ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নৃত্যগীতে উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা রণেশ দাশগুপ্ত স্মরণ

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ১৬ জানুয়ারি ২০১৯

নৃত্যগীতে উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা রণেশ দাশগুপ্ত স্মরণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করা হলো উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সাংবাদিক-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক-প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ রণেশ দাশগুপ্তকে। রণেশ দাশগুপ্তের ১০৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মঙ্গলবার এ স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় নৃত্য-গীত ও কবিতায় সজ্জিত এ জন্মজয়ন্তী অনুষ্ঠান। শুরুতে আলোচনা পর্বে সভাপতিত্ব করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদ। এ পর্বে রণেশ দাশগুপ্তর জীবন-সংগ্রাম, সাহিত্য চেতনা এবং তাঁর জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সভাপতি, বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ও বিশিষ্ট লেখক-গবেষক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, কৃষক নেতা লীনা চক্রবর্তী, লেখক-গবেষক-সাংবাদিক দীপঙ্কর গৌতম, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি রফিকুল হাসান জিন্নাহ এবং উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন। এ পর্বটি সঞ্চালনা করেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের সাধারণ সম্পাদক ইকবালুল হক খান। আলোচনা পর্বে বক্তারা বলেন, আজীবন সংগ্রামী রণেশ দাশগুপ্ত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে মানব কল্যাণের ব্রত গ্রহণ করেন। ৪০’র দশকে গড়ে তোলেন প্রগতি লেখক সংঘ, যুক্ত হন শিশু-কিশোর এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তান আমলেও তিনি সক্রিয় ছিলেন সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর গড়ে তোলার পেছনে অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর শিল্পী-সংগ্রামী- সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক-কৃষক নেতা সত্যেন সেন-এর সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন উদীচী। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সারাদেশে উদীচী’র বিস্তার এবং সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তোলার পেছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা রাখেন রণেশ দাশগুপ্ত। উদীচী’র গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রের অন্যতম রচয়িতাও রণেশ দাশগুপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদমুক্ত, সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করার মাধ্যমে সারাজীবন অসংখ্য মানুষকে মানব সেবার মহান ব্রত গ্রহণে উদ্বুব্ধ করে গেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। এ ছাড়া, রণেশ দাশগুপ্ত-এর সঙ্গে একসঙ্গে সাংবাদিকতা করার স্মৃতি রোমন্থন করেন কামাল লোহানী। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ অধ্যুষিত পুরান ঢাকায় রণেশ দাশগুপ্ত-এর বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর মাধ্যমেই প্রমাণিত হয় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের মাঝে কতোটা জনপ্রিয় ছিলেন রনেশ দাশগুপ্ত। আলোচনাসভার শেষে প্রথমবারের মতো উদীচী আয়োজিত ‘রণেশ দাশগুপ্ত গ্রন্থপাঠ প্রতিযোগিতা’র ঢাকা মহানগর সংসদের প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হয়। চারটি আলাদা বিভাগে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত ‘ক’ বিভাগে প্রথম হয়েছেন ঐশী রানী সাহা, দ্বিতীয় সামিয়া ইসলাম এবং তৃতীয় স্থান পেয়েছেন হুরাইয়া জান্নাত সুমাইয়া। ৯ম ও ১০ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য ‘খ’ বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেছে কানিজ ফাতেমা কথা, দ্বিতীয় মোসাঃ খাদিজা আক্তার এবং তৃতীয় হয়েছেন আশামনি আক্তার। এছাড়া, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য ‘গ’ বিভাগে প্রথম হয়েছেন শাকিব আল হাসান, দ্বিতীয় স্থান পেয়েছেন মাকসুদা আক্তার এবং তৃতীয় স্থান অর্জন করেছেন নাছরিন আক্তার। প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথিরা। ঢাকা মহানগর সংসদের মতো দেশের অন্যান্য জেলাতেও অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘রণেশ দাশগুপ্ত গ্রন্থপাঠ প্রতিযোগিতা’। সব জেলাতেই রণেশ দাশগুপ্ত-এর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিজয়ী প্রতিযোগীদের মাঝে পুরস্কার তুলে দেয়া হয়। গত ১২ জানুয়ারি দেশের সব জেলায় একযোগে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা ও পুরস্কার প্রদান শেষে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা পর্ব। এ পর্বে ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর’ গানের সুরে নৃত্য পরিবেশন করেন উদীচী ঢাকা মহানগর সংসদের নৃত্যশিল্পীরা। লালনগীতি ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’, গণসঙ্গীত ‘মারো জোয়ান হেইয়ো’ এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘সঙ্কটের বিহ্বলতা নিজের অপমান’ গানগুলো দলীয়ভাবে পরিবেশন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সঙ্গীত বিভাগের শিল্পীরা। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন আনান বাউল, অবিনাশ বাউল এবং উপমা আক্তার বৃষ্টি। এছাড়া, দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করেন উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ ও ঢাকা মহানগর সংসদের শিল্পী-কর্মীরা। ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি ভারতের আসাম রাজ্যের ডিব্রুগড়ে জন্মগ্রহণ করেন রণেশ দাশগুপ্ত। একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ, মৌলবাদমুক্ত, সাম্যবাদী সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ১৯৬৮ সালের ২৯ অক্টোবর শিল্পী, সংগ্রামী সত্যেন সেনসহ কয়েকজন প্রগতিশীল, মুক্ত চিন্তার মানুষের প্রচেষ্টায় ‘উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’ গড়ে তোলার পেছনে অন্যতম ভূমিকা রাখেন রণেশ দাশগুপ্ত। তার অসামান্য জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মনন ও চিন্তাশীল উপস্থিতির মাধ্যমে উদীচী’র সংগ্রামকে নানা সময়ে বেগবান করেছেন রণেশ দাশগুপ্ত। ১৯৯৭ সালের ৪ নবেম্বর কলকাতায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন মনীষী রণেশ দাশগুপ্ত।
×