ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মরাগাঙে জোয়ার আনতে উত্তরের তিন জেলায় বৃহৎ পরিকল্পনা

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২০ জানুয়ারি ২০১৯

মরাগাঙে জোয়ার আনতে উত্তরের তিন জেলায় বৃহৎ পরিকল্পনা

সমুদ্র হক ॥ মরা গাঙে জোয়ার এনে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নদীকে আশীর্বাদের নদীতে পরিণত করে উন্নয়নের বহুমুখী ধারা এগিয়ে নিতে উত্তরাঞ্চলের তিন জেলায় নদীকেন্দ্রিক বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। দুই হাজার ২শ’ ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পটি গেল বছরের ৭ নবেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। ১০ জানুয়ারি প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। চার বছর মেয়াদী প্রকল্পটির কাজ চলতি বছরের মধ্যভাগে শুরু হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে বগুড়াকে কেন্দ্রবিন্দু করে উত্তরে গাইবান্ধা ও দক্ষিণে সিরাজগঞ্জ জেলার মধ্যে বয়ে যাওয়া ২শ’১৭ কিলোমিটরের মৃতপ্রায় নদীগুলোকে জাগিয়ে তোলা হবে। বাঙালী, করতোয়া, ফুলজোড় ও হুরাসাগর নদী পূর্বাবস্থার নাব্য ফিরিয়ে আনতে ড্রেজিং পুনর্খনন করার পর নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে তীর সংরক্ষণ করা হবে। এভাবে চারটি নদীর জোয়ার এলে সংযুক্ত বড় নদী যমুনার স্বাভাবিক স্রোতধারায় আরও অন্তত পাঁচটি নদী তার পূর্বের ধারা ফিরে পাবে। উত্তরাঞ্চলের অন্যতম নদী যমুনা ও শাখা নদীগুলো কখনও প্রাকৃতিক কখনও মানুষের সৃষ্ট কারণে দুর্যোগের মুখে পড়তে হচ্ছে। ভাঙ্গন, বালিয়ারি, মৎস্য আধার রুদ্ধসহ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। ফলে কখনও বসতভিটা আবাদী জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। চর পড়ে নৌপথ বন্ধ হচ্ছে। কৃষক, জেলে পরিবার, বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। বালু ও পলি জমে নদীগুলোর তলদেশ উঁচু হয়ে অল্প বর্ষায় তীরে পানি উঠে ছড়িয়ে পড়ে বন্যা অবস্থার সৃষ্টি করছে। নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি। হারাচ্ছে মৎস্য সম্পদ। এদিকে উজানি নদী যমুনা বগুড়ার সোনাতলা সারিয়াকান্দি ও ধুনটের ওপর দিয়ে বয়ে ভাটির দিকে গেছে। প্রাচীন এই নদীর স্রোতধারা স্বাভাবিক নয়। পানি বিজ্ঞানীগণ মেয়েদের চুলের বেনীর মতো পেঁচানো এই নদীর গতিধারা ও গতিপথ আজও বুঝে উঠতে পারেননি। ফলে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। সময়ে সময়ে নদীর তীর রক্ষায় হার্ড পয়েন্ট রিভেটমেন্টসহ নানা ধরনের শক্ত কাঠামো নির্মিত হয়েছে। এতে নদী অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হলেও চিরস্থায়ী কোন বন্দোবস্ত আজও গড়ে তোলা যায়নি। এই অবস্থায় যমুনার শাখা নদীগুলোকে খনন ও তীর রক্ষা করে ভর বছর নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ ও গতিপথ ঠিক রাখার পরিকল্পনা নেয়া হয়। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালি ও এলাই নদীর মিলনস্থলে বাঙালী নদীর উৎপত্তি। বাঙালীর উত্তর থেকে দক্ষিণে বগুড়ার সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলার মধ্যে বয়ে শেরপুরের খানপুরে করতোয়া নদীতে মিশেছে। এরপর সিরাজগঞ্জের নলকায় গিয়ে ফুলজোড় নাম ধারণ করে শাহজাদপুর উপজেলার দক্ষিণে হুরাসাগর নদীত মিশেছে। তারপর হুরাসাগর নাম নিয়ে যমুনা নদীতে মিশে। এই চার নদী মৃতপ্রায় হওয়ায় যমুনার স্রোতধারার ব্যত্যয় ঘটেছে। নদীগুলোকে বাঁচিয়ে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে এনে পুরো এলাকার নদী কেন্দ্রিক সকল উন্নয়ন কর্মকা- গতিশীল করার প্রথম উদ্যোগ নেন বগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল মান্নান। মূলত তার চেষ্টাতেই নদী রক্ষার প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়। এই বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ জানান, ২১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীপথের মধ্যে গাইবান্ধা সীমানায় ২৪ কিলোমিটার, বগুড়া সীমানায় ৯৯ কিলোমিটার, সিরাজগঞ্জে ৯৪ কিলোমিটার অংশ ড্রেজিং করা হবে। এর সঙ্গে ভাঙনপ্রবণ ৩২টি পয়েন্টে প্রায় ২০ কিলোমিটার, সিরাজগঞ্জের ২২টি পয়েন্টে ১৫ দশমিক ৬০ কিলোমিটার অংশে তীর সংরক্ষণ করা হবে। আরেক সূত্র জানায়, সরকার নদীকে রক্ষা করার দীর্ঘমেয়াদী যে ব দ্বীপ (ডেল্টা) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এর চার নদী রক্ষা প্রকল্প পরবর্তী সময়ে বড় প্রকল্পের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। সোনাতলার বাঙালী তীরের রানীরপাড়া গ্রামের কৃষক বাসেত আলী বললেন, তিনি এই প্রকল্পের কথা শুনেছেন। আনন্দিত এই কারণে যে তারুণ্যে দেখা সেই বাঙালী চোখের সামনেই যে ভাবে মরাগাঙে পরিণত হয়ে গেল সেই নদী ফের জেগে উঠবে। নামাজখালির হরিখালি হাটের কয়েক প্রবীণ দোকানি বললেন ষাটের দশকে ভরা যৌবনা যমুনা বাঙালী নদীর নৌপথ অর্থনৈতিক কর্মকা-ে বড় ভূমিকা রাখত। সেই নদী ফের জেগে উঠবে। নদীপাড়ে জমে উঠবে মেলা। বাঙালীর উন্নত জীবন যাত্রায় নদী যে ভূমিকা রাখে ফের সেই ভূমিকা রাখবে মরাগাঙে জোয়ার আসা নদীগুলো ।
×