ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কিশোরগঞ্জের চ্যাপা শুঁটকি

প্রকাশিত: ০৪:০৮, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

 কিশোরগঞ্জের চ্যাপা শুঁটকি

চ্যাপা শুঁটকি, নাম শুনলেই জিভে জল এসে যায়। কিশোরগঞ্জ তথা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে অতি প্রিয় এক খাবারের নাম চ্যাপা শুঁটকি। চ্যাপা শুঁটকির আঞ্চলিক নাম হিদল। চ্যাপা শুঁটকি মূলত কিশোরগঞ্জে হিদল নামেই পরিচিত। এ অঞ্চলে রসনা বিলাসে শুঁটকি মাছের জুড়ি নেই। আর তা যদি হয় চ্যাপা শুঁটকি তাহলে তো কথাই নেই। সাধারণত চ্যাপা শুঁটকি সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় হাওড়াঞ্চলে। এখানে জেলে জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ সনাতন পদ্ধতিতে মাছ প্রক্রিয়াকরণ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বিভিন্ন জাতের পুঁটি মাছ দিয়েই চ্যাপা শুঁটকি নামক বিশেষ একটি মৎস্যপণ্য উৎপাদন করা হয়। পুঁটি মাছের শুঁটকি এ পণ্য উৎপাদনের মূল কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ পণ্যের প্রস্তুত প্রণালীটাও বৈচিত্র্যময়। সবার পক্ষে তা তৈরি করা সম্ভব হয় না। কেবলমাত্র কিছু সম্প্রদায়ের কয়েকটি পরিবার বংশ পরম্পরায় চ্যাপা শুঁটকি তৈরি করে থাকেন। সনাতন পদ্ধতির গাজন প্রক্রিয়া দ্বারা চ্যাপা শুঁটকি প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু চূড়ান্তভাবে গাজন প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয় না। চ্যাপা শুঁটকির কাঁচামাল তথা পুঁটি মাছ বাছাইকালে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। নষ্ট, পঁচা বা আংশিক পঁচা মাছ ব্যবহার করা যায় না। সদ্য আরোহণ করা মাছ সংগ্রহ করতে হয়। পরে এ মাছকে যথাযথভাবে পরিচর্যা করতে হয়। বাছাইকৃত মাছ পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালভাবে ধুঁয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন অবস্থায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শুঁটকিকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। বড় আকারের সম্পূর্ণ শুঁটকিগুলো বাছাই করে চ্যাপা শুঁটকির জন্য নির্বাচন করতে হয়। মাটির মটকা তেল দিয়ে ভিজিয়ে ভালভাবে প্রস্তুত করতে হয়। পুঁটি মাছ হতে উৎপাদিত তেলে অনেক ময়লা ও বাড়তি আর্দ্রতা থাকে তাই প্রাপ্ত তেল ভালভাবে ছেঁকে নিতে হয়। পরে এ তেল পুনরায় উনুনে তথা চুলায় ভালভাবে ফুটিয়ে বা গরম করে ব্যবহার করতে হয়। এতে তেলে থাকা বাড়তি আর্দ্রতা চলে যায় এবং জীবাণুও মুক্ত হয়। তেলে ভেজানো মাটির মটকাতে ভালভাবে পরিষ্কার হাত দিয়ে চেপে চেপে ভরতে হয়। মটকাতে শুঁটকি ভরা হয়ে গেলে মটকার মুখে চূর্ণ করা শুঁটকি মাছ ও মাছের তেল দিয়ে প্রস্তুতকৃত পেস্ট দিয়ে প্রথমে একটি স্তর তৈরি করতে হয়। এই স্তরের উপরে মটকার মুখে সমানভাবে একটি পলিথিন কাগজ দিয়ে ঢেকে দিতে হয় এবং ঢেকে দেয়া পলিথিন কাগজের ওপর মাটির কাই দিয়ে মটকার মুখ বায়ুরোধী করে আটকে দিতে হয়। এভাবে মটকার মুখ বায়ুরোধীভাবে আটকে দিলে ভেতরের শুঁটকি মাছ ও মাছের পেস্ট মাটির সংস্পর্শে আসতে পারে না। প্রস্তুতকৃত মটকা গাজন প্রক্রিয়ার জন্য ঠা-া ও শুষ্ক স্থানে ৫-৬ মাসের জন্য সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যবসায়ীরা জানায়, এ অঞ্চলে প্রস্তুতকৃত চ্যাপা শুঁটকি ঢাকা, নরসিংদী, বৃহত্তর ময়মনসিংহের অনেক জেলায় প্রতি মণ ৩০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়ে থাকে। ব্যবসায়ী মোহন চন্দ্র বর্মণ ও তার ভাই প্রহল্লাদ চন্দ্র বর্মণ এবং মরম আলী মিয়াকে নিয়ে কিশোরগঞ্জ বড়বাজারে সর্বপ্রথম বৃহৎ পরিসরে চ্যাপা শুঁটকি মাছ উৎপাদন এবং বিক্রয় করা শুরু করেন। পরর্বতী সময়ে প্রহল্লাদ চন্দ্র বর্মণ এবং মরম আলী মিয়া আলাদা করে ব্যবসা দিয়েছেন। চ্যাপা শুঁটকি ব্যবসায়ী কাজল বর্মণ জানান, প্রায় ৫০ বছর যাবৎ এ ব্যবসার সাথে তারা জড়িত। ৩০ বছর আগে পিতা মোহন চন্দ্র বর্মণের প্রয়াণের পর অষ্টম শ্রেণী পড়া অবস্থায় বাবার ব্যবসায় হাল ধরেন তিনি। -মাজহার মান্না, কিশোরগঞ্জ থেকে
×