ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মানবিক উদ্যোগ নিয়ে গ্রামে

ফেসবুকে রোদন নয় শুধু, শীতার্তদের পাশে বন্ধু সহপাঠীরা

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১৬ জানুয়ারি ২০১৯

ফেসবুকে রোদন নয় শুধু, শীতার্তদের পাশে বন্ধু সহপাঠীরা

মোরসালিন মিজান ॥ শীতের দু’টো গল্প। একটি পিঠা-পুলির। খেজুরের রস খাওয়ার। অনেকে আবার পরিবার-পরিজন নিয়ে বের হয়ে যান। ঘুরে বেড়ান। অন্য গল্পটি, না, ঠিক গল্প নয়। বাস্তবতা। কত মানুষ এখনও ঘরহীন! কনকনে শীতে গায়ে দেয়ার মতো কিছু তাদের নেই। অথচ মাঘ শুরু হয়ে গেল। বলা হয়ে থাকে মাঘের শীতে বাঘ পালায়। কিন্তু গরিব যে পালাতেও পারে না! বেঁচে থাকার অহর্নিশ যুদ্ধ। তাদের এই যুদ্ধটাকে আরও কঠিন করে দিতে আসে শীত। এবারও এসেছে। কিন্তু আমরা যারা একটু ভাল আছি, বেশ আছি তারা কি শীতার্ত সুবিধা বঞ্চিত মানুষগুলোর কষ্ট উপলব্ধি করছি? ফেসবুকে কত রোদন! বাস্তবে কিছু করছি তাদের জন্য? এমন প্রশ্নে অনেকেই চুপ হয়ে যাবেন। অথচ হেসে খেলে, গল্প আড্ডার মধ্যে থেকেও অনেক ভাল কিছু করে ফেলা যায়। দাঁড়ানো যায় শীতার্তদের পাশে। উদাহরণ হতে পারে ফেসবুক গ্রুপ ‘এসএসসি-এইচএসসি : ১৯৯৫- ১৯৯৭।’ এই গ্রুপের পক্ষ থেকে গত প্রায় দুই মাস ধরে চলে শীতবস্ত্র সংগ্রহ করার কাজ। আর তার পর অতি সম্প্রতি গ্রামে গিয়ে এসব শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়েছে। কাজ চলছে এখনও। জানা যায়, ১৯৯৫ সালে এসএসসি ও ১৯৯৭ সালে এইচএসসি পাস করা বন্ধু সহপাঠীরা এই প্ল্যাটফর্মে একত্রিত হয়েছেন। শুরুটা করেছিলেন ডাঃ রাজিব ঘোষ। সেটা ২০১৬ সালের কথা। এরই মাঝে সারাদেশ থেকে গ্রুপে যুক্ত হয়েছেন ১৩ হাজারের বেশি মানুষ। আরও অনেক গ্রুপের মতো একটি গ্রুপ। এখানেও চলে গল্প আড্ডা। স্মৃতিরোমন্থন করা হয়। ছবি পোস্ট, লেখালেখি মন্তব্য পাল্টা মন্তব্য কিছুই বাদ থাকে না। তবে একইসঙ্গে মানবিক মূল্যবোধটুকু বাঁচিয়ে রাখার সচেতন প্রয়াস লক্ষ্য কার যায়। সামাজিক দায় থেকে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এরই অংশ হিসেবে শীতার্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। শীতবস্ত্র ও অর্থ সহায়তা চেয়ে পোস্ট দেয়া হয় গ্রুপে। সাড়াও পাওয়া যায় ভাল। ঢাকা চট্টগ্রাম নারায়ণগঞ্জ রংপুরসহ কয়েকটি জেলায় অস্থায়ী কালেকশন পয়েন্ট করে কম্বল চাদর ইত্যাদি জমা করা হয়। উদ্যোগটির সঙ্গে অতপ্রোতভাবে ছিলেন জামান এমবিএম, মহসিন আহমেদ, ফারজানা মালিক নিম্মী, আব্দুর বাসির, হোসনা ফেরদৌস সুমী, হাজী চান্দু মিয়া, ইকবাল হাসান চৌধুরী, মইনুল হোসেন তপু, সরদার ফারুক ফয়সাল, তানিম, মাসুম হোসেন চৌধুরী, ডা. রেজোয়ানুল আলম, নাজমুল হক, ফয়সাল চৌধুরী, ওয়াসিম আহামেদ, কামাল উদ্দীন, মাফিয়া ইসলাম, ঝিনুকসহ আরও অনেকে। গ্রুপ সদস্য রেজোয়ানুল আলম জানান, অল্প সময়ের মধ্যে ৪ হাজার নতুন কম্বল সংগ্রহ করতে সক্ষম হন তারা। শিশুদের জন্য কেনা হয় প্রায় ২ হাজার শিশুবস্ত্র। প্রবাসী বন্ধুরাও এগিয়ে আসেন। তাদের পাঠানো নগদ অর্থ উদ্যোগটিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে গত ১১ জানুয়ারি শীতবস্ত্র বিতরণে বের হন তারা। তিনি জানান, শীতপ্রধান অঞ্চল হিসেবে নীলফামারীর ডিমলা, রংপুরের ভুরুঙ্গামারী, মিঠাপুকুর সাঁওতালপল্লী, জুম্মাপাড়া, গঙ্গাচড়াসহ কুড়িগ্রামের বেশ কিছু এলাকা প্রাথমিকভাবে বেছে নেয়া হয়। আগেই খোঁজ খবর নিয়ে অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী এসব স্থানে কম্বল ও বস্ত্র বিতরণ করা হয়। পুরুষ সদস্যরা নন শুধু, শীতবস্ত্র বিতরণ করতে গিয়েছিলেন নারীও। তাদের মধ্যে ছিলেন রোজী, পাপিয়া, লিজা, ঝিনুক, ফারজানা মালিক নিম্মীসহ কয়েকজন। কী অভিজ্ঞতা হলো? জানতে চাইলে ঢাকার উত্তরা থেকে যাওয়া নিম্মী জনকণ্ঠকে বলেন, আসলে শীতে মানুষ কত কষ্ট করছে তা ওইসব এলাকায় না গেলে বোঝা যাবে না। সাঁওতাল পল্লীর দরিদ্র নারীরা ঠা-ায় এত কাবু হয়ে গিয়েছিলেন যে, মুখের দিকে তাকালে মায়া হয়। তাদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছি আমরা। একজন বৃদ্ধাকে আমরা পেয়েছিলাম, যার একটি ভাঙ্গা ঘর আর একটি গরু ছাড়া কেউ নেই। গায়ে গরম কোন কাপড় নেই। আমাদের নিয়ে যাওয়া শীতবস্ত্র তাদের মুখে কিছুটা হলেও হাসি ফুটিয়েছিল। কয়েকদিনের মধ্যে আরও কয়েকটি এলাকায় শীতবস্ত্র বিতরণ করা হবে বলে জানান তিনি। কিন্তু অভিযোগ আছে, ফেসবুকাররা বাস্তব অবস্থা নিয়ে ভাবেন না। সেলফি, লাইক, কমেন্ট, অযথা বিতর্ক ইত্যাদিতে মশগুল থাকেন। আপনাদের বেলায় ব্যতিক্রম হলো কী করে? জানতে চাইলে এডমিন প্যানেলের সদস্য মহসিন আহমেদ বলেন, ফেসবুকে সব বিষয় নিয়েই কথা হয়। আগ বাড়িয়ে অনেকে মন্তব্য করেন। আছি আছি বলেন। কিন্তু বাস্তবে তাদের অনেককেই আর পাওয়া যায় না। আমরা এ ব্যাপরে কিছুটা সচেতন থাকার চেষ্টা করি। গ্রুপের এডমিন প্যানেলের সদস্যরাও মোটামুটি এক মানসিকতার। যে কোন মানবিক উদ্যোগের সঙ্গে থাকতে ভালবাসি। আর বয়সও তো হয়েছে। এখন শুধু ফেসবুক নিয়ে পড়ে থাকার মতো কেউ নেই। ফেসবুকের যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে ভাল এবং কার্যকর কিছু করতে চাই। এমন আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে পারলে অন্য গ্রুপগুলোর মাধ্যমেও সমাজের অনেক ভাল হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
×