দোয়েল চত্বর দিয়ে পায়ে হেঁটে মেলায় প্রবেশ করেন আমরাও তাদের মতো প্রবেশ করব। পুরো এলাকা ঘুরব। ফুটপাত ও এর আশপাশের পরিবেশ কেমন তা দেখব। সমস্যাগুলো ভালভাবে চিহ্নিত করতেই এমন উদ্যোগ বলে জানান তিনি। বলেন, আসা যাওয়ার পথে যত ধরনের বিঘ্ন চোখে পড়বে সব দূর করা হবে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা সবার উল্লেখ করে তিনি বলেন, হেঁটে যাওয়ার সময় ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে আমরা পাশে চাইব। ফুটপাথ ও আশপাশ পরিদর্শনে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেবে বাংলা একাডেমি। সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় মেলার বাইরের অংশেও একটি নান্দনিক পরিবেশ দিতে পারবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এ তো গেল আয়োজনের কথা। বইয়ের বিষয়ে কী ভাবা হচ্ছে? অগণিত বই প্রকাশিত হয় মেলায়। মানসম্পন্ন বই আলাদা করে পাঠকের সামনে তুলে ধরার কোন উদ্যোগ কি নিতে পারে একাডেমি? এমন প্রশ্নে চটজলদি উত্তর করেন তিনি। বলেন, এবারই প্রথম ভাল বই খুঁজে বের করার জন্য একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। কমিটির সদস্যরা অপেক্ষাকৃত ভাল বই নির্বাচন করবে। বইগুলো নিয়ে লেখক আলাদা করে কথা বলারও সুযোগ পাবেন। সে জন্য একটি মঞ্চ প্রস্তুত করা হচ্ছে। নতুন এই সংযোজনের নাম ‘লেখক বলছি।’ অমর একুশের মেলার এবারের প্রতিপাদ্য ‘বিজয় : ১৯৫২ থেকে ১৯৯৭১ নব পর্যায়।’ এই থিমের মধ্য দিয়ে কী আসলে বলতে চাওয়া? জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, সামনে আমার সোনার বাংলার পঞ্চাশ বছর পূর্তি হচ্ছে। সেইসঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিন উদ্যাপন করবে জাতি। মেলার এ বছরটিকে আমরা উদ্যাপনের প্রস্তুতি বর্ষ হিসেবে গ্রহণ করেছি। মেলা আয়োজনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানাভাবে এ ভাবনা প্রকাশিত হবে। বড় দুটি উপলক্ষ মনে করিয়ে দেয়ার চেষ্টা থেকে এমন প্রতিপাদ্য বলে জানান তিনি। এদিকে, চূড়ান্ত হয়েছে উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতাও। মেলা উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সঙ্গে একই মঞ্চে দারুণ আকর্ষণ হয়ে আসবেন বহু কালজয়ী কবিতার অমর স্রষ্টা শঙ্খ ঘোষ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার কথা রয়েছে তার। মঞ্চে থাকবেন মিসরের লেখক সাংবাদিক মোহসেন আল-আরিশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে নতুন আঙ্গিকে লিখেছেন তিনি। তার নিজের ভাষায় লেখা বইয়ের অনুবাদ প্রকাশ করছে বাংলা একাডেমি। শিরোনাম ‘যে রূপকথা শুধু রূপকথা নয়।’ লেখকের উপস্থিতিতে বইটি প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেয়া হবে বলে জানান মহাপরিচালক। সব মিলিয়ে একটু অন্যরকম একটু বেশি উপভোগ্য হবে এবারের মেলা- এমনটিই আশা করছেন বইপ্রেমী মানুষ।
×