ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রূপকল্প-২১ সামনে রেখে ৬০ বিলিয়ন ডলারের স্বপ্নপূরণ

তিন বছরে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার রফতানি বাড়াতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৬ জানুয়ারি ২০১৯

তিন বছরে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার রফতানি বাড়াতে হবে

এম শাহজাহান ॥ রূপকল্প-২১ সামনে রেখে ৬০ বিলিয়ন ডলারের স্বপ্নপূরণে আগামী তিন বছরের মধ্যে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার রফতানি বাড়াতে হবে। প্রতিবছর রফতানি বাড়াতে হবে ৫ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার যা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা করে ধরে) বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৪৫ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে পণ্য সেবা খাত নিয়ে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ৪৪ বিলিয়ন ডলার। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতর থেকে আশা করা হচ্ছে, প্রতিবছরের মতো এবারও শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। চ্যালেঞ্জ থাকার পরও বড় অঙ্কের এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ সম্ভব বলে জানিয়েছেন সদ্য বিদায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, একেবারে যে অসম্ভব বিষয়টি তা নয়। তবে লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বেশকিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে সামনে। তাদের মতে, অবকাঠামো, জ্বালানি, উৎপাদনশীলতা, পোশাক কূটনীতি, কারখানা শতভাগ কমপ্লায়েন্স, এলডিসি থেকে উত্তরণ, রফতানি পণ্যের ন্যায্যদাম ও শ্রমিক ইস্যুর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে রয়েছে। এর বাইরে আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে রয়েছে নতুন বাজার অনুসন্ধান, গবেষণা ও উদ্ভাবন, ব্যাকওয়ার্ড ও ফরোয়ার্ড লিংকেজ উন্নয়ন, টেকসই উন্নয়ন ও রিলোকেশন, পরিবেশ দূষণ ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায়িক কর্মকা-ে দুর্নীতি কমিয়ে আনা ও বিনিয়োগে ওয়ান স্টপ সার্ভিস নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে উৎপাদন বহুমুখী করা, ডিজাইনের উন্নয়ন, কম দামী পোশাকের পাশাপাশি আরও উন্নতমানের পোশাক উৎপাদনে নজর দেয়ার কথাও বলছেন পোশাকের ক্রেতারা। এদিকে পোশাক শিল্পের উৎপাদক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ তাদের একটি প্রতিবেদনে দেখিয়েছে ‘বাংলাদেশ আরএমজি রোডম্যাপ : ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলার রফতানি’ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন শিরোনামে। এ রোডম্যাপে বলা হয়, বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্যে অগ্রগতির যে হার এবং বিশেষ করে রফতানি যে হারে বাড়ছে সেটা অব্যাহত থাকলে মাত্র তিন বছর পর এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বেশ কঠিন। গত অর্থবছরে শুধু পোশাক খাত থেকে ৩১ বিলিয়ন ডলার এসেছে। এ শিল্পের বর্তমান হার বজায় থাকলে ২০২১ সালে রফতানি বড়জোর ৪৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। যদিও ৬০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি পোশাক খাত থেকে আসবে বলে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য রয়েছে। সঙ্গত কারণেই ২০২১ সালের পোশাক খাতের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে বছরে ২ শতাংশ বেশি হারে রফতানি করতে হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, রূপকল্প-২১ অনুযায়ী আগামী তিন বছরের মধ্যে ৬০ বিলিয়ন ডলার রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। তিনি বলেন, পণ্য রফতানির পাশাপাশি বাংলাদেশে দ্রুত সেবা খাতের রফতানি বাড়ছে। এটা মাথায় রেখেই রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি ভাল। নতুন নতুন বাজারে পোশাক যাচ্ছে, আশা করছি রফতানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে। জানা গেছে, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৩ বিলিয়ন ডলার বেশি। এই রফতানি আয় আসবে পণ্য ও সেবা খাত থেকে। পণ্য খাতে সবচেয়ে বেশি আয় হয়ে থাকে গার্মেন্টস আইটেম রফতানি করে। আর সেবা খাতে গবর্নমেন্ট গুডস্ এবং সার্ভিসেস খাত থেকে সবচেয়ে বেশি আয় করা হয়। চলতি অর্থবছরে পণ্য খাত থেকে ৩৯ বিলিয়ন ডলার রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত অর্থবছরে এ খাতের লক্ষ্যমাত্রা ছিল প্রায় ৩৭ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে সেবা খাতে এবার প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় হবে যা গত বছর ছিল সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার। জানা গেছে, পণ্য খাতের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ১১টি পণ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে উৎপাদন বাড়ানোর কৌশল নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাত থেকে আয় হবে প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার। এ খাতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এর পরই নিট পোশাক, ওভেন পোশাক, হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য, পাট ও পাটজাতপণ্য, ওষুধ, কৃষিপণ্য, হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ, প্রকৌশল দ্রব্যাদি, প্লাস্টিক পণ্য, সিরামিক পণ্য ও পাদুকা শিল্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে রফতানি আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এছাড়া সেবা খাতে গবর্মেন্ট গুডস্ এবং সার্ভিসেস, ট্রান্সপোর্টেশন, টেলিকমিউনিকেশন, ট্রাভেল এবং কম্পিউটার সার্ভিসকে সামনে রেখে রফতানি আয় বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর সাবেক চেয়ারম্যান ও বাণিজ্য সচিব শুভাশিষ বসু জনকণ্ঠকে বলেন, রূপকল্প-২১ অনুযায়ী ৬০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এটা বিবেচনায় রফতানি আয় বাড়ানো হচ্ছে। তিনি বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী দেশের রফতানি আয় বেড়ে চলছে। শুধু তাই নয়, রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক খাতে ব্যাপক সংস্কার করা হয়। এই সংস্কারের ফলে দেশের গার্মেন্টস খাতে রফতানি আয় প্রতিবছর বাড়ছে। এছাড়া পণ্য উৎপাদনে দেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছে সরকার। জানা গেছে, ১০ বিলিয়ন ডলার আসবে চামড়া, ওষুধ, জাহাজ, আইসিটি, পাটজাত পণ্য, প্লাস্টিক এবং এ্যাগ্রো-প্রোডাক্টস ও প্রসেসড পণ্য রফতানি করে। এ লক্ষ্যে পোশাক শিল্পে বড় ধরনের বিনিয়োগ করা হবে। বর্তমান সেলাই করার বিদ্যমান শিল্পের সঙ্গে সুতা ও কাপড় উৎপাদনের প্রচেষ্টা এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সুতা, কাপড় ও পোশাক বাংলাদেশে তৈরি করা হবে। রফতানি বাড়াতে আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে রফতানি বৃদ্ধির প্রয়াস জোরদার করার পাশাপাশি নতুন নতুন বাজার অনুসন্ধানে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পোশাক রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি এসএম মান্নান কচি জনকণ্ঠকে বলেন, রূপকল্প-২১ অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রফতানি করা অসম্ভব নয়। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রতিবছর গড়ে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। এই প্রবৃদ্ধি এখন হচ্ছে। তবে সরকারের নীতিগত সহায়তা আরও বাড়াতে হবে। এছাড়া রফতানি শিল্পের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি, রফতানি পণ্যের গুণগতমান ও প্রতিযোগী মূল্য নিশ্চিত করা হবে। সম্ভাবনাময় তথ্যপ্রযুক্তি ভিক্তিক পণ্য ও সেবা রফতানির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান, প্রাধিকার নির্ধারণ, রফতানি সম্প্রসারণে বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে ফোকাল পয়েন্ট নির্ধারণ, বাণিজ্যিক উইংসমূহের কার্যক্রমকে গতিশীল করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। তবে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ৫০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য অর্জনে আগামী পাঁচ-ছয় বছরে সেই পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হবে, যা গত ৩৫ বছরে হয়েছে। সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ ছাড়া এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। একই সঙ্গে আমাদের পরিবেশ এবং টেক্সটাইল শিল্পের টেকসই উন্নয়নের কথাও মাথায় রাখতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে অবকাঠামো উন্নয়নেও। বর্তমানে চার লেনের কাজ চলছে। ছয় লেন বা এক্সপ্রেসওয়ের পরিকল্পনা নিয়েও ভাবতে হবে।
×