ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচন অতি ত্রুটিপূর্ণ, বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি টিআইবির

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৬ জানুয়ারি ২০১৯

নির্বাচন অতি ত্রুটিপূর্ণ, বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি টিআইবির

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অতি ত্রুটিপূর্ণ, আংশিক গ্রহণযোগ্য, প্রশ্নবিদ্ধ, পক্ষপাতমূলক ও বিতর্কিত বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তাই এসব অভিযোগ দূর করতে সরকারের কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণায় সমান সুযোগ না পাওয়াসহ বিভিন্ন ত্রুটির কারণে এসব অভিযোগ করেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্বোচ্চার এ সংস্থাটির মতে, এ ধরনের নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক নয়। মঙ্গলবার রাজধানীর ধানম-িতে মাইডাস সেন্টারে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনার’ গবেষণামূলক প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের এই পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে। টিআইবি জানায়, মোট ৩০০টি নির্বাচনী আসনের মধ্যে ৫০টি আসন দৈবচয়নের ভিত্তিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ১০৭ জন প্রার্থীর সঙ্গেও ওইসমস্ত এলাকার নাগরিকদের সঙ্গে আলোচনা করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবি’র ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপার্সন এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবি’র গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভোট নিয়ে ওঠা অভিযোগগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা হোক। কারণ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অনেক অনিয়ম হয়েছে। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ও বিতর্কিত হয়েছে। মূলত সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলা গেলেও তা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশন গুরুত্বপূর্ণ অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে সমর্থ হয়নি। নির্বাচন কমিশন সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারেনি। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ আছে কি না তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। এছাড়া নির্বাচনের সময়ে তথ্য প্রবাহ ‘নিয়ন্ত্রণ’ ছাড়াও ক্ষমতাসীন দল-জোটের কোন কোন কার্যক্রম নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রার্থীদের নির্বাচনী আচরণ বিধি লংঘনের প্রবণতা দেখা গেছে। প্রচারণার জন্য নির্বাচন কমিশনের বেঁধে দেয়া আসন প্রতি নির্ধারিত ব্যয়সীমার চেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে। এটা আইন প্রণেতাদের আইন মেনে চলার ক্ষেত্রে অনীহার প্রমাণ দেয়। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে বিধি মানা না হওয়ায় নির্বাচন আংশিক অংশগ্রহণমূলক হয়েছে। এছাড়া ভোটারদের প্রত্যাশা অনুযায়ী ভোট দেয়ার সমান সুযোগ ছিল না। সব দলের প্রার্থীরা প্রচারণায় সমান সুযোগ পায়নি। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের প্রত্যাশিত নিরপেক্ষতার অভাব ছিল। সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সময়মতো উদ্যোগ নেয়ায় ব্যর্থতা ছিল। মোটা দাগে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলা যায় কারণ সব দল প্রার্থী দিয়েছিল। আংশিক অংশগ্রহণমূলক এ কারণে বলা হচ্ছে, সকলে সমান সুযোগ পায়নি। গণতন্ত্রের জন্য এ ধরনের নির্বাচন ইতিবাচক নয়। এটাও ঠিক যে একটা নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র আসে না আবার ধ্বংসও হয় না। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি সুলতানা কামাল বলেন, নির্বাচনে যদি সমান সুযোগ দেয়া না হয় তবে গণতন্ত্রে জন্য এটা ভাল নয়। সেই কারণে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলা হচ্ছে। নির্বাচনে সবাই সমান সুযোগ পাবে এটাই বাঞ্ছিত। সবাই সমান সুযোগ না পেলে সংশয় থেকেই যায়। এটা গণতন্ত্রের জন্য ভাল উদাহরণ রাখে না। নির্বাচন পরিচালনায় প্রচুর ত্রুটি ছিল। এ জন্য আমরা বলছি, ত্রুটিগুলো সংশোধন করে সামনের নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু করবেন। গবেষণায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সকল দলের সভা-সমাবেশ করার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, বিরোধীদের দমনে সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা নেয়া, সব দলের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা সমানভাবে নিশ্চিত করা, নির্বাচনী অনিয়ম ও আচরণ বিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে-বিশেষ করে সরকারী দলের প্রার্থী ও নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে কমিশনের উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণ করেনি নির্বাচন কমিশন। ফলে কার্যত নির্বাচন কমিশন সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারেনি। এছাড়া নির্বাচনের সময়ে তথ্য প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ যেমন- পর্যবেক্ষক ও সংবাদমাধ্যমের জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা; মোবাইলের জন্য ফোর-জি ও থ্রি-জি নেটওয়ার্ক বন্ধ, জরুরী ব্যতীত মোটরচালিত যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দল ও জোটের কোন কোন কার্যক্রম নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। যেমন- সংসদ না ভেঙ্গে নির্বাচন করায় সরকারের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন সমর্থক গোষ্ঠী সম্প্রসারণের জন্য আর্থিক ও অন্যান্য প্রণোদনা এবং নির্বাচনমুখী প্রকল্প অনুমোদনসহ নির্বাচনের প্রায় একবছর আগে থেকেই ক্ষমতাসীন দলের প্রচারণা, বিরোধী পক্ষের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের মাধ্যমে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণে বাধা দেয়া, সংলাপে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা দেয়ার পরও নির্বাচনের সময় পর্যন্ত ধরপাকড় ও গ্রেফতার অব্যাহত রাখা এবং সরকারবিরোধী দলের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা প্রদানসহ প্রার্থী ও নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা ও সহিংসতা নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। অন্যদিকে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০টি আসনের মধ্যে ৩৬টি আসনে বিরোধীদলের প্রচারে বাধা দানসহ ৪৪টি আসনে সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই দলীয় নেতা-কর্মীদের নামে মামলা, পুলিশ বা প্রশাসন কর্তৃক হুমকি ও হয়রানি, প্রার্থী ও নেতা-কর্মী গ্রেফতার এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও কর্মী কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে ভয়-ভীতি দেখানোর তথ্য পাওয়া যায়। প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয়ের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সার্বিকভাবে তফসিল ঘোষণার পূর্ব থেকে নির্বাচন পর্যন্ত প্রার্থীদের গড় ব্যয় ৭৭ লক্ষ ৬৫ হাজার ৮৫ টাকা, যা নির্বাচন কমিশন দ্বারা নির্ধারিত ব্যয়সীমার (আসনপ্রতি সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা) তিনগুণেরও বেশি। প্রচারণায় সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা (গড়ে পাঁচগুণের বেশি) এবং সবচেয়ে কম ব্যয় করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৪৭টি আসনে নির্বাচনের দিনেও কোন না কোন নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়। অনিয়মের ধরনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০টির মধ্যে ৪১টি আসনের বিভিন্ন কেন্দ্রে জাল ভোট, ৪২টি আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা, ৩৩টি আসনের বিভিন্ন কেন্দ্রে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল, ২১টি আসনের বিভিন্ন স্থানে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা, ৩০টি আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট, ২৬টি আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা, ২০টিতে ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা, ২২টিতে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া, ২৯টিতে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেয়া ইত্যাদি।
×