ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

চার চ্যালেঞ্জ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন নতুন বিমান প্রতিমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:১২, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

   চার চ্যালেঞ্জ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন নতুন বিমান প্রতিমন্ত্রী

আজাদ সুলায়মান ॥ চার কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছেন নবনিযুক্ত বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট মাহবুব আলী। সিভিল এ্যাভিয়েশনের ক্যাটাগরি উন্নীত করে নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালু, বিমানের সিডিউল রক্ষা করে লোকসান ঠেকানো, বিমানবন্দরে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করা ও সর্বোপরি ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হওয়া বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডকে গতিশীল করে বিদেশী পর্যটক আনা। এ চারটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে গত এক যুগ ধরে কোন বিমানমন্ত্রীই তেমন কিছু একটা করতে পারেননি। দায়িত্ব নেয়ার আগে সবাই শুধু মুখে মুখে আশ্বাস দিয়ে গেছেন। বিদায় বেলায় সব চ্যালেঞ্জ থেকেই গেছে। বর্তমান বিমানমন্ত্রী মাহবুব আলীও দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দিনেই জনকণ্ঠে প্রতিনিধির প্রশ্নের জবাবে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই উচ্চারণ করেছেন, এগুলো করতে হবে, পারতে হবে। ফেল করা যাবে না। সবার সহযোগিতা পেলে অবশ্যই এ সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। উল্লেখ্য, মাহবুব আলীর পূর্বসূরি একেএম শাহজাহান কামাল গত বছরের জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে বিমানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরদিনই জনকণ্ঠের এ ধরনের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, এসব দায়িত্ব তার কাছে পানির মতো। তিনি অন্য মন্ত্রীর চেয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেছিলেন, রক্ত দিয়ে হলেও বিমান ঠিক করবেন। তার পূর্বসূরি অপর বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন দায়িত্ব নেয়ার আগেই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন-বিমানকে লাভজনক করা, বিমানবন্দরে যাত্রীসেবা আসলেই কঠিন। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে- বতর্মান বিমানমন্ত্রীর সামনে সবচেয়ে কঠিন চালেঞ্জ হচ্ছে- বর্তমান সিভিল এভিয়েশনকে ক্যাটাগরি-১ থেকে ২-এ উন্নীত করে নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালু করা। সিভিল এভিয়েশনকে শীঘ্রই ক্যাটাগরি-১ এ উন্নীত করার বিষয়টি এখনও সুদূর পরাহত। যদিও আইকাও এবং এফএএ আরোপিত একের পর এক শর্তাদি অনেক পূরণ করা হয়েছে। আরও কিছু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সামনে রয়েছে এফএএ অডিট। সেই অডিটের জন্য প্রস্তুত সিভিল এভিয়েশন। পরিচালক (এফএসআর) উইং কমান্ডার চৌধুরী জিয়াউল কবির বলেছেন, সর্বশেষ অগ্রগতি জানাতে-আমরাই এখন ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সেখানে গিয়েই আমরা তাদের প্রেজেন্টেশন দেব। তারপর এফএএ টিম এসে দেখে যাবে। তখন তারা চূড়ান্ত অডিট করার জন্য একটা ডেট দেবে। যা হয়তো আগামী জুন- জুলাইয়ের দিকে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা অবশ্য একই সঙ্গে ফাইনাল অডিটের সিডিউলের জন্যও আবেদন করে রাখব। জানা গেছে, ক্যাটাগরি-১ না হওয়া পর্যন্ত বিমানের নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালু করার আবেদনই করা যাবে না। তারপর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ইতিবাচক মনোভাব থাকলেই কেবল তা এই স্বপ্নপূরণ হতে পারে। নতুন বিমানমন্ত্রী মাহবুব আলীকে এমনই কঠিন চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন করতে হবে। কেননা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে মনেপ্রাণে চান নিউইয়র্ক ফ্লাইটের স্বপ্নপূরণ করতে। দ্বিতীয়ত চ্যালেঞ্জ বিমানের লোকসান ঠেকিয়ে সিডিউল রক্ষা করা। এটাও কঠিন কাজ। যুগ যুগ ধরেই এ দুটি কঠিন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে প্রতিটি বিমান মন্ত্রীকে। এখনও বিমানের সিডিউল রয়ে গেছে আগের মতো। এখনও বিমানের ফ্লাইট সিডিউলের অন টাইম পারফর্মেন্স (ওটিপি) ও লাগেজ ডেলিভারি নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে বিমানকে। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত অভিযোগ থাকছেই। সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তির অভিযোগের শেষ নেই। গত পাঁচ বছর ধরে এমন সব অভিযোগে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েই সাবেক বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন তার অনুসারী বিমানমন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামালকে বলেছিলেন, বিমান নিয়ে গালি খেতে হয়। এটা একটা আগুন। প্রতি উত্তরে একেএম শাহজাহান কামাল আগুনকে পানি করা ও বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে বিমানকে ঠিক করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেন। অপ্রিয় হলেও সত্য তিনিও তেমন কিছু করতে পারেননি। তিনি যে নায় মাস দায়িত্বে ছিলেন- তার সবটাই ছিল লোকসানে জর্জরিত। এখনও বিমানের সিডিউলের অবস্থা মানসম্মত নয়। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ রুটের সিডিউল তছনছ হয়ে গেছে। তিনটি ড্যাশ-৮ এর মধ্যে একটা প্রায়ই যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ায় অভ্যন্তরীণ রুটে সিডিউল বিপর্যয় নিত্য বিষয়। আন্তর্জাতিক রুটেরও একই অবস্থা। কিভাবে তা সামাল দেয়া যাবে- এই সঙ্কট তা নতুন মন্ত্রীকেই খোঁজে বের করতে হবে। যদি কোন ধরনের লজিস্টিক সাপোর্টের ঘাটতি থাকে, যদি জনবলের ঘাটতি থাকে সেটাও পূরণ করার দায়িত্ব মন্ত্রীকেই করতে হবে। একইভাবে দুবছর লাভ করার পর হঠাৎ কেন লোকসানের মুখে পড়েছে বিমান সেটার রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে। এ বিষয়ে মাহবুব আলী বলেছেন, অবশ্যই পারতে হবে। বিমান সম্পর্কে মানুষের কনসেপসান চেঞ্জ করতে হবে। আমি এ বিষয়ে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেব। একইভাবে বর্তমানে লাগেজ ব্যবস্থাপনার কিছুটা উন্নতি হলেও দৃশ্যত সেটা একমুখী। আইকাও রুলস অনুযায়ী জাহাজ অবতরণের ২০ মিনিটের মধ্যে প্রথম লাগেজ ডেলিভারি দেয়ার বিষয়টি বিমান নিশ্চিত করতে পারছে বলে দাবি করেছেন মহাব্যবস্থাপক নুরুল ইসলাম হাওলাদার। তিনি বলেছেন- লাগেজ ডেলিভারির অনটাইম পারফর্মেন্স আইকাও রুলস অনুযায়ী হচ্ছে। এবং চলতি মাসের এ কদিনেও গড়ে ৯০ শতাংশের বেশি ওটিপি রয়েছে। এ বিষয়ে একটি বিদেশী এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার বলেন, লাগেজ ডেলিভারিতে বিমান নতুন কৌশল নিয়েছে। উড়োজাহাজ অবতরণের পর প্রথম একটা দুটো লাগেজ ২০ মিনিটে দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারপর আর লাগেজ মিলছে না। শেষ লাগেজ পেতে ঠিকই ২ ঘণ্টা লাগছে। তৃতীয়ত বিমানবন্দরে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ অন্যগুলোর আধুনিকায়ন ও অবকাঠামোগত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। অবশ্য দায়িত্ব নেয়ার পর পরই মাহবুব আলী সরেজমিনে শাহজালাল পরিদর্শন করে বেশ কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। চতুর্থ চ্যালেঞ্জ- পর্যটন। মন্ত্রীর সামনে রয়েছে পর্যটন সেক্টরের দৈন্যদশা। গত দশ বছরে পর্যটন খাতের তেমন কোন অগ্রগতি ঘটেনি। মন্ত্রী এসেছে, মন্ত্রী গেছে-পর্যটন রয়ে গেছে সেই আগের আগের জায়গায় অর্থাৎ যেই তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই। গত বছর ছিল পর্যটন বর্ষের শেষ বছর। ২০১৬ সালে তিন বছরব্যাপী পর্যটন বর্ষ ঘোষণা দেয়া হলেও এ সেক্টরের দেশী-বিদেশী পর্যটকের সংখ্যা তেমন আশানুরূপ হয়নি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড (বিটিবি) তেমন কোন কার্যক্রম নিতে পারেনি। রেগুলেটর বডি হিসেবে কোন দিক নির্দেশনাও দিতে পারছে না। উপরন্তু দুর্নীতি আর অপচয়ের মাধ্যমে এটি ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। সরকার সামান্য যে কিছু বাজেট বরাদ্দ দেয়, সেটাও পর্যটন বিকাশে সঠিক খাতে ব্যয় করতে পারছে না। ভুঁইফোঁড় কিছু সংগঠনকে সহায়তা প্রদানের অজুহাতে লাখ লাখ টাকা লুটপাট ছাড়া আর কোন অবদান রাখতে পারছে না বিটিবি। কেন পর্যটন খাতের এহেন দৈন্যতা জানতে চাইলে পর্যটক বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট বোর্ডের কি কাজ, কি তার দায়িত্ব- পর্যটন কর্পোরেশনকে কিভাবে প্রমোট করতে হবে কিভাবে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনার পর্যটন খাতকে তুলে ধরতে হবে সে বিষয়ে কারোর কোন মাথাব্যথা নেই। কোন দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতাও নেই। এ সব বিষয়ে নতুন মন্ত্রীকেই ভাবতে হবে তার মতো করে। প্রয়োজনে দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে রাফ এ্যান্ড টাফ ডিসিসন নিতে হবে। এ সব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী বলেছেন, চ্যালেঞ্জ কোনটার চেয়েই কোনটা কম নয়। বিএনপি -জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের শেষের দিকে বিমানের নিউইয়র্ক ফ্লাইট বন্ধ করা হয়। সেটা ছিল একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তারপর এক যুগ চলে গেছে-আজও নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালু করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে বিমানের লোকসান ঠেকিয়ে সিডিউল রক্ষা করা ও পর্যটন খাতকে চাঙ্গা করার মতো ইস্যু গত এক যুগে খুব একটা আগায়নি। যেই তিমিরেই ছিল- সেই রয়ে গেছে এ সেক্টর। বিমানের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে হলে বিমানকে পুনর্গঠন করতে হবে। এভিয়েশন বুঝে এমন পেশাদার নিয়ে একটা শক্তিশালী পর্ষদ গঠন করতে হবে। এমন কঠিন চ্যালেঞ্জ হাতে নিয়ে মাহবুব আলী দায়িত্ব নিয়েছেন। তাকে এসব মোকাবেলা করতে হলে অবশ্যই গতানুগতিক চিন্তা ধারা ও কর্মপদ্ধতি পরিহার করে সময়োপযোগী দীর্ঘ ও স্বলমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। মন্ত্রী হিসেবে তাকে নতুনত্ব আনতে হবে প্রতিটি এসাইনমেন্টে। মন্ত্রীর দায়িত্ব শুধু সরকারী চাকরির মতো নয়টা পাঁচট পর্যন্ত অফিস করা আর ফিতা কাটা নয়। তাকে অবশ্যই একজন ভাল অপারেশনাল সিইও-এর মতো সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দিক-নির্দেশনা দিতে হবে। প্রয়োজনে আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধতা ডিঙ্গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ওয়ান টু ওয়ান কথা বলে প্রকৃত সমস্যা কোথায় সেটা তুলে ধরতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস- যত কঠিন সমস্যাই হোক না কেন, তা যদি প্রধানমন্ত্রীকে বুঝানো যায়- তিনি অবশ্যই এসব সমাধানে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না। দূরদর্শিতা ও সৎ সাহসিকতা থাকলে অবশ্যই একজন মন্ত্রীর পক্ষে তা করা সম্ভব। এই চ্যালেঞ্জ কিভাবে মোকাবেলা করেন নতুন প্রতিমন্ত্রী সেটাই এখন দেখার বিষয়।
×