ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মধ্যস্বত্ব¡ভোগী দালাল-ফড়িয়া হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা ॥ ধানের বাজার কৃষকের হাতছাড়া

ধানের বাজার ব্যবস্থায় নেই মনিটরিং

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ১৭ জানুয়ারি ২০১৯

ধানের বাজার ব্যবস্থায় নেই মনিটরিং

মেজবাহউদ্দিন মাননু, নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া ॥ সাগরপারের জনপদ কলাপাড়ায় ধানের বাজার মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়া দালাল চক্রের দখলে চলে গেছে। মাত্র দেড় মাসের মধ্যে ধানের বাজার মণ প্রতি (৪৬ কেজি) দুই শ’ টাকা বেড়ে গেছে। কৃষকের শতকরা ৯০ জনের ধান বিক্রি শেষ না হতেই এ চক্র ধানের দাম বৃদ্ধি করেছে। কৃষক মাঠ পর্যায়ে এক মাস আগে যে ধান মণ প্রতি মাত্র ৫৫০ থেকে ৬৫০ টাকায় বিক্রি করেছে। ওই ধান এখন ফড়িয়া মধ্যস্বত্ব¡ভোগী চক্র পাইকারদের কাছে ৮০০ টাকা মণ দরে বিক্রি করছে। এ চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও ক্ষতির কবলে পড়ছে কৃষক। ফলে বেশি সমস্যায় পড়ছে বর্গা কিংবা প্রান্তিক চাষী। এমনকি একসনা ভিত্তিক জমি বন্ধকী রাখা চাষীরাও বিপাকে পড়েছে। সরকার এখন পর্যন্ত এ উপজেলায় ধান কেনার উদ্যোগ না নেয়ায় এক শ্রেণীর মিলারসহ দালালচক্র বিশাল অঙ্কের মুনাফা ধান কেনা-বেচার মধ্য দিয়ে হাতিয়ে নেয়। আর মাঝখান দিয়ে কৃষক তার কোন হিসেব-নিকেশ মেলাতে পারছে না। জমি আবাদ করে পড়ছে লোকসানের কবলে। এর বিরুপ প্রভাব পড়ছে গ্রামের কৃষিভিত্তিক প্রধান অর্থনীতির খাতে। প্রকৃতি নির্ভর দক্ষিণের এ জনপদের শতকরা ৭০ ভাগ কৃষকের নিজের জমি খুবই কম। এরা অন্যের জমি একসনা চাষ করে মালিককে দিতে হয় মোট ধানের অর্ধেক কিংবা এক বছর আগেই কানি (৮ বিঘা) প্রতি ১৫ থেকে ২০-২২ হাজার টাকা। এরপর রয়েছে ফসলের উৎপাদন ব্যয়, তাও প্রায় ৩২ হাজার টাকা। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উফশী জাতের ধানের আবাদ করে এক কানির উৎপাদিত ধান ১০০ মণ বিক্রি করে যে টাকা পায় তাতে আর লাভের মুখ দেখতে পারে না। গেল বছর কৃষক ধানের ভাল দাম পেয়ে খুব খুশি ছিল। কিন্তু এবার তাদের ভাষায়, ‘ধরা খেয়েছে।’ কৃষকদের অভিযোগ, প্রতিবছর কৃষকের গোলায় ধান উঠতে না উঠতেই মধ্যস্বত্বভোগী চক্র ধানের বাজার সিন্ডিকেট বেধে নিয়ন্ত্রণ করে। এর সঙ্গে গত প্রায় আট বছর সরকারী দলের রাজনৈতিক একটি চক্রও জড়িয়ে রয়েছেন। এরা শুধু বডি শো করে ভাগিদার বনে যায়। এ চক্রের নির্দিষ্ট এরিয়া রয়েছে। ওই এলাকার কৃষক এ চক্র ছাড়া অন্যের কাছে ক্ষেতের ধান পর্যন্ত বিক্রি করতে পারে না। প্রথমে কৃষক ধান পাকলেই দাদন নেয়। তখন দরদাম নির্ধারণ ছাড়াই ধানের অগ্রিম বায়না নেয়। পরে মধ্যস্বত্বভোগী চক্র পাকার পরে নিজস্ব খেয়াল খুশি মতো দাম কেটে ধান নিয়ে নেয়। এ চক্র এতটা প্রভাবশালী যে কৃষক নাম পর্যন্ত মুখে আনতে চায় না। কৃষকের খোরাকি ছাড়া বাকি ধান বিক্রিকালে ওই চক্র ধানের দাম খুব নিম্নœমুখী নিয়ন্ত্রিত রাখে। যখন কৃষকের অধিকাংশের বায়না কিংবা বিক্রিচুক্তি শেষ হয় তখন ধানের দাম মণ প্রতি এক/দেড় শ’ থেকে দুই শ’ টাকা বৃদ্ধি করে ওই কৃষকের উঠান থেকে পাইকারকে মেপে বুঝিয়ে দেয়। কৃষক শুধু নীরব দর্শকের মতো প্রতারণার জালে আটকা পড়ে মনের মধ্যে ঠকের ব্যথা সইয়ে থাকে। বাইরের কোন ক্রেতা সরাসরি ধান কেনে না। দালাল ফড়িয়া এ চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। মূল ক্রেতা বাজারে আসতে না পারায় এ চক্রের কাছেই ধান বিক্রিতে বাধ্য হচ্ছে কৃষক। অপরদিকে মিটার পদ্ধতি ব্যবহারের বদলে সনাতনী সিস্টেমে ৪০ কেজির বদলে মণে নিয়ে যায় ৪৬-৪৭ কেজি। শুধু তাই নয়, এ বছর ধান বিক্রি করে শত শত কৃষক নগদ টাকা পর্যন্ত পায়নি। বিক্রির ৭-৮ দিন থেকে এক মাস পরেও টাকা নিতে বাধ্য করা হয়েছে। দালালরা কৃষকের ধান বিক্রি করে লাভসহ পাওয়া টাকা থেকে কৃষককে শোধ দেয়। মাঝখান থেকে বিনা পুঁজিতেই হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা মুনাফা। সরকারের বিপণন ব্যবস্থার মনিটরিং নেই এ অঞ্চলে। আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে মধ্যস্বত্ব¡ভোগী চক্র ওজন কারচুপির মাধ্যমে ফি বছর দালালচক্র হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। কলাপাড়া উপজেলা কৃষক মৈত্রীর সভাপতি আলাউদ্দিন শিকদার বলেন, মৌসুমের শুরুতে ধানের বাজার মূল্য নির্ধারণ না করায় দালাল চক্র সিন্ডিকেট বেধে কম মূল্যে কৃষকদের ধান বিক্রিতে বাধ্য করছে। উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে ধানের বাজার দর নির্ধারণ করে, সরাসরি এ অফিসের মাধ্যমে ধান ক্রয় করা প্রয়োজন। ওজনে বেশি নিয়ে ধানের দাম কম দিয়ে দালাল চক্র কৃষকদের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারত না। কৃষক মৈত্রী নেত্রী লাইলী বেগম বলেন, মৌসুমের শুরুতে ধানের মূল্য নির্ধারণসহ ওজনের ক্ষেত্রে মিটার পদ্ধতি চালু করতে কৃষক মৈত্রী মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে আসছে। কিন্তু এসব নিয়ন্ত্রণে কৃষি বিপণন অধিদফতর কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ নেই। ফলে ফড়িয়া বা দালাল চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে দিন দিন ঋণের বোঝা আরও ভারি হচ্ছে এখানকার কৃষকের। পটুয়াখালী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ হৃদয়েশ্বর দত্ত জানান, এ বছর জেলায় ২ লক্ষ ২ হাজার ৬০৮ হেক্টর জমিতে আমন উৎপাদন হয়েছে। যা থেকে ৫ লক্ষ ১০ হাজার ৪১৫ মেট্রিক টন চাল পাওয়া যাবে। বিগত বছরের তুলনায় ৫ হেক্টর জমি কম হলেও উৎপাদন বেড়েছে অনেক। এখন পর্যন্ত ৬৮ শতাংশ জমির ফসল কর্তন হয়েছে। এতেই ৩ লক্ষ ৬৩ হাজার ১৯৬ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে। আশা করছি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, জেলায় বেসরকারীভাবে পাঁচটি অটো রাইস মিল রয়েছে। এ মিলগুলো থেকে আমরা চাল সংগ্রহ করছি। তবে কলাপাড়ায় কোন ধান কেনা শুরু হয়নি।
×