ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুড়ির মোয়া

শীতে বাঙালীর ঘরে ঐতিহ্যের খাবার, স্বাদই আলাদা

প্রকাশিত: ০৫:১০, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

শীতে বাঙালীর ঘরে ঐতিহ্যের খাবার, স্বাদই আলাদা

সমুদ্র হক ॥ চাঁদমহুয়া গ্রামের মুড়ির মোয়ার স্বাদই আলাদা। ঐতিহ্যের মুড়ির মোয়া বাঙালীর ঘরের খাবার। বিশেষ করে শীত মৌসুমে এই মোয়া যেন না খেলেই নয়। সকালে ও বিকেলের নাস্তায় বড় আসন করে নিয়েছে মোয়া। যদিও মুড়ির মোয়া (তরল গুড়ের মধ্যে মুড়ি মিশিয়ে গোলাকৃতি মন্ড) খাওয়ার পর অনেকের মুখের তালু ছিলে যায়। তারপরও কররর করর শব্দে খাওয়ার লোভ সংবরণ করা যায় কি? মজার বিষয় হলো, মুড়ির চাহিদা ভরবছর। মুড়ির মোয়া বা মওয়া (বগুড়ার ভাষায় মলা) বছরের প্রায় অর্ধেক সময়ই তৈরি হয়। দেশের প্রতিটি এলাকায় মুড়ি তৈরি হয়। মুড়ি-মুড়কির কদরও আছে। তবে মুড়ির মোয়া বানানোর বড় এলাকায় পরিণত হয়েছে বগুড়া অঞ্চল। বগুড়ার চাঁদমহুয়া ও আশপাশ গ্রামের নারীদের তৈরি এই মোয়া যাচ্ছে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। নিকট অতীতে মুড়ি তৈরি করত গ্রামের নারী। এ জন্য দরকার হতো এক সঙ্গে জ্বলন্ত দুটি খড়ির চুলা এবং একটি মাটির পাতিল (খোলা) ও মাটির কড়াই। কড়াইয়ে তপ্ত করা হয় চিকন বালি। দু’বার সিদ্ধ করা ধানের চাল মাটির পাতিলে নাড়াচাড়া করে পাশের কড়াইয়ের গরম বালিতে ঢেলে দিলেই ফরফর করে লাফিয়ে মুড়ি তৈরি হতো। বর্তমানে চাল ছাঁটার মিলের মতো মুড়ি তৈরির মিল বসেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। মাঝারি ধরনের এই মিলে প্রতিটি বড় কড়াইয়ে দুই মণ করে চাল ভেজে নেয়ার পর গ্যাসের চুল্লিতে তপ্ত বালির মধ্যে দিলে হলারের হাওয়ায় একদিক দিয়ে মুড়ি বের হয়ে আসে। এই মুড়ি তপ্ত তরল গুড়ে মিশিয়ে দ্রুত শীতল করার পর নারী শ্রমিকরা হাতে গোলাকৃতি ম- বানায়। যার নাম মওয়া, মোয়া বা মলা। বগুড়া সদরের গোকুল ইউনিয়নের একটি গ্রাম চাঁদমহুয়া। লোকমুখে সহজ উচ্চরণে হয়েছে চাঁদমুহা। কিংবদন্তির পৌরাণিক বেহুলা লখিন্দর উপাখ্যানের লখিন্দরের বাড়ি ছিল চাঁদমহুয়া গ্রামে। এই গ্রাম ও আশপাশের হরিপুর হাজরাদীঘি সরলপুর গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে মুড়ির মোয়া তৈরি হচ্ছে। গ্রামগুলো মুড়ির মোয়ার গ্রামে পরিণত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার মহাজনরা মোয়া কিনে নিয়ে যাচ্ছে। মোয়ার গ্রামে গিয়ে দেখা যায়- বাড়ির উঠানে ৩০/৩৫ নারী সারিবদ্ধ বসে বিশাল ধামা থেকে গুড়ে মেশানো মুড়ি দুই হাতের তালুতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মন্ডের মতো গোল করে আরেক ধামায় রাখছে। মাঝে মাঝে পাশে রাখা ছোট পাত্র থেকে সরিষার তেল হাতের তালুতে মেখে নিচ্ছে। বানাবার সময় নারীদের শরীর দুলে উঠে ছন্দ তৈরি করছে। মোয়া এত দ্রুত বানানো হচ্ছে, মনে হবে দুটি করে হাত একেকটি অটো যন্ত্র। এর মধ্যেই নারী কখনও তাল মিলিয়ে গীত গাইছে। আরেকপ্রান্তে মোয়ার প্রাথমিক কাজ চলছে। বড় আকৃতির দুই কড়াইয়ের মধ্যে গুড়ের নালী বা তরল গুড় ঢেলে উনুনে তাপ দেয়া হয়। পরিমাণমতো মুড়ি ফেলে হালকা ঘেটে বড় ধামায় ভরে নেয়া হয় নারী শ্রমিকদের কাছে। তারা মোয়া বানাতে থাকে। মুহূর্তে সমুখে মুড়ির মোয়ার পাহাড় হয়ে যায়। প্যাকেটজাত করে ও পলিবস্তায় ভরে পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। চাঁদমহুয়া গ্রামের সুজন কুমার দাস ও উজ্জ্বল কুমার দাস বললেন,বংশপরম্পরায় তারা মুড়ি ও মোয়া বানাচ্ছে। তাদের বাবা রমানাথ দাসের ছিল মুড়ির ব্যবসা। সেখান থেকে প্রসার ঘটেছে। বছরের শীত মৌসুম শুরুর কিছুটা আগে প্রাথমিক কাজ শুরু হয়। মুড়ি ও তরল গুড় সংগ্রহ করতে থাকে। আশি^নের মধ্যভাগ থেকে ফাল্গুনের মধ্যভাগ পর্যন্ত মোয়া বানানো হয়। এরপর তারা বাঙালীর ঐতিহ্যের মেলার খাবার কদমা,খাজা, চিনির সাঁচ, নিমকি, খাগরাই ইত্যাদি বানিয়ে বিভিন্নস্থানে নিয়ে বেচাকেনা করে। সুজন জানান, প্রতিদিন পাঁচ মণ মুড়ির মোয়া তৈরি করেন। এ জন্য দরকার হয় আখের গুড় অন্তত ৮ মণ। সকাল ন’টা থেকে মোয়া বানানো শুরু হয়ে দুপুরে কিছুটা সময় বিরতির পর বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চলে। প্রথমে চুলায় গুড় তরল করে মুড়ি মেশানো। এর পর ধামায় করে নিয়ে মোয়া বানানো। তারপর বস্তায় ও প্যাকেটে ভরে সরবরাহ। এই কাজে অনেক নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। পাইকার ও মহাজনের লোকজন মিনিট্রাকে মোয়া নিয়ে যায়। স্থানীয় বাজরে মোয়া নেয়া হয় সিএনজি চালিত অটোরিক্সা ও শ্যালোচালিত ভ্যানগাড়িতে। মোয়া বানিয়ে এই এলাকার অনেক পরিবারে দারিদ্র্যতা দূর হয়েছে।
×