ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ছাত্রলীগের ডিজিটাল একাত্তর

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২১ জানুয়ারি ২০১৯

ছাত্রলীগের ডিজিটাল একাত্তর

সবাই জানেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ৪ জানুয়ারি ১৮ সালে সংস্থাটির ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করেছে। ছাত্রলীগের নতুন সভাপতি শোভন ও সাধারণ সম্পাদক রাব্বানীর নেতৃত্বে ঐতিহাসিক এই সংগঠনটি ১৯ সালের প্রেক্ষিতে এক নতুন দিগন্তে পা ফেলেছে। অভিনন্দন এই দুই তরুণকে ডিজিটাল বাংলাদেশের উপযোগী একটি ছাত্র সংগঠন গঠনের প্রয়াসে সক্রিয় হবার জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ তাদের কর্মীবাহিনী কর্তৃক আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি উপ-কমিটির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অসাধারণ কাজ করার জন্য। আমি প্রত্যাশা করি, তাদের নেতৃত্বে ছাত্রলীগ ডিজিটাল যুগের নেতৃত্বদানকারী একটি ছাত্র সংগঠনে পরিণত হবে। ১৯৬২ সালে প্রথম আইয়ুব খানের শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে প্রথম ছাত্রলীগের কর্মী বা সমর্থক হয়েছিলাম। তখন আমি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। ছাত্রলীগ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। সেই ধর্মঘটে যোগ দিয়ে কর্মী হওয়ার যাত্রা শুরু করি। স্কুলে এরপর আর কোন রাজনৈতিক কর্মকা- করেছিলাম বলে মনে পড়ে না। এরপর ঢাকা শহরে আসি ৬৫ সালে এবং ৬৬ সালে এসএসসি পাস করে ভর্তি হই ঢাকা কলেজে। সেই ঢাকা কলেজই বস্তুত আমার ছাত্র রাজনীতির সূতিকাগার। কলেজটি সরকারী ছিল বলে সেখানে কোন রাজনীতি করার অধিকার ছিল না। তবে সরকারী কলেজটির অবস্থাটা বদলে যায় ৬৭ সালে। আমরা যারা অতি কষ্টে ৬৬ সালে কলেজের গেটের বাইরে এসে মিছিল করতাম, সভা করতাম বা লিফলেট বিলাতাম তারা আরও একটু শক্তি পাই যখন বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল কলেজের ছাত্র হিসেবে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। বস্তুত তখন ছাত্রলীগ ঢাকা কলেজে প্রকাশ্য রাজনীতি করা শুরু করে। ৬৮ সাল পর্যন্ত আমার রাজনীতি ঢাকা কলেজকেন্দ্রিক ছিল। সেই বছরের জুলাইতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ায় রাজনীতি করার ক্ষেত্রটা বদলে যায় এবং বলা যেতে পারে রাজধানীতে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যোগ দিতে সক্ষম হই। বিষয়টি এমন যে, ৬৬ সালের পথচলা ৬৮-৬৯-৭০-৭১ এর পথপরিক্রমায় জীবনে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিণতি গড়ে ওঠে। আমি বরাবরই বলি জীবনে যে ছাত্রলীগ করেনি তার জীবনটা আঁধারই থেকে গেছে। ৬২ সালের শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলনটা বুঝিনি। সবার সঙ্গে লাইন ধরে মিছিলে গিয়েছিলাম। তবে ৬৬ থেকে ৬৮ সময়কালে ছয় দফা ও ১১ দফার আন্দোলন একটি অসাধারণ মানসিক বিকাশে সহায়ক হয়। আমি খুব দৃঢ়তার সঙ্গে এটি বিশ্বাস করি যে, অন্তত ৬৬ থেকে ৭১ সময়কালে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে আমি যা পেয়েছি তার কোন তুলনা হবার নয়। পোস্টার লেখা, স্লোগান দেয়া, বক্তৃতা দেয়া, রাজনীতিকে সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত করা, কঠোর কায়িক শ্রমের পাশাপাশি সৃজনশীল হতে পারা, জীবন-পরিবেশ, দেশ ও বিশ্বকে উপলব্ধি করতে পারার পাশাপাশি একাত্তরে মুজিব বাহিনীর সদস্য হওয়া, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে গণতন্ত্রের যে দীক্ষা ছাত্রলীগ দিয়েছে তা আমার ৭০ বছর বয়সের জীবনে অনন্য ভূমিকা পালন করছে। তবে এখন যারা ছাত্রলীগ করছে তাদের জন্য একটু ছোট উপদেশ হলো, দেশটা ডিজিটাল হচ্ছে এবং সেজন্য ছাত্রলীগকেও ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে নেতৃত্ব দিতে হবে। আগামী দিনের জ্ঞানভিত্তিক সমাজ, ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব বা নতুন প্রযুক্তির আলিঙ্গন ছাত্রলীগের হাত ধরেই হতে হবে। সংগঠনটিকে এখন কেবল আর একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন হিসেবে চিন্তা করলে হবে না। ইতিহাস বলে এটাই ছাত্রলীগের ধারাবাহিকতা যে ছাত্রলীগ দেশের সকল জনগোষ্ঠীর অন্য ও অগ্রণী সৈনিক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছে। যখন যে সময়টা এসেছে দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর আগে ছাত্রলীগ সেটি উপলব্ধি করেছে এবং পুরো দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। এবারের নির্বাচনে আমি নিজের চোখে এই তারুণ্যের শক্তি অবলোকন করেছি। যদিও আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুতে সংগঠনটি তাদের নির্ধারিত কর্মসূচী স্থগিত করেছে তথাপি ৭১ বছর বয়সী এই সংগঠনটির সামনের দিনগুলোর দিক নির্দেশনা খোঁজা অতি জরুরি একটি বিষয়। আমি নিজে মনে করি ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জন্ম নেয়া এই ছাত্র সংগঠনটি বস্তুত এখন, ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর, ২০২০ সালের মুজিব বর্ষ, ২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, ৩০ সালের এসডিজি গোল এবং ৪১ সালের জ্ঞানভিত্তিক সমাজকে সামনে রেখে নতুন একটি রূপান্তরের পথ ধরে চলছে। তাদেরকে হয়তো ৭১ সালের স্বাধীনতার শতবর্ষ এবং ২১০০ সালের বদ্বীপ পরিকল্পনার কথাও মাথায় নিতে হবে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র আর এক স্থানে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘একটা ঘটনার দিন তারিখ আমার মনে নেই, ১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে, ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাঁরা হলেন, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন। আমরা বললাম, এই কনফারেন্সে রাজনীতি আলোচনা হবে না। শিক্ষা ও ছাত্রদের কর্তব্য সম্বন্ধে বক্তৃতা হবে। ছাত্রদের মধ্যেও দুটা দল হয়ে গেল। ১৯৪২ সালে আমি ফরিদপুর গিয়ে ছাত্রদের দলাদলি শেষ করে ফেলতে সক্ষম হলাম। তখন মোহন মিয়া সাহেব ও সালাম খান সাহেব জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী) বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘এই সময় থেকে মুসলিম লীগের মধ্যে দুটা দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একটা প্রগতিবাদী দল আর একটা প্রতিক্রিয়াশীল। শহীদ সাহেবের নেতৃত্বে আমরা বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকরা মুসলিম লীগকে জনগণের লীগে পরিণত করতে চাই, জনগণের প্রতিষ্ঠান করতে চাই। জমিদার, জোতদার ও খান বাহাদুরের দলেরাই লীগকে পকেটে করে রেখেছিল।’ (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ-১৭) ফলে ১৯৪৭ সালের দিকে মুসলিম ছাত্রলীগও দুই দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একদল পরিচিত হতো শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেবের দল বলে, আরেক দল পরিচিত হতো খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব এবং মওলানা আকরাম খাঁ সাহেবের দল বলে। (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ-৩১) ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ নাম বদলিয়ে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ করা হয়েছিল। শাহ আজিজুর রহমান এই সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে বহাল ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘ঢাকায় কাউন্সিল না করে অন্য কোথাও তাঁরা সম্মেলন করলেন গোপনে। কার্যকরী কমিটির সদস্য প্রায় অধিকাংশই ছাত্র ছিলেন না, ছাত্র রাজনীতি তারা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে এই সংগঠনের নির্বাচন হয়েছিল আর হয়নি।’ বঙ্গবন্ধু এবং আরও অনেকে এই কমিটি মানেননি। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। তারা শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বের ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু নিজে ছাত্রলীগ কর্মীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে একমতে পৌঁছেছিলেন। যাঁদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এ সময় আলাপ-আলোচনা করেছিলেন তাঁরা হলেন, আজিজ মোহাম্মদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, দবিরুল ইসলাম, নইমউদ্দিন, মোল্লা জালালউদ্দিন, আবদুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মতিন খান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এঁরা এবং আরও অনেক ছাত্র নেতা তখন একটি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। এরপর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক মুসলিম হলের এ্যাসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হয়েছিল। একটি ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার জন্য সেখানে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। যার নাম দেয়া হলো ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’। এখানে নইমউদ্দিনকে কনভেনর করা হয়েছিল। যদিও অলি আহাদ এর সদস্য হতে আপত্তি করেছিলেন। কারণ হিসেবে বলেছিলেন ‘তিনি আর সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান করবেন না।’ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম দিলে তিনি থাকতে পারেন। বঙ্গবন্ধু তখন অলি আহাদকে বুঝাতে চেষ্টা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে তখনও সময় আসেনি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছিলেন। নামে কিছুই আসে যায় না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবে না। ‘কয়েক মাস হলো পাকিস্তান পেয়েছি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পেয়েছি, সেই মানসিক অবস্থা থেকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের মতো পরিবর্তন করতে সময় লাগবে।’ (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ-৮৯)। Secret Documents of Intellegence Branch on Father of the nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Volume 1 ১৯৪৮-৫০ এর ৬ পৃষ্ঠায় বিশেষ বাহিনীর প্রতিবেদন: I have the honour to report the members of the provisional organising committee of the East Pakistan Muslim Students League as follows. They were the signatories of the leaflet which advocated Bengali to be the state language of Pakistan বইটির তৃতীয় পাতায় এর পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দেয়া আছে। সম্ভবত ছাত্রলীগের নামে পাকিস্তানে প্রকাশিত এটিই প্রথম লিফলেট যাতে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবী তোলা হয়। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পরে বঙ্গবন্ধু এই সংগঠনটির অফিস করেছিলেন ১৫০ নম্বর মোগলটুলী। ‘মুসলিম লীগ নেতারা চেষ্টা করেছিলেন এই অফিসটা দখল করতে, কিন্তু শওকত মিয়ার জন্য পারেননি।’ ‘ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার পর বিরাট সাড়া পাওয়া গিয়েছিল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভিতর বঙ্গবন্ধু প্রায় সব জেলায় কমিটি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যদিও নইমউদ্দিন ছিল কনভেনর, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকেই সবকিছু তখন করতে হতো। তিনি একদল সহকর্মী পেয়েছিলেন, যারা সত্যিকার নিঃস্বার্থ কর্মী ছিলেন। তখনকার পূর্ব পাকিস্তান সরকার প্রকাশ্যে শাহ আজিজুর রহমানের ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’কে সাহায্য করত। আমরা সবাই জানি ছাত্রলীগের পথ ধরে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। আমরা এটাও জানি যে, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ উভয় সংগঠন থেকেই মুসলিম শব্দটি পরে বাদ দেয়া হয়। (আগামী পর্বে সমাপ্ত) লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সম্পাদক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক
×