ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা সিনেমা বাঁচাতে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ১৭ জানুয়ারি ২০১৯

বাংলা সিনেমা বাঁচাতে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

দেবানিক কুণ্ডু। জন্ম বারাসাত। পূর্ব পুরুষের বসতি বাংলাদেশের খুলনা, ফুলতলার দক্ষিণডিহি। বর্তমান নিবাস কলকাতা। রেইনবো আয়োজিত সপ্তদশ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে অংশগ্রহণ করেছেন তার স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ফেয়ার’ নিয়ে। এখন পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ৪টি। নতুন প্রজন্মের এই নির্মাতার সঙ্গে বাংলা চলচ্চিত্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেনÑ পপি দেবী থাপা আনন্দকণ্ঠ : রেইনবো আয়োজিত ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে আপনার অংশগ্রহণ... দেবানিক : ২০০৮ থেকে আমি এই ফেস্টিভ্যালের সঙ্গে যুক্ত। আমি এর একজন প্রোগ্রামারও বটে। পূর্বেও আমার সিনেমা এ উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে। এবারের অংশগ্রহণ স্বপ্লদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ফেয়ার’ নিয়ে, যা প্রদর্শিত হয় ১২ জানুয়ারি। আনন্দকণ্ঠ : দুই বাংলার সিনেমার মৌলিক জায়গা থেকে যদি তুলনা করেন... দেবানিক : যদি কনটেন্টের কথা বলেনÑ তাহলে বলব দুই বাংলাতেই কনটেন্ট ডেভেলপ হচ্ছে। ‘এ বাংলার ছবি ভাল বা ও বাংলার ছবি ভাল না,’ আমি বিষয়টাকে এভাবে দেখি না। আমাদের ওখানে ১৯৯৫/৯৬ সাল থেকে অন্যধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়েছে। যে পরিবর্তনটা আপনাদের স্পর্শ করেছে ২০১০-১২ তে। গত শতকের ৭০ দশকে যে ফরমেটে সিনেমা হতো ৯০ দশকের মাঝামাঝি এসে তাতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। একটা সময় গেছে যখন কেবল বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ছবি তৈরি করা হয়েছে। ৯০ দশকের শেষে এসে ঋতুপর্ণ ঘোষ, রাজা সেনের হাত ধরে আসা পরিবর্তনের ফল আজকের বাংলা চলচ্চিত্র। ৯০ দশকের বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সিনেমার খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। পার্থক্যের জায়গায় বলব টেকনিক্যাল সাপোর্টের কথা। আর টেকনিক্যাল সাপোর্ট বলতে মেশিনারিজ বোঝাচ্ছি না। বলছি লোকবল, দক্ষতার কথা। এসব কম থাকার কারণে বাংলাদেশে ছবির মান নেমে যায়। যে পরিস্থিতির উত্তোরণ শুরু হয় ২০১০-১২ তে। আনন্দকণ্ঠ : সিনেমার প্রসারে আপনি বিকল্প মাধ্যমগুলোর ভূমিকা কিভাবে দেখেন দেবানিক : ডিজিটাল প্লাটফর্মগুলো সিনেমা প্রদর্শনে অনেক বেশি সাহায্য করছে। হাজারো ছবি তৈরি হলেও প্রদর্শনের সুযোগ ছিল কম। যদি কলকাতার উদাহরণ দেই বছরে ২৪০টি ছবি তৈরি হলে প্রদর্শনের সুযোগ পায় বড় জোর ৫০টি। এখন অন্তত বাকি সিনেমাগুলোর প্রদর্শনের সুযোগ থাকছে। এর ফলে আগে যেমন সিনেমা নির্মাণটা ছিল মুষ্টিমেয় কিছু লোকের হাতে। এখন সেই বৃত্ত ভেঙে নতুনদের উঠে আসার সুযোগ হয়েছে। আনন্দকণ্ঠ : ভাল সিনেমার জন্য ভাল গল্পের অভাবের কথা ইদানীং অনেকেই বলে থাকেন বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন- দেবানিক : বিষয়টির সঙ্গে আমি একমত নই। আসলে আমাদের সহজাত একটা প্রবণতা আছে যে ‘আগেরটা ভাল ছিল’। আগে হয়ত ৫টি সিনেমা হতো যার ৩টি ভাল। এখন ৫০টি হচ্ছে তার মধ্যে ১০টি ভাল। কোয়ানটিটি বাড়াতে গিয়ে কনসেন্ট্রেশন যাচ্ছে কমে। ভাবনায় হারিয়ে ফেলছে নান্দনিকতা। ছবির গুণগত মানের চেয়ে নির্মাতাদের কাছে অর্থের প্রাধান্যই বেশি। এই ধারা শিল্পের অন্য মাধ্যমেও দেখা যাচ্ছে। সিনেমা তৈরির ক্ষেত্রে প্রযোজকের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে একজন নির্মাতাকে তার নান্দনিক ভাবনার সঙ্গে আপোস করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখানে ভাল গল্পের অভাবকে আমি খুব বেশি গুরুত্ব দিতে রাজি নই। আনন্দকণ্ঠ : তবে কি একজন শিল্পী হিসেবে নির্মাতাকেও প্রতিনিয়ত আপোস করতে হচ্ছে? দেবানিক : অবশ্যই। আসলে একটা কথা আছে না ‘যার টাকা তার ভয়েস’। এটি শুধু আমাদের এখানেই নয় হলিউড থেকে শুরু করে সবখানেই। এখান থেকে বের হওয়ার পথ হচ্ছে শিল্পটাকে শিল্প হতে দেয়া। এখানে অর্থের যোগান যেহেতু একটা বড় সমস্যা, সেটি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে দুটি পথ আছে, একটি হচ্ছেÑ শিল্প- সাহিত্যের জন্য সরকারের যে বরাদ্দ থাকে সেটি। এখানেও সংকট হচ্ছে অল্প কিছু মুখ চেনা লোক সেই সুবিধা পেয়ে থাকেন। নতুনদের জন্য এই সুযোগ সীমিত। অপরটি হচ্ছে প্রাইভেট ফান্ড। সেখানে ভাল সিনেমা নির্মাণ তখনই সম্ভব যখন প্রযোজক ও যোগ্য নির্মাতার দর্শন ম্যাচ করবে। আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি ৮০-এর দশকে যখন অবাঙালী বা মারোয়ারি প্রযোজকরা সিনেমা প্রযোজনা করতেন, তারা সাহিত্য পড়তেন। ভাল লাগলে কপি রাইট কিনে একজন নির্মাতাকে সিনেমাটি নির্মাণের অনুরোধ করতেন। অর্থাৎ প্রযোজক কাহিনীটির ভেতরে ঢুকতেন। পরিচালক সেখানে ছিলেন একজন ফ্রিল্যান্সার। এভাবেই অনেক ভাল সিনেমা নির্মিত হয়েছে তখন। আনন্দকণ্ঠ : আপনি একটু আগে বলছিলেন সত্যজিৎ রায় মৃণাল সেন ওনাদের কথা আলাদা ... দেবানিক : তারা শ্রদ্ধেয়। অনেক ভাল সিনেমা নির্মাণ করেছেন। বিশ্বের দরবারে বাংলা সিনেমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আমি ভাল বা খারাপ সিনেমার সংজ্ঞা দেইনি। আমরা প্রায়ই বলি ওমুক ভাল সিনেমা নির্মাণ করেন। সত্যজিৎ রায় গত শতকের ৫০-৬০-এর দশক থেকে কিছু ইউনিক সিনেমা তৈরি করেছেন। তাদের এই রেভুলেশন ২০১০ পর্যন্ত চলেছে। মাঝখানে ঢুকেছেন অনেকেই। কিন্তু ১-২টি ভাল ছবি কখনও পুরো চিত্রের পরিবর্তন আনতে পারে না। আপনারা বিষয়টাকে কীভাবে নেবেন জানি না, নিজেরা ভাল সিনেমা নির্মাণ করলেও তারা ইন্ডাস্ট্রির সামগ্রিক উন্নতির জন্য কতটা করেছেন সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আবার বাণিজ্যিকভাবে যে তাদের সব সিনেমা সফল তাও বলা যাচ্ছে না। আনন্দকণ্ঠ : বাংলা সিনেমার ভবিষ্যত... দেবানিক : এভাবে চললে আমি খুব বেশি আশাবাদী নই। প্রথম কারণটি বলব ৮০-এর দশকে যেখানে পশ্চিম বাংলায় ৯২৮টি সিনেমা হল ছিল সেখানে এখন আছে ২৪০টি। খুব হিট করা সিনেমাও ৪ সপ্তাহের বেশি চলতে পারছে না। বাজার ছোট হয়ে আসায় কালেকশন কমে যাচ্ছে। আর কালেকশন কমা মানেই ছবির বাজেট কমা। সেক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার বাজারে মানসম্মত সিনেমা তৈরি করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। একটি হিন্দী সিনেমার বেলায় চোখ বন্ধ করে তারা বাজার থেকে শত কোটি টাকা তুলে নিতে পারে। আপনি যেমন তামিল ছবির কথা বলছিলেন এক্ষেত্রে আমি বলব দর্শক কিন্তু সিনেমার ভাষা দেখে না। সিনেমা দেখে। সাউথ ইন্ডিয়ায় ৪টি স্টেট নিজেদের মধ্যে সিনেমা বিনিময় করে। এ কারণে তাদের কালেকশনও বেশি। তারা বড় বাজেটের সিনেমা নির্মাণ করছে। আর এভাবেই তারা গিলে খাচ্ছে সবকিছু। আর সেখানে বাংলা চলচ্চিত্র জ্বলছে টিমটিম করে। আনন্দকণ্ঠ : পরিস্থিতি উত্তোরণের উপায়... দেবানিক : দুই বাংলার ছবি এক করা। আমরা যদি বাজার খুলে দেই আমাদের বাজার বাড়বে। বাজার যত বড় হবে ছবির মান তত বাড়বে। সাউথের কথা যেমন বলছিলাম, তারা যখন হিন্দী সিনেমার সামনে দাঁড়াতে পাড়ছিল না তখন নিজেদের মধ্যে বাজার সম্প্রসারণ করে, ফলাফল পেয়েছে হাতেহাতেই। বাংলা চলচ্চিত্রের স্বার্থেই আমাদেরও সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। আনন্দকণ্ঠ : উৎসবে অংশগ্রহণ করে আপনার অনুভূতি... দেবানিক : বাংলাদেশ আমার কাছে নিজের দেশের মতোই। তারপরও আলাদা করে আমি আপনাদের আতিথেয়তার কথা বলব। এক কথায় অতুলনীয়। তবে একটি বিষয় আমাকে কষ্ট দেয় সেটি হলো এতবড় একটি উৎসব হচ্ছে- সেখানে বিভিন্ন ফিল্ম ইনস্টিটিউশনের ছাত্রদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। আমি তাদের অনুরোধ করব এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার একটি বড় মাধ্যম। আশা করি তারা সুযোগটাকে কাজে লাগাবেন।
×