ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাংবাদিকদের জানালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

চিহ্নিত ইয়াবা কারবারিরা আত্মসমর্পণ করতে কক্সবাজারে জড়ো হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

 চিহ্নিত ইয়াবা কারবারিরা আত্মসমর্পণ করতে কক্সবাজারে জড়ো হচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, চলমান মাদক বিরোধী অভিযানের মধ্যে চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত ইয়াবা চোরাকারবারিরা আত্মসমর্পণের জন্য কক্সবাজার শহরে জড়ো হচ্ছে। এ মাসের শেষেই তাদের আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা সারা হতে পারে। শুক্রবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান, আমি তাদের (পুলিশ) বলেছি, এরা (ইয়াবা কারবারি) কারা, তাদের আইডেনটিটি যেন রেডি করে রাখে। আমরা ৩০ তারিখ অথবা ফেব্রুয়ারি প্রথম সপ্তাহে যে কোন একদিন যাব। কী ধরনের শর্তে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানান, স্বাভাবিক জীবনে না এলে মামলা চলবে। আর স্বাভাবিক জীবনে গেলে এদের মামলা আমরা দেখব। ইয়াবা পাচার করে বিপুল অর্থের মালিক হওয়া ব্যক্তিরা আত্মসমর্পণ করলে তাদের অবৈধ সম্পদ বৈধতা পাবে কিনা- এমন প্রশ্নের সরাসরি কোন উত্তর মন্ত্রী দেননি। তিনি বলেন, সম্পদের বিষয়- এটা দুদক বা এনবিআর দেখবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গতবছর মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে সন্দেহভাজন মাদক কারবারিদের হতাহতের খবর এসেছে। তবে মাদক কারবারিদের তৎপরতা পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। নির্বাচনের পর নতুন বছরের শুরুতে আবারও সারাদেশে ইয়াবা কারবারিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে। এরই মধ্যে আতংকে কক্সবাজারের চিহ্নিত মাদক পাচারকারীদের একটি অংশ পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের আগ্রহ জানায়। এরপরই ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের সুযোগ নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা শুরু হয়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে থাকে। এর মধ্যে টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এনামুল হক গত ১৫ জানুয়ারি ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পণের কথা জানালে বিষয়টি আলোচনার জন্ম দেয়। এই বিষয়ে আকার পেতে শুরু করে। অভিযোগ রয়েছে, তার মত শতাধিক ‘তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী‘ ইতোমধ্যে কক্সবাজার শহরের কোন এক স্থানে জড়ো হয়ে ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ এসেছেন। এ ব্যাপারে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বেশ কয়েকজন ইয়াবা ব্যবসায়ীর সঙ্গে পুলিশের যোগাযোগ হয়েছে। তারা নিজেরাই যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে আলোচনা চলছে বলে তাদের অবহিত করেছি। তবে তিনি দাবি করেন, কক্সবাজারে জড়ো হওয়া ইয়াবা চোরাকারবারিদের পুলিশ হেফাজতে থাকার তথ্য সঠিক নয়। তারা নিজেরাই যোগাযোগের মাধ্যমে সমন্বিত হয়েছেন বলে পুলিশ জানতে পেরেছে। তারা কক্সবাজার শহরের একটি স্থানে জড়ো হয়ে নিজেদের উদ্যোগে হেফাজতে রয়েছেন। আত্মসমর্পণের ঘোষণা ফেসবুকে ॥ টেকনাফ উপজেলার সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এনামুল হক গত মঙ্গলবার ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পণের কথা জানান। ফেসবুকে ওই পোস্টে ’প্রিয় মাতৃভূমি টেকনাফবাসী’ সম্বোধন করে তিনি লেখেন, “আত্মসমর্পণের জন্য আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করছি।” এই যাত্রায় টেকনাফ থানা পুলিশ এবং একজন স্থানীয় সাংবাদিক সঙ্গে থাকার কথাও এনামুল ওই পোস্টে জানান। এনামুল হকের বড় ভাই নুরুল হকের বলেন, টেকনাফের স্থানীয় এক সাংবাদিকের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের ব্যাপারে প্রশাসনের সঙ্গে এনামুলের যোগাযোগ ঘটে। আলাপ আলোচনার পর গত মঙ্গলবার বিকেলে এনামুল আত্মসমর্পণের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। নুরুল হক বলেন, বিভিন্ন মারফতে শুনে মনে হয়েছে কক্সবাজার শহরের পুলিশ লাইনস এলাকার কোথাও রাখা হয়েছে ছোট ভাই এনামুলকে। সে পুলিশের নিরাপদ হেফাজতে আছে। নুরুল হক আরও জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদক বিরোধী অভিযানের সময় অপরাধীদের তালিকায় এনামুলের নাম আসার কথা জানতে পেরে পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তারাই এনামুলকে বুঝিয়ে আত্মসমর্পণে রাজি করিয়েছেন। এ ব্যাপারে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, টেকনাফের ইউপি সদস্য এনামুল হক একজন তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী। ইয়াবা পাচারসহ নানা অভিযোগে টেকনাফ থানায় তার বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা রয়েছে। যেভাবে ইয়াবা পাচার হয় ॥ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মিয়ানমার থেকে আসা নেশার বড়ি ইয়াবা মূলত কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকা দিয়েই বাংলাদেশে ঢোকে। এই পথে অন্যান্য মাদকও আসে। জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি সর্বশেষ তালিকায় থাকা চিহ্নিত ইয়াবা পাচারকারীদের ১ হাজার ১৫১ জন কক্সবাজারের। তাদের মধ্যে ৭৩ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী’ হিসেবে। এই ‘শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের’ একটি বড় অংশের বসবাস টেকনাফ উপজেলায়। তাদের সবাই কম বেশি প্রভাবশালী, কেউ কেউ আবার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। পুলিশ সুপার বলেন, গত বছর ২০ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মহেশখালীতে ৪৩ জন জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের বিষয়টি সম্ভব হয়েছিল ‘চ্যানেল-২৪’- এর সাংবাদিক আকরাম হোসাইনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হওয়ার পর। ওই জলদস্যুরা এখন কক্সবাজার কারাগারে বন্দি আছেন। মাসখানেক আগে তাদের খোঁজ খবর নিতে কারাগারে গিয়েছিলেন সাংবাদিক আকরাম। তখন ইয়াবা মামলার কয়েকজন আসামির সঙ্গে আকরামের পরিচয় হয়। তাদের কাছেই আকরাম খবর পান, মাদক চোরাকারবারিদের একটি অংশ জলদস্যুদের মত আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চায়। আকরাম পরে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের জানান। এরপর পুলিশের মধ্যেও এ বিষয়ে তৎপরতা শুরু হয়। পুলিশ সুপার মাসুদ বলেন, ইয়াবা চোরাকারবারিদের কাছ থেকে আত্মসমর্পণের ‘প্রস্তাব’ পাওয়ার পর বিষয়টি তারা উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানান। এখন নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা সারা হবে। প্রক্রিয়াটি দ্রুতই শুরু হবে বলে আমরা আশা করছি। আত্মসমর্পণে সম্মত ইয়াবা চোরাকারবারিদের একটি অংশের কক্সবাজার শহরে জড়ো হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে চ্যানেল-২৪ এর সাংবাদিক আকরাম হোসাইন বলেন, প্রশাসনের সঙ্গে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের প্রতিদিনই যোগাযোগ হচ্ছে। এই ব্যবসায়ীরা নিজেরাই নিরাপদ হেফাজতে আসার ব্যাপারে সম্মতি প্রকাশ করেছেন। ইতোমধ্যে অনেকে নিরাপদ হেফাজতে এসেছেন। তবে সেই সংখ্যা কত, আর তারা কাদের হেফাজতে রয়েছে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি সাংবাদিক আকরাম। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে এ নিয়ে সঠিক কোন তথ্য জানানো হয়নি। তবে নানা মাধ্যমে পাওয়া খবরে এ পর্যন্ত শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ীর আত্মসমর্পণে সম্মত হওয়ার এবং সংশ্লিষ্টদের কাছে নিরাপদ হেফাজতে আসার কথা জানতে পেরেছি।
×