ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

জামাল খাশোগি ছিলেন লাদেনের বন্ধু

প্রকাশিত: ০৭:০০, ১৬ জানুয়ারি ২০১৯

জামাল খাশোগি ছিলেন লাদেনের বন্ধু

গত বছরের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনার অন্যতম জামাল খাশোগির হত্যাকা- এবং সেই কারণে তিনি নিঃসন্দেহে বছরের সেরা আলোচিত ব্যক্তিত্ব। তার হত্যাকা- বহুদিন বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব রাখবে। কিন্তু কেন? কে ছিলেন এই খাশোগি? শুধু কি ওয়াশিংটন পোস্টের একজন সাংবাদিক, নাকি আরও কিছু। এখন দেখা যাক তার বিস্তারিত পরিচয়। জামাল খাশোগি এক বর্ণাঢ্য সৌদি পরিবারের অন্তর্গত যে পরিবারটির শিকড় বয়ে গেছে তুরস্কে। খাশোগিদের আদি উৎস মধ্য আনাতোলিয়ার কাইসেরি। খাশোগি হলো কাসিকি শব্দের আরবী রূপ। কাসিকি শব্দের অর্থ চামচ প্রস্তুতকারক। প্রায় ৪ শতাব্দী আগে খোশোগিদের একটি দল হজ পালন করতে যায়। হজ শেষে কিছু হাজী মক্কা ও মদিনায় থেকে যান। সৌদি আরবে বেশ ভালই করেছিল খাশোগিরা। জামালের দাদার বাবা ছিলেন মদিনার মেয়র। তার দাদা মোহাম্মদ খালেদ ছিলেন সার্জন এবং পরে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা বাদশাহ আবদুল আজিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। তিনিই প্রথম এক্স-রে মেশিন ও জেনারেটর সৌদি আরবে আনেন। তিনি সামিহা আহমদ সেত্তি নামে এক সৌদি মেয়েকে বিয়ে করেন। তাদের প্রথম সন্তান আদনান খাশোগি কয়েক দশক ধরে বিশ্বে খাশোগি গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে সুপরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। প্রথমে মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া ও পরে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়েই তিনি ব্যবসায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং এক পর্যায়ে বিলিমনিয়ারে পরিণত হয়। তার অর্থবিত্ত ও সম্পদ যখন তুঙ্গে সে সময় আদনানের ছিল এক শ’ নিমুজিন, তিনটি বিমান, সাড়ে ৭ কোটি ডলারের প্রমোদতরী, বেশকিছু ব্যাংক, রিসোর্ট, হোটেল, বাড়ি ইত্যাদি। আশির দশকের মাঝামাঝি আদনানের সা¤্রাজ্যের স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে আসে ও ধীরে আর্থিক ঋণে জর্জরিত হয়ে তিনি প্রায় সবকিছুই হারিয়ে ফেলেন এবং ২০১৭ সালে মারা যান। আদনানের বোনের স্বামী মোহম্মদ আল ফায়েদ যিনি একজন ধনকুবের এবং হ্যারোডসের মালিক। তার ছেলে অর্থাৎ আদনানের ভাগ্নে ডোডি মোহম্মদ বিন-ফায়েদ প্রিন্সেস ডায়নার শেষদিকের প্রেমিক এবং ডায়নার সঙ্গেই তার মৃত্যু হয়। আদনানের মতো জামাল খাশোগিরও জন্ম মদিনায়। তার বাবা আদনানের ছোট ভাই আহমদ। তার একটা কাপড়ের দোকান ছিল। মায়ের নাম ইসাফ। জামালের স্কুল শিক্ষা সৌদি আরবে। পরে উচ্চতর শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যান। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ডিগ্রী নেন ১৯৮২ সালে। পরে সাংবাদিকতার ওপর ডিপ্লোমা করেন। দেশে ফিরে জামাল ইংরেজী পত্রিকা এরাব নিউজ এবং আরবী পত্রিকা ওকাজ-এ সাংবাদিকতা পেশা শুরু করেন। লন্ডনভিত্তিক আরবী দৈনিক আল-শার্ক আল-আসোশত এবং আল-হায়াত-এর সংবাদদাতা হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৯০ এর দশকে তিনি আফগানিস্তান, আলজিরিয়া, সুদান এবং মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ থেকে বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে খবর পরিবেশন করেন। এ সময়ই ওসামা বিন লাদেনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। লাদেন তখন আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছিলেন। এ সময় আরব জনগণের বিপুল সমর্থন ছিল লাদেন ও মুজাহিদের প্রতি যারা যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবেরও প্রকাশ্য ও গোপন সমর্থন লাভ করেছিল। মুজাহিদরা কিভাবে রুশ সেনাদের নাস্তানাবুদ করছে আফগানিস্তানে এসে স্বচক্ষে তা দেখে যাওয়ার জন্য একবার জামাল খাশোগি লাদেনের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। সেই আমন্ত্রণ পেয়ে তিনি আফগানিস্তানে যান এবং স্বচক্ষে গেরিলা যুদ্ধ দেখেন। লাদেনের সাক্ষাতকারও নেন তিনি। স্থানীয় পোশাক পরা অবস্থায় এসল্ট রাইফেল হাতে নিজের একটা ছবিও তুলে নিয়েছিলেন। লাদেনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব সুদৃর বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং আফগানিস্তান ও সুদানে তিনি তার আরও কয়েকবার সাক্ষাতকার নেন। ২০১১ সালে মার্কিন সৈন্যদের হাতে লাদেন নিহত হলে বন্ধুর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে জামাল টুইটও করেছিলেন, ‘কিছুক্ষণ আগে আমি কেঁদে ভাসিয়েছিলাম। আবু আবদুল্লাহ, তোমার জন্য আমার হৃদয় ভেঙ্গে গেছে ...’ নাইন ইলেভেনের সময় জামাল ছিলেন ‘এরার নিউজ’-এর ডেপুটি এডিটর-ইন-চীফ। হামলাকারী ১৯ জনের ১৫ জনই সৌদি নাগরিক হওয়ায় ঘটনাটা মার্কিন-সৌদি সম্পর্কের ওপর বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। সৌদি আরব সন্ত্রাসবাদ সমর্থন করে নাÑ এ কথাটা আমেরিকানদের বোঝানোর জন্য সে সময় দূত হিসেবে যাদের পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে জামাল খাশোগিও ছিলেন। বলাবাহুল্য রাজপরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ছিলেন তিনি। ১৯৯৯ সালে জামাল আল-ওয়াতান পত্রিকার প্রধান সম্পাদক হন। তবে ধর্মীয় নেতাদের সমালোচনা করায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর তিনি সৌদি আরবের সাধারণ গোয়েন্দা পরিদফতরের সাবেক প্রধান শাহজাদা তুর্কি বিন ফয়সালের মিডিয়া উপদেষ্টা হন। তুর্কি তখন ব্রিটেনে সৌদি রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ২০০৫ সালে তুর্কি যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হলে জামাল সেখানে তার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে থাকেন। ২০০৭ সালে জামাল পুনরায় আল-ওয়াতান পত্রিকার প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হয়ে সৌদি আরবে ফিরে আসেন। পত্রিকায় তিনি ৩ বছর ছিলেন। তারপর রক্ষণশীল এস্টাবলিশমেন্টের সমালোচনা করে একটি অভিমত নিবন্ধ প্রকাশ করা নিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষাপটে পদত্যাগ করেন। তার পরও জামাল ছিলেন একজন জনপ্রিয় সাংবাদিক। সৌদি টিভি চ্যানেলগুলোতে তার উপস্থিতি স্থায়ী ব্যাপার হিসেবে থেকে যায়। দুর্ভাগ্যবশত উদারপন্থীরা তাকে গোঁড়া ইসলামপন্থী এবং রক্ষণশীল ওয়াহাবীরা তাকে সেক্যুলার ভাবাপন্ন উদারপন্থী হিসেবে গণ্য করায় তার সমর্থনের সুদৃঢ় ভিত্তি কখনও গড়ে ওঠেনি। বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে যুবরাজ সালমান নতুন বাদশাহ হলে জামালের জন্য সঙ্কট দানা বাঁধতে থাকে। সালমানের সিংহাসন আরোহণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জামাল প্রতিবেশী বাহরাইনে সৌদি শাহজাদা আলওয়ালিদ বিন তালালের মালিকানাধীন নতুন টিভি স্টেশন আল আরবের প্রধান নিযুক্ত হন। টিভি কেন্দ্রের প্রচারিত প্রথম অনুষ্ঠানগুলোর একটি ছিল সরকারের সমালোচক এক বিশিষ্ট ব্যক্তির সাক্ষাতকার। সেটি প্রচারিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে স্টেশনটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর ২০১৭ সালের ৪ নবেম্বর সৌদি আরবে ঘটে এক শুদ্ধি অভিযান। বেশ কিছু বিশিষ্ট সৌদি শাহজাদা ব্যবসায়ী, মন্ত্রিকে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় যার মধ্যে তালালও ছিলেন। নতুন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দৃষ্টিভঙ্গি জামাল সমর্থন করতে পারেননি। পরিণতি এই দাঁড়ায় যে জামালের মিডিয়ায় উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি তাকে টুইটও করতে দেয়া হচ্ছিল না। তবে নবেম্বরের সেই শুদ্ধি অভিযানের আগে জামাল যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে পেরেছিলেন। নইলে তার পরিণতি কি হতো বলা মুশকিল। যুক্তরাষ্ট্রে তিনি ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার কলামিস্ট হন। ২০১৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তার প্রথম কলামে তিনি লেখেন যে গ্রেফতার হতে চাননি বলে তিনি সৌদি আরব ছেড়ে চলে এসেছেন। সংস্কারের জন্য তিনি চাপ দিচ্ছিলেন বলে চাকরি থেকে তাকে দু’বার বরখাস্ত করা হয়েছিল। জামাল যুবরাজ মোহম্মদের শাণিত সমালোচনাও করেন। ২০১৮ সালের মে মাসে ইস্তানবুলে একটা সম্মেলনে হাতিস চেঙ্গিস নামে এক পিএইচডি ছাত্রীর সঙ্গে জামাল খাশোগির পরিচয়। সেই পরিচয় প্রেমে গড়ায়। হাতিস ছিলেন জামালের ২৩ বছরের ছোট। কিন্তু তা প্রেমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। জামাল ইস্তানবুলে একটা এ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলেন। তারা দু’জনেই অক্টোবরে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা ভাবছিলেন। জামাল যেদিন নিহত হন সেদিন হাতিসের পরিবারের সঙ্গে ডিনারে মিলিত হওয়ার কথা ছিল। আগের স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্সের সার্টিফায়েড কপি যোগাড়ের জন্য তিনি ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেটে গিয়েছিলেন। তার কোন কোন বন্ধু নাকি বলেছিল যে সেখানে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। জামাল তাদের বলেছিলেন যে তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের মতো উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ আছে। সেটাই তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কিন্তু কোন কিছুই তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। নিষ্ঠুর ঘাতকের দল কিভাবে তার প্রাণ হরণ করেছিল আগামী দিনগুলোতে সে কাহিনী সংবাদ জগতে প্রাধান্য বিস্তার করবে। সূত্র : দি উইক
×