প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমত। তাঁকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু পৃথিবীতে প্রেরণ করেন সমগ্র মানবজাতির নিকট হেদায়াতের বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য। আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁকে উদ্দেশ করে ইরশাদ করেন : হে রসূল, আপনি বলুন, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের নিকট আল্লাহর প্রেরিত রসূল (সূরা আরাফ : আয়াত ১৫৮)।
নর ও নারী মিলেই মানবজাতি। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম নরপ্রধান পৃথিবীতে নারীদের যথাযোগ্য মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে এক অনন্য বিপ্লব সাধন করেন। বিশ্ব মানব সভ্যতার ইতিহাসে তিনিই সর্বপ্রথম এবং তিনিই কেবল নারীদের সম্মানের মসনদে অধিষ্ঠিত করেন। তাঁর আবির্ভাবের পূর্বে নারীদের শুধু ব্যবহার করা হতো ভোগের সামগ্রী হিসেবে, তাদের স্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না। তারা যেন ছিল আসবাবপত্রের মতো। তাদের মনে করা হতো পণ্যসামগ্রী, তারা তখন দিন গুজরান করত নিদারুণ নির্যাতনের মধ্যে, তারা বনে গিয়েছিল অস্থাবর সম্পত্তি এবং খেলনার বস্তু। নারীরা কেবলই পুরুষের সেবা করবে এমনতর ধারণা সর্বত্র শেকড় গেঁড়ে বসেছিল। সেবাদাসী প্রথা বিশ্ব সমাজ জীবনে ব্যাপকভাবে বিদ্যমান ছিল, যে কারণে সৃষ্টি হয়েছিল থিওডোরা ও আম্রপালীদের মতো অসংখ্য সেবাদাসীর এবং গণমনোরঞ্জক রমণীর। খোদ আরব দেশে তো কন্যাসন্তান হওয়াকে দুর্ভাগ্য মনে করা হতো। অনেক পিতা কন্যাসন্তান হলে তাকে জ্যান্ত কবর দিতেও কুণ্ঠাবোধ করত না।
প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম নারীদের এক করুণ অমানবিক হাল থেকে উদ্ধার করেন এবং তাদের কন্যা হিসেবে, ভগ্নি হিসেবে, মাতা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে সর্বোপরি মানুষ হিসেবে অধিকার প্রদান করেন। তাদের তিনি ন্যায্য ও সম্মানজনক মর্যাদা দান করেন। তারা লাভ করে সদাশয়তা এবং শ্রদ্ধা। তারা পিতা-মাতার কাছ থেকে কন্যা হিসেবে লাভ করে স্নেহ-মমতা এবং আদর। শুধু তাই নয়, সে উত্তরাধিকারিত্বও অর্জন করে। সে ভগ্নি হিসেবে তার ভাই ও পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছ থেকে লাভ করে সহমর্মিতা ও সহযোগিতা; মাতা হিসেবে সবার কাছ থেকে লাভ করে যথাযথ কর্তৃত্ব ও ভক্তি। মাতা হয়ে ওঠে মহিমান্বিত। বধূ হিসেবে সে লাভ করে মুবারকবাদ শুভেচ্ছা এবং আন্তরিক অভ্যর্থনা ও পরিবারের সকল সদস্যদের কাছ থেকে লাভ করে প্রেম-প্রীতি কর্তৃত্ব ও উত্তরাধিকারিত্ব; মানুষ হিসেবে লাভ করে সামাজিক সম্মান, মর্যাদা এবং মানবিক মূল্যবোধ। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু যা হুকুম করেছেন তিনি তার বাস্তবায়ন করেছেন, কায়েম করেছেন শরিয়ত। কোরান মজিদে স্পষ্ট ভাষায় বিশ্ব মানব সভ্যতা নির্মাণে নারী ও পুরুষের যৌথ অবদানের উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ জাল্লা শানুহু উল্লেখ করেছেন : হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে। পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার (সূরা হুজুরাত : আয়াত ১৩)।
নারীর প্রথম পরিচয় সে পিতা-মাতার কন্যা। কিন্তু কন্যা হিসেবে তার যে কদর তা প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে ছিল না। কন্যাসন্তান জন্ম নিলে পিতা-মাতার মুখ কালো হয়ে যেত। এ অবস্থার কথা উল্লেখ করে কোরান মজিদে ইরশাদ হয়েছে : তাদের কাউকে যখন কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয় তার গ্লানিহেতু সে লোক সমাজ হতে নিজেকে লুকায়। সে ভাবে, হীনতা সত্ত্বেও সে ওকে রাখবে, না মাটিতে পুঁতে দেবে, সাবধান তারা যে সিদ্ধান্ত নেয় তা কত নিকৃষ্ট (সূরা নহল : আয়াত ৫৮-৫৯)।
কন্যাসন্তান হোক কিংবা পুত্রসন্তান হোক সবই যে আল্লাহর রহমত তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কোরান মজিদে। ইরশাদ হয়েছে : আসমানসমূহ ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব আল্লাহরই তিনি যা ইচ্ছা করেন তা সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যাসন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন (সূরা শুরা : আয়াত ৪৯)।
প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম একদিন সাহাবায়ে কিরামকে বললেন, যে ব্যক্তি কন্যা বা ভগ্নিকে লালন পালন করে, তাদের সুশিক্ষা দান করে এবং তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করে, তারপর বয়োপ্রাপ্ত হলে সৎপাত্রে ন্যস্ত করার মাধ্যমে তাকে স্বাবলম্বী করে দেয় তার জন্য জান্নাত ওয়াযিব হয়ে যায়। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন : ইয়া রাসুলাল্লাহ্, দুটো থাকলে? তিনি বললেন : দুটোর ক্ষেত্রেও। আর একজন জিজ্ঞাসা করলেন; একজন থাকলে? তিনি বললেন : একজনের ক্ষেত্রেও (মিশকাত শরীফ)। অন্য একখানি হাদিসে আছে যে, কারও যদি কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হয় আর তাকে যদি সে পুঁতে না ফেলে তাকে যদি অপমানিত না করে এবং তাকে উপেক্ষা করে যদি পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করে তবে আল্লাহ্ তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন (আবু দাউদ)।
প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের আবির্ভাবের পূর্বে পুরুষ যত ইচ্ছে পতœী গ্রহণ করতে পারত। উপপতœী ও রক্ষিতা রাখার কুপ্রথা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান ছিল। স্ত্রী গ্রহণ এবং ইচ্ছে হলেই তাকে ছেড়ে দেয়া ছিল যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। নারীরা হয়ে উঠেছিল পণ্যসামগ্রীর মতো। তাদের না ছিল সম্মান, না ছিল মর্যাদা, না ছিল কোনরূপ অধিকার। তিনি সুনির্দিষ্ট বিবাহ নীতিমালা ও তালাক বিধান প্রবর্তনের মাধ্যমে বহুবিবাহ প্রথার শেকড়ে কুঠারাঘাত করলেন এবং বিবাহ বিচ্ছেদকে নিয়ন্ত্রিত করলেন। চারজন পর্যন্ত স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দেয়া হলেও সেক্ষেত্রে জুড়ে দেয়া হলো কতগুলো শর্ত। তার ফলে ইচ্ছে করলেই একাধিক স্ত্রী গ্রহণের প্রবণতা রোধ হয়ে গেল। এ ব্যাপারে কোরান মজিদে ইরশাদ হয়েছে : তোমাদের পছন্দমতো বিবাহ করবে দুই, তিন অথবা চার নারীকে। আর যদি আশঙ্কা কর যে, সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনকে (সূরা নিসা : আয়াত ৩)। এই আয়াতে কারিমায় চারটি পর্যন্ত বিয়ে করার অনুমতি থাকলেও প্রত্যেক স্ত্রীর ওপর সুবিচার (আদল) না করার আশঙ্কা থাকলে একটি বিয়ে করার জোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আইয়ামে জাহেলিয়াতের পাপ পঙ্কিলতার আবর্তে নিমজ্জিত তদানীন্তন পুরুষ সমাজের উপেক্ষা অবহেলা, জুলুম-নির্যাতন নারী সমাজকে এমন অসহায় অবস্থায় নিয়ে এসেছিল যে তারা ভাবতেই পারত না যে, মানুষ হিসেবে তারা স্বীকৃতি পাবে। নারীর অবস্থা এমন একপর্যায়ে গিয়ে উপনীত হয়েছিল যে, তারা যেন সৃষ্টি হয়েছে কেবল পুরুষের চিত্তবিনোদন ও কাম ক্ষুধা মেটানোর জন্য। প্রিয়নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বিয়ে বিধান প্রবর্তন করে নারীর অধিকার সুনিশ্চিত করলেন। নারীর সম্মতি ছাড়া কোন পুরুষ কোন নারীকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করতে পারবে না। এই বিধান দিয়ে তিনি নারীদের মর্যাদা সমুন্নত করলেন। স্ব^ামী গ্রহণের ক্ষেত্রে তার পছন্দ করার পূর্ণ অধিকার দেয়া হলো; ফলে পুরুষ ইচ্ছে করলেই একজন নারীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে এমন যে রীতি প্রচলিত ছিল তা আর থাকল না। পুরুষের স্ত্রীর ওপর যতটুকু অধিকার স্ত্রীরও পুরুষের ওপর ততটুকু অধিকার নিশ্চিত করা হলো। কোরান মজিদে স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক সম্পর্ক সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৭)। চলবে...
লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ