ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : নম্রতা যোশী, রূপান্তর: এনামুল হক

কাইফি আজমি ॥ সমাজ রূপান্তরের অনুঘটক

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯

 কাইফি আজমি ॥ সমাজ রূপান্তরের অনুঘটক

উর্দু কাব্যসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র কাইফি আজমির একক একটি দিক ছিল বৈষয়িক বিষয়ের প্রতি নির্লিপ্ততা। তার অভিনেত্রী কন্যা শাবানা আজমী বাবার প্রতি অনুরাগের হাসি দিয়ে সে কথা স্মরণ করে বললেন, ‘তার জন্ম হয়েছিল আজমগড়ের মিজওয়ানের এ জমিদার পরিবারে। তবে নিজেকে তিনি একজন কৃষাণ বলে মনে করতেন। একমাত্র যে বিষয়গুলো তার কাছে গুরুত্ব বা মূল্য বহন করত তা হলো, তার কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পরিচিতি এবং ‘মবলা’ ঝর্ণা কলমের সংগ্রহ। যখন তখন উনি সেগুলো বের করে নিতেন, পরিষ্কার করতেন, অনুরাগভরে সেগুলো দেখতেন, এমনকি রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য নিউইয়র্কে ঝর্ণা কলমের একটা হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতেন। বমলা কলমের প্রতি এমনই ছিল তার ‘লোভ’ যেÑ একবার শাবানার এক বন্ধু তাকে একটা কলম উপহার দিলে কাইফি সানন্দে সেটিকে মেয়ের হাত থেকে খিমচে নিয়ে নিয়েছিলেন। পরে তার বন্ধুকে এক সুন্দর চিঠিতে লিখেছিলেন কেন ওই কলমটি তার কাছে থাকাটাই অনেক বেশি শ্রেয়। কাজেই এ বছর কবির জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের জন্য যেসব অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়েছে তার মধ্যে একটা কলম উৎসবই হলো তার স্মৃতিতর্পণের জন্য যথার্থ। কলম উৎসবের ধারণাটির উদগাতা বিশাল সিংঘী। শাবানা বলেন, আগামী মাসে মুম্বাইয়ের নেহরু সেন্টারে অনুষ্ঠেয় এই কলম উৎসবে ‘কাইফির নামে এক শ’ কলম আনা হবে।’ ১১ জানুয়ারি এনসিপিএতে সঙ্গীত সন্ধ্যা, কবিতা আবৃত্তি ও রাগ শায়রীর মধ্য দিয়ে শতবার্ষিকী উৎসব শুরু হয়। জাভেদ আখতারের পরিকল্পনায় এই কর্মসূচীর অধীনে কাইফির কাব্য সাহিত্যকে সঙ্গীতের মাধ্যমে উপস্থাপন করেন শঙ্কর মহাদেবান, তবলায় এর রূপ দেন জাকির হোসেন, কবিতা আবৃত্তি করেন আখতার এবং ইংরেজী অনুবাদ পড়ে শোনান শাবানা। থিয়েটার পরিচালক ও লেখক ফিরোজ আব্বাস খান অনুষ্ঠানের পরিচালনায় ছিলেন। আর স্থপতি, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও ‘মুম্বাইস জি-৫ ফাউন্ডেশন ফর কনটেম্পোরারি কালচার’-এর প্রতিষ্ঠাতা অনুরাধা পারিখ ছিলেন প্রযোজনা ডিজাইনার। শতবার্ষিকী উৎসব ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য জুড়ে অনুষ্ঠিত হবে। উৎসবের অংশ অন্যান্য অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে প্রামাণ্য ছবি কাইফিনামা, শাবানা ও আখতারের নাটক কাইফি আউর ম্যায়, মুশাইরা, স্মৃতিচারণ ও সেমিনার এবং লক্ষেèৗতে কাইফি আজমি কলাকেন্দ্রে তিন শ’ আসনের একটি মিলনায়তন উদ্বোধন। বহুমুখী প্রতিভার এই মানুষটিকে একটি পরিচয়ের মধ্যে ধারণ করা কঠিন। কাইফি একজন গীতিকার, একজন অধিকারবাদী এবং প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের একজন সদস্যও ছিলেন। চিত্রনাট্যকার হিসেবে কাইফি চেতন আনন্দের হির রানঝা (১৯৭০)-এর পুরোটাই শ্লোক বা কবিতার চরণে লিপিবদ্ধ করার বিরল কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন। তিনি এমএস সত্যায়ুর ‘গরম হাওয়া’ (১৯৭৩)-এর স্ক্রিপ্ট, সংলাপ ও লিরিক রচনা করেছিলেন এবং সাঈদ আখতার মির্জার ‘নাসিম’ (১৯৯৫) ছায়াছবিতে অসুস্থ পিতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ভারতীয় সে সব ছায়াছবিতে মুসলিম মানসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ প্রস্ফুটন ঘটেছে শেষের দুটি ছায়াছবি ছিল তার অন্যতম। কাইফি পরিবর্তনের অনুঘটকও ছিলেন এবং সেই ভূমিকাটি পালন করেছিলেন কোন রকম হৈচৈ বা ঢাকঢোল না পিটিয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন দেশের সত্যিকারের অগ্রগতি হতে হলে যেখানে ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর বাস সেই গ্রামের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। ১৯৯৩ সালে তিনি গ্রামীণ ভারতের বালিকা ও মহিলাদের জন্য মিজওয়ান কল্যাণ সমিতি গঠন করেন এবং শিক্ষা ও দক্ষতা প্রশিক্ষণকে সমিতির কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেন। শাবানার সঙ্গে আমার এই বৈঠকে আমি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। কাইফির এ ধরনের বেশকিছু স্মৃতি, তার সেই সময়, সেই দিনগুলোর সংস্কৃতি এবং সেই সব শিল্পীর কথা মানসপটে ভেসে ওঠে যারা বিশ্বাস করতেন শিল্পকলাকে প্রচারণার কাজে নয় বরং সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। এরপর আছে ব্যক্তিগত স্মৃতি। কাইফি ভালবাসতেন অরহর ডাল, গোশ্ত ও বথুয়া শাক। শাবানার কণ্ঠ কতই না পছন্দ করতেন এবং চাইতেন সে গায়িকা হোক, শিশু বয়সে সে তার (কাইফি) ও তার ভাই সিনেমাটোগ্রাফার বাবা আজমির সঙ্গে মুশাইরায় যাক। শাবানা স্মরণ করেন, ‘মুশাইরায় আমরা তাকিয়ার পেছনে ঘুমিয়ে নিতাম। কারণ, জনপ্রিয় কবিদের একদম শেষের দিকে রাখা হতো। সুতরাং তার (কাইফির) পালা রাত দুটোর আগে কখনই আসত না।’ শাবানার মনে পড়ে কাইফি, জান নিসার আখতার, সাহির লুধিয়ানভি, মাজরুহ সুলতানপুরী ও আলী সরদার জাফরির মতো কবিদের কিভাবে চলচ্চিত্র তারকাদের মতো সম্মান করা হতো। কাইফির সঙ্গে শাবানার মা শওকতের প্রথম দেখা ১৯৪৭ সালে হায়দরাবাদে এক মুশাইরায়। কাইফির চেহারা, তার কণ্ঠ, তার আবৃত্তি করা অপূর্ব কবিতা ‘আউরাত’ তাকে বিমুগ্ধ করেছিল। ‘সেই দিনগুলোতে যখন ধরেই নেয়া হত যে মহিলাদের কপালের লিখন হলো ঘরে থেকে সংসারের কাজকর্ম ও সন্তান পালন করা আর পুরুষের কাজ হলো বাইরে গিয়ে জীবিকার জন্য সংগ্রাম করা সেই সময় কাইফি লিখেছেন, ‘জাগো আমার প্রণয়ী, আমার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তোমায় চলতে হবে।’ মুশাইরা শেষ হওয়ার পর কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা মৌমাছির মতো তাকে ছেঁকে ধরে। শওকত কাইফির দিকে তাকালেন এবং তারপর দুষ্টুমি করে অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য সরদার জাফরির দিকে এগিয়ে গেলেন। পরিশেষে তিনি যখন কাইফির কাছে গেলেন কাইফি তাঁর বইয়ে প্রত্যাশিত কোন কাব্যের চরণ না লিখে অর্থহীন কিছু কথা লিখে দিয়েছিলেন। আর এভাবেই জন্ম নিয়েছিল এক প্রেমের কাহিনী। আজমিদের বাড়িটি ছিল জুহুর এক ছোট্ট কুটির। নাম জানকি কুটির। সেখানে জোশ মালিহাবাদী, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, ফিরাক গোরাখপুরী ও কণ্ঠশিল্পী বেগম আখতার প্রায়শই আতিথ্য গ্রহণ করতেন পরবর্তীকালে গুরুদত্ত, এসডি বর্মণ ও চেতন আনন্দ মাঝে মধ্যেই আসতেন। পরিবারটি সব ধরনের উৎসব পালন করত। শাবানা বলেন, ‘কাইফির জন্মশতবার্ষিকী আমাদের সে সব মানুষ এবং সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার একটা উপায়। সেই দিনগুলোকে আবার ফিরিয়ে আনা কতই না গুরুত্বপূর্ণ।’ কাইফি একবার কথা প্রসঙ্গে তার ছেলেকে বলেছিলেন যে- তার জন্মস্থান মিজওয়ানে একটা ফিল্ম তৈরি হলে বেশ ভাল হতো। ক’দিন আগে বাবা উত্তর প্রদেশের এই গ্রামটির এক বাবা ও মেয়ের কাহিনী ‘মি রাকসাম’ (আমি নাচ করতে চাই)-এর শূটিং শুরু করেছেন। এতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মিজওয়ানের বাসিন্দা ১৪ বছরের অদিতি শর্মা। ছবিটি এ বছরের শেষ নাগাদ মুক্তির জন্য প্রস্তুত হবে বলে আশা করা হচ্ছে এবং এটাই হবে কাইফি বছরটির যথার্থ উপসংহার। সূত্র : দি হিন্দু
×