ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডেমাগগদের উত্থান

প্রকাশিত: ০৪:১০, ২০ জানুয়ারি ২০১৯

ডেমাগগদের উত্থান

ইউরোপ ও আমেরিকাজুড়ে এখন এক নতুন মতবাদের জোয়ার বইছে। তা হলো পপুলিজম বা জনতুষ্টিবাদের জোয়ার। দেশে দেশে গড়ে উঠেছে জনতুষ্টিবাদী আন্দোলন যার নেতৃত্বে রয়েছেন জনগণের আবেগ জাগ্রত করতে সক্ষম বক্তৃতাবাজ নেতারা। এসব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মনে বিদ্যমান হতাশা-নৈরাজ্য, সংশয়-সন্দেহ আর উৎকণ্ঠার রাজনৈতিক অভিপ্রকাশ ঘটছে- যারা নিজেদের মূলধারার রাজনীতি থেকে পরিত্যক্ত বলে মনে করে এবং সেই সঙ্গে সমাজ, জনমিতি ও অর্থনীতির দ্রুত পরিবর্তন নিয়ে উদ্বিগ্ন। আর এসব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উত্থান ঘটেছে বেশ কিছু লৌহমানবের, যারা তুখোড় বক্তা এবং নিজেদের বক্তৃতার দ্বারা জনতাকে ক্ষেপিয়ে তুলতে যথেষ্ট পারঙ্গম। এমন এক লৌহমানব পোল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জারোস্ল কাজিনস্কি। তিনি ধারণ করে আছেন সেসব বৈশিষ্ট্য যা ইউরোপের অন্যান্য লৌহমানবের মধ্যেও প্রতিফলিত। এরা দক্ষিণপন্থী বাগ্মী জননেতা যারা রক্ষণশীলতা, সনাতনী খ্রীস্টীয় মূল্যবোধ ও জাতীয়তাবাদের সমর্থক, অভিবাসীবিরোধী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি সন্ধিগ্ধ। ইউরোপের আর সকল জনতুষ্টিবাদীর মতো কাজিনস্কি মানুষের আবেগ জাগ্রত করতে অসাধারণ দক্ষ। সমর্থকরা তাকে পোল্যান্ডের স্বাধীনতা ও সত্তার এক আপোসহীন যোদ্ধা হিসেবে দেখে। অন্যদিকে তাঁর বিরোধী উদারপন্থীরা তাঁকে সেকেলে ও বিপজ্জনক বলে গণ্য করে। ইউরোপের লৌহমানবদের মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী, গণতন্ত্রের অবমাননাকারী এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে দুর্নীতির প্রশ্রয়দাতা হিসেবে দেখা হয়। কাজিনস্কির মতো লৌহমানবদের দৃষ্টিতে সমালোচকরা বিশ্বাসঘাতক, ভিন্নমত সর্বনাশা ক্ষতিকর এবং বিরোধী দল জাতিবিরোধী। কাজিনস্কি যেমন পোল্যান্ডে তেমনি হাঙ্গেরীয় প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওবরানও এক লৌহমানবের ভূমিকায় আবির্ভূত। ইনি উদারপন্থী মিডিয়া, বিচারবিভাগ, বিশ্ববিদ্যালয় ও এনজিওগুলোর ওপর চড়াও হয়েছেন। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকারকে খর্ব করেছেন। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের অনেক লৌহমানব তাদের সাবেক কমিউনিস্ট শাসকদের ডিএনএ কার্যত ধারণ করে আছেন। তারপরও গোটা ইউরোপজুড়ে তারা নির্বাচনে জয়লাভ করছেন- যেমন চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া ও রুমানিয়া। তবে বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে বিগত দশকে স্লোভাকিয়া ও চেক প্রজাতন্ত্রে দুর্নীতি বেড়েছে। চেক প্রজাতন্ত্রের বিলিয়নিয়ার থেকে প্রধানমন্ত্রী বনে যাওয়া আন্দ্রেজ বাবিসের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট মিলোস জামান সাংবাদিকদের গৌরব সার ও হায়েনা আখ্যায়িত করেছেন। ইউরোপের কোন সাংবাদিককে হয়ত জামাল খাশোগির ভাগ্য বরণ করতে হবে না। তারপরও দুর্নীতির তথ্যানুসন্ধানকারী সাংবাদিকরা স্লোভাকিয়া ও মাল্টায় আততায়ীর হাতে প্রাণ হারিয়েছে। বুলগেরিয়ায় এক সুন্দরী টিভি রিপোর্টারকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে। সেদেশে সংগঠিত অপরাধের বিস্তার ঘটেছে। জাতীয়তাবাদী লৌহমানবদের উত্থান বিশ্বব্যাপী দেখা দিয়েছে যেমন রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিন, চীনে শি জিনপিং, ভারতে নরেন্দ্র মোদি, তুরস্কে রিসেপ তাইপ এরদোগান, ফিলিপিন্সে রডরিগো দুতার্তে এবং ব্রাজিলে জহির বোলসোনারো। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই লৌহমানবদের উত্থানকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। কারণ, এটা ১৯৩০-এর দশকের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যখন জনগণের অর্থনৈতিক দুর্দশাকে পুঁজি করে উগ্রজাতীয়তাবাদী ও ইহুদী বিদ্বেষী জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে এডলফ হিটলারের উত্থান ঘটেছিল। শত্রুরা সর্বদাই লৌহমানবদের অক্সিজেন হিসেবে কাজ করে। তাদের চারপাশের ভোটারদের ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্যই একটা সুনির্দিষ্ট শত্রু থাকার দরকার হয়। হিটলার ইহুদীদের শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন। এখন তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে অভিবাসীরা। কাজেই ২০১৫ সালে ইউরোপ যখন উদ্বাস্তুর ঢলে ছেয়ে গেল তখন উগ্রজাতীয়তাবাদী ও জনতুষ্টিবাদীরা এই উদ্বাস্তুদের শত্রু হিসেবে জ্ঞান করতে লাগল। শুধু জার্মানিতে নয়, ইউরোপের দেশে দেশে এই অবস্থা হলো। জনতুষ্টিবাদীরা ভীতি ও বিদ্বেষে ইন্ধন জোগাল। কাজিনস্কি এই ভীতি ও বিদ্বেষের কারণ হিসেবে বলেন, ওরা ‘রোগব্যাধি ও পরজীবী নিয়ে আসে।’ ওবরান ইসলামফোবিয়ার দোহাই পারলেন। জার্মান পত্রিকা ‘বাইল্ড’ এর সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে ওবরান বলেন, আমরা এসব লোককে মুসলমান উদ্বাস্তু হিসেবে দেখি না, দেখি মুসলিম হানাদার হিসেবে। উদ্বাস্তু সঙ্কট জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, অস্ট্রিয়া, নেদারল্যান্ডস ও সুইডেন তথা উদারপন্থী ইউরোপজুড়ে চরম দক্ষিণপন্থী আন্দোলনগুলোকে উর্বর করে তুলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদী ও জনতুষ্টিবাদীদের আরেক শত্রু। ইউরোপজুড়ে এসব গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এমন হতাশা বিদ্যমান যে ইইউ আমলাতন্ত্রের সদর দফতর ব্রাসেলস তাদের জাতীয় স্বাধীনতা হরণ করছে, নিয়ম-কানুন চাপিয়ে দিচ্ছে এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে নাক গলিয়ে তাদের দুর্ভোগ ডেকে আনছে। ‘বিদেশী শত্রু’ বরাবরই জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার একটা শক্তিশালী ইস্যু। কথাটা বিশেষভাবে সত্য সেই দেশগুলোতে যারা শত শত বছর অস্ট্রো-হাঙ্গেরী, প্রুশিয়া ও পরে রাশিয়ার দ্বারা পদানত থেকেছিল। এখন এ দেশগুলো ইইউকে বাইরের শক্তিশালী, আধিপত্যকারী শক্তি হিসেবে দেখছে। তাই চরম দক্ষিণপন্থী লীগ ও এস্টাবলিশমেন্টবিরোধী ফাইভ স্টার মুভমেন্ট সমন্বয়ে গঠিত ইতালির নয়া কোয়ালিশন সরকার ইইউর সঙ্গে বড় ধরনের বিবাদে লিপ্ত। উপ-প্রধানমন্ত্রী মাত্তিও সালভিনি ইইউর নেতাদের ইউরোপের জনগণের শত্রু আখ্যায়িত করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে ইউরোপের লোকেরা কেন এসব জনতুষ্টিবাদীকে নির্বাচিত করছে? এর একটা বড় কারণ ইউরোপজুড়ে ভোটাররা দেখছে যে ইউরোজোনের অর্থনৈতিক ও ঋণ সঙ্কটের জন্য যারা দায়ী সেই ব্যাংক, বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও অর্থলগ্নিকারকদের সরকারগুলো নানান কর্মসূচীর মাধ্যমে সঙ্কট থেকে উদ্ধার করছে আর অন্যদিকে ব্যয়সঙ্কোচ ও গণহারে ছাঁটাইয়ের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে শাস্তি দিচ্ছে। ইউরোপে সবচেয়ে বড় অসন্তোষ হচ্ছে জীবনযাত্রার মান স্থবির হয়ে থাকা যার জন্য তরুণরা তাদের বাবা মায়েদের জীবনধারার সমকক্ষতা অর্জন করতে পারছে না। তদুপরি বিশিল্পায়ন, আউটসোর্সিং ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে মানুষ চাকরি হারাচ্ছে। বিশ্বায়নের সুবিধা থেকে যারা ফায়দা লুটেছে এবং যারা বঞ্চিত হয়েছে তাদের মধ্যে অসাম্য বাড়ছে। শহরের এলিট শ্রেণী ও গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে। এর পরিণতিতে মূলধারার রাজনীতিকদের ওপর জনগণের আস্থা উবে গেছে। নতুন রাজনৈতিক মত ও পথের দল ও মানুষদের সন্ধান করতে গিয়ে তাদের ক্রোধ, অবিচার থেকে উদ্ভূত ক্ষোভ এবং ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কাবোধ চারটি দিকে চরম বাম পরিবেশবাদী, চরম ডান এবং এস্টাবলিশমেন্ট নিরোধী দলগুলোর দিকে ধাবিত হয়েছে। জার্মানির সাম্প্রতিক ব্যাভেরিয়ান নির্বাচনই তার প্রমাণ। সেই নির্বাচনে স্থানীয় শাসক রক্ষণশীল দলের বড় ধরনের বিপর্যয় হয়েছে এবং পরিবেশবাদী দল ও চরম দক্ষিণপন্থী ‘অলটারনেটিভ ফর জার্মানি’ দলের বড় বিজয় হয়েছে। তবে ইউরোপের একজন নেতা যিনি জনতুষ্টিবাদের ধারা এড়িয়ে যেতে পেরেছেন তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো। গত বছর ফ্রান্সের নির্বাচনে মধ্যপন্থী ম্যাক্রো চমকপ্রদ বিজয় অর্জন করেন। তবে এক বছরের মধ্যে তার জনপ্রিয়তায় ধস নেমে ৩০ শতাংশেরও নিচে এসে দাঁড়ায়। কারণ, জনগণ ইতোমধ্যে দেখতে পায় যে তিনি ধনীদের পক্ষে। আজ ফ্রান্সের রাজপথ উত্তপ্ত। বিভিন্ন ইস্যুতে শত শত ধর্মঘট হচ্ছে। কোন কোনটি সহিংস রূপ ধারণ করেছে। ম্যাক্রো দারুণ রকমের জাতীয়তাবাদ বিরোধী। তার এই বিরোধিতার উৎপত্তি ফ্যাসিবাদ ও নাৎসীবাদের ভয়াবহ বিপর্যয়কর পরিণতি থেকে। তবে দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধ, হিটলারী ও সোভিয়েত আগ্রাসন ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা বহন করেছে। পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র ও লিথুয়ানিয়ায় জাতীয়তাবাদ বিদেশী দখলদারী থেকে মুক্তি লাভের সংগ্রামে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। জাতীয়তাবাদই বেশ কয়েকটি দেশকে সোভিয়েত শিবির থেকে সবকিছু ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। প্রমাণ করেছে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যেই মুক্তির চেতনা নিহিত। তবে আজকের জাতীয়তাবাদীরা মনে করে যে, বহু জাতিভিত্তিক এলিটবাদী, আমলাতান্ত্রিক ও নব্য সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ক্ষতি সাধন করে আন্তর্জাতিক ধনিক শ্রেণীকে লাভবান করে তোলা হয়। ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদীরা আমেরিকার স্বঘোষিত জাতীয়তাবাদী ডোনাল্ড ট্রাম্পের তরফ থেকে বৈধতা লাভ করেছে ও তার দৃষ্টান্ত থেকে নিজেরা জোরদার হয়েছে। ট্রাম্পের মিত্র ও সাবেক হোয়াইট হাউস কর্মকর্তা স্টিভ বেনন গোটা ইউরোপ সফর করে জাতীয় জনতুষ্টিবাদকে বেগবান করে তুলছেন। জার্মানিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রিচার্ড গ্রেনেল বলেছেন, সমাজতান্ত্রিক নীতিগুলো ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষাপটে ইউরোপের দক্ষিণপন্থী জনতুষ্টিবাদীরা যাতে জেগে উঠতে পারে তার জন্য তিনি তাদের ক্ষমতায়ন করতে চান। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থানের পাশাপাশি জার্মানি ও ইতালির মতো দেশগুলোতে স্থানীয় পুলিশও উগ্রতা ও বর্ণগত গোঁড়ামি প্রদর্শন করছে। ইউরোপের মূলধারার রাজনৈতিক নেতারা জনতুষ্টিবাদী লৌহমানবদের ঘৃণার চোখে দেখে। তাদেরকে বিপজ্জনক, বাস্তবতাবিবর্জিত বলে মনে করে যাদের কাজ শুধু জনতাকে ক্ষেপিয়ে তোলা। অথচ এটাও ঠিক যে জনমনের হতাশা, নৈরাশ্য এবং সন্দেহ অবিশ্বাসের ছাইচাপা আগুন থেকে এসব লৌহমানবের উত্থান ঘটেছে। এরা সাফল্যের সঙ্গে আবেগ সঞ্চার করতে পারলেও বিশ্বাসযোগ্য কোন অর্থনৈতিক বিকল্প উপস্থাপন করতে পারেননি। তথাপি সন্দেহ নেই জাতীয় জনতুষ্টিবাদ ইউরোপে শিকড় গেড়েছে। এটা টিকে থাকবে এবং দীর্ঘদিন ধরে ইউরোপের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হয়ে থাকবে। সূত্র : দি উইক
×