ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জনবল সঙ্কটে প্রয়োজনীয় যাত্রীসেবা দিতে পারছে না রেল

প্রকাশিত: ০৫:১২, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

জনবল সঙ্কটে প্রয়োজনীয়  যাত্রীসেবা দিতে  পারছে না রেল

মশিউর রহমান খান ॥ বাংলাদেশ রেলওয়েতে কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে দায়ের করা সব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। জনবল কম থাকা সৃষ্ট যাত্রীসেবা প্রদানের চলমান প্রবল জনবল সংকট কাটিয়ে উঠতেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নতুন রেলপথ মন্ত্রী শপথ নিয়েই এ বিষয় দ্রুত সমাধানের লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করছেন। সারাদেশে বিভিন্ন সময়ে নিয়োগের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট ও সুপ্রীমকোর্টে প্রায় চল্লিশটির বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সূত্র মতে, বিভিন্ন শ্রেণীর মোট ৯৯ ক্যাটাগরির পদে জনবল নিয়োগের জন্য মঞ্জুরি দেয়া হলেও শুধুমাত্র আদালতে মামলা থাকায় আইনী জটিলতা দূর না হওয়ায় পদগুলোর জনবল নিয়োগ দিতে পারছে না রেলওয়ে। গত ৫ বছরে শুধুমাত্র পশ্চিমাঞ্চলেই নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৩২। বিভিন্ন সময়ে দায়ের এসব মামলায় মোট বাদী ১১শ’ ৬১। তারা সবাই টিএলআর হিসেবে রেলে অস্থায়ী শ্রমিক পদে কর্মরত রয়েছেন। সূত্র জানায়, রেলে অধিক যাত্রীসেবা নিশ্চিতে মন্ত্রীর সরাসরি পরামর্শে এসব মামলা পরিচালনা করা হবে। এমনকি কোন কোন মামলায় রেলওয়ের স্বার্থে প্রয়োজনে মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন নিজেও আইনজীবী হিসেবে আদালতে মামলায় লড়বেন বলে জানা গেছে। নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে হাইকোর্ট বা সুপ্রীমকোর্টে থাকা সব মামলা বা রিট দায়েরের দ্রুত সমাধানের করণীয় খুঁজে বের করে তাড়াতাড়ি তা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। রেল মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, রেলপথমন্ত্রী নিজে আইনজীবী। মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই রেলওয়েকে যাত্রীবান্ধব ও জনগণের আস্থার বাহনে পরিণত করতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করবেন বলে ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে যাত্রীদের দুর্নীতমুক্ত সেবা দিতে হবে বলে আশ্বাস দেন। এরই অংশ হিসেবে প্রথমেই তিনি রেলওয়ের জনবল সংকটকে সমাধানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রেলপথ মন্ত্রীর মতে, প্রতিটি স্টেশনে ও প্রতিটি রেলওয়ের অফিসে শুধুমাত্র জনবল সংকটের কারণে যাত্রীদের প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ সেবা প্রদান করতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ। এমনকি রেলস্টেশনে টিকেট থাকা সত্ত্বেও জনবল সঙ্কটে কম সময়ে যাত্রীসেবা দেয়া সম্ভব হয় না। বিষয়টি মন্ত্রীর নজরে আসায় বিশেষ করে ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ কার্যক্রম চালু করতে বিভিন্ন সময়ে দায়ের মামলার তালিকা চেয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের আইন কর্মকর্তাদের ডেকে পাঠান। এরই অংশ হিসেবে মামলার তালিকা তৈরি করে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে কোন কোন মামলা রয়েছে তার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে ও করণীয় নির্ধারণ করতে আদালত অনুযায়ী মামলার তালিকা তৈরি করেছেন মন্ত্রী। একইসঙ্গে মামলা দায়েরকারীদের সম্পর্কেও তথ্য জোগাড় করছেন তিনি। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রেলপথ মন্ত্রী কোন কোন অভিযোগে ও কারা এসব মামলা দায়ের করেছেন, এমনকি কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট দলের লোকজন কর্তৃক সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড বন্ধ করতে বা রেলওয়েকে অচল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করতে, যোগাযোগ খাতের বেসরকারী কোন পরিবহন সংস্থাকে অবৈধ সুবিধা দিতে বা বিএনপি জামায়াত দলীয় লোকজন সরকারের সাফল্যকে বাধা দিতেও এসব মামলায় দীর্ঘসূত্রতার পেছনে ইন্ধন যোগাচ্ছেন কি না তাও খতিয়ে দেখছেন। তবে এর বাইরে কোন যৌক্তিক কারণে বা নিয়োগে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়ায় কোন কর্মকর্তা কর্মচারীর জড়িত থাকার প্রমাণ পেলে বা মামলার দীর্ঘসূত্রতায় তারা জড়িত থাকলে কিংবা মামলা পরিচালনায় অবহেলা থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেয়া হবে বলে জানান মন্ত্রী। রেলসূত্র জানায়, রেলওয়েতে বর্তমানে প্রায় ৪১ হাজার কর্মীর চাহিদার বিপরীতে বর্তমানে মাত্র ২৫ হাজার ৯২ কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছেন। এর মধ্যে প্রতি মাসেই বেশ কিছু কর্মকর্তা কর্মচারী অবসর গ্রহণ করছেন। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম কর্মী দিয়ে কোনমতেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সেবাদানকারী এ সংস্থাটি। সংস্থাটির আইন শাখা সূত্রে জানা গেছে, ’১২ সালের ডিসেম্বরে এবং ১৩ সালের জুলাইয়ে গেট কীপার ইঞ্জিনিয়ারিং পদে ১৬৯ জন লোকবল নিয়োগের জন্য পৃথক দুটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রদান করে। পরে টিএলআর হিসেবে কর্মরত রেলওয়ের অস্থায়ী ২৪১ শ্রমিক উচ্চ আদালতে গিয়ে বারোটি রিট পিটিশন দায়ের করেন। পরবর্তীতে রেলওয়ের শ্রমিকদের পক্ষে উচ্চ আদালত রায় প্রদান করেন। অপরদিকে প্রথম আটটি মামলার রায়ের বিরুদ্ধে আপীল বিভাগে যায় রেলওয়ে। পরে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকায় রায় ও আদেশ মোতাবেক পিটিশনারদের আত্তীকরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। যা বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানা গেছে। বাকি ৪টি মামলার মধ্যে একটি মামলা আপীলের প্রস্তুতি চলছে ও বাকি তিনটি মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানা গেছে। ’১৩ সালের জুলাইয়ে গেট কিপার ট্রাফিক পদে ২৬৩ লোক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে এতেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় টিএলআর শ্রমিকরা। এর বিপরীতে মোট ৬১১ শ্রমিক বাদী হয়ে হাইকোর্টে তেরোটি পিটিশন দায়ের করেন, যা পরিবর্তীতে মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। এইসব মামলায়ও টিএলআর শ্রমিকরা জয়ী হন। এ নিয়ে রেলওয়ে হাইকোর্টে গেলেও আগের রায় বহাল রাখে আদালত। ফলে পিটিশনকারীদের আত্তীকরণের কাজ চলছে। অপরদিকে ’১৫ সালের ১২ মে ওয়েম্যান পদে ১ হাজার ১১৩ পদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সংস্থাটি। এর আলোকে ওই বছরের ১২ থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত পশ্চিমাঞ্চলের পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষাও সম্পন্ন করা হয়। কিন্তু এর ২৮৬ জন টিএলআর শ্রমিকরা দশটি রিট পিটিশন দাখিল করলে সে নিয়োগও আটকে যায়। এসব মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের শেষ দিকে পোর্টার হিসেবে ৯১ পোর্টার নিতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়। তখনও নিয়োগ প্রক্রিয়াটি আটকাতে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করা হয়। অপররদিকে এ নিয়ে প্রার্থীদের পরীক্ষা শেষে ফলাফল প্রকাশের আগেই হাইকোর্টে স্থগিতাদেশে এই নিয়োগ প্রক্রিয়াটি আটকে যায়। রেল মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, রেলওয়েতে নিয়োগ কার্যক্রম ঠেকাতে টিএলআর হিসেবে কর্মরত অস্থায়ী শ্রমিকরা ’১২ কে ’১৭ সাল পর্যন্ত ১১ ৬১ বাদী মামলা দায়ের করেছে মোট ৩৬। এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে পারলেও কেবল যুগ যুগ ধরে চলে আসা জনবল নিয়োগ সঙ্কট দূর করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান সরকার রেলওয়েকে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। এ লক্ষ্যে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। একইসঙ্গে রেলের উন্নয়নে সারাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে ও বেশ কিছু প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। তবে বর্তমান সরকারের রেলওয়ে মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী উন্নত বিশ্বের ন্যায় যাত্রীবান্ধব রেলওয়ে তৈরিতে বর্তমানে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে জনবল সংকট। শুধুমাত্র উচ্চ আদালতে নিয়োগের বিপরীতে মামলা থাকায় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে সারাদেশে বিভিন্ন সময়ে জনবল নিয়োগের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট ও সুপ্রীমকোর্টে প্রায় চল্লিশের বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণীর মোট ৯৯ ক্যাটাগরির বিপরীতে এসব মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে গত ৫ বছরে রেলওয়ের শুধুমাত্র পশ্চিমাঞ্চলেই নিয়োগ সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৩২। বিভিন্ন সময়ে মোট ১১ ৬১ বাদী এসব মামলা দায়ের করেছেন। যাদের প্রায় সকলেই টিএলআর হিসেবে রেলওয়েতে অস্থায়ী শ্রমিক পদে কর্মরত রয়েছেন। মামলা জটিলতা দূরীকরণ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, যাত্রীদের বর্তমানের চেয়ে আরো অধিক সেবা প্রদান করতে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে হাইকোর্ট বা সুপ্রীমকোর্টে থাকা সকল মামলা বা রিট দায়েরের দ্রুত সমাধানের করণীয় খুঁজে বের করে তাড়াতাড়ি তা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আইনী জটিলতায় হাজার হাজার পদে কোন কর্মকর্তা কর্মচারীর পদ খালি থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বছরের পর বছর ধরে ঝুলছে এসব মামলা। তাই অতি দ্রুত এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে প্রয়োজনে মামলার বাদীসহ সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের সঙ্গে আমরা বসব ও আইনী জটিলতা দূর করে কিভাবে রেলের জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা যায় তার জন্য সব ধরনের চেষ্টা গ্রহণ করা হবে। এরই অংশ হিসেবে মামলার তালিকা তৈরি করে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে কোন কোন মামলা রয়েছে তার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে ও করণীয় নির্ধারণ করতে আদালত অনুযায়ী মামলার তালিকা তৈরি করেছি। একইসঙ্গে মামলা দায়েরকারীদের সম্পর্কেও তথ্য জোগাড় করা হচ্ছে। মন্ত্রী জনকন্ঠকে বলেন, আমি দায়িত্ব নেয়ার পরপরই বিষয়টিকে অতি গুরুত্ব দিয়ে রেলের উন্নয়নের অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে তা দূর করতে আমাদের আইন কর্মকর্তাদের নিয়ে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছি। আশা করি হাইকোর্ট ও সুপ্রীমকোর্টে আইনী লড়াইর মাধ্যমে এসব মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। রেলকে আস্থার বাহন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তিনি মামলা দায়েরকারীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেন।
×