ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জন্মবিরতিকরণ বড়ি, যতসব ভুল ভাবনা

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯

জন্মবিরতিকরণ বড়ি, যতসব ভুল ভাবনা

সুমনা ও শামীম, বিয়ে করেছে একমাসের কিছু বেশি। বিয়ের দু’দিন পরই শামীম তার কর্মস্থল দিনাজপুরে চলে যায়। গত দু’মাসে ঢাকা এসেছে বার তিনেক। ওদের ইচ্ছে সামনের অন্তত দুটো বছর ওরা ঝরঝরে হাত-পায়ে ঘুরে বেড়াবে সারা বাংলাদেশে। কিন্তু জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে ওদের দু’জনের কারও কোন স্পষ্ট ধারণা নেই। এক বন্ধুর পরামর্শে শামীম প্রথমে নরপিল, পরে এমকন নামক জরুরী জন্মবিরতিকরণ বড়ি এনে দেয় সুমনাকে। সুমনা দুই মাসে ওই পিল খেয়েছে অন্তত চারবার। বিয়ের দু’তিন দিন আগে ওর পিরিয়ড ভাল হয়েছিল। কিন্তু আঠারো দিনের মাথায় আবার পিরিয়ড হয়ে যায়, তবে মাত্র দু’তিন থাকে আর পরিমাণে অল্প হয়। কয়েকদিন ভাল থেকে আবারও হয় আর এখন পর্যন্ত অল্প অল্প হয় যাচ্ছে। আগে কখনও পিরিয়ডের এমন অনিয়ম হয়নি। সুমনা বেশ ভয় পেয়ে গেছে আর তাই শামীম ওকে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে এসেছে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মনোযোগ দিয়ে সব শুনে বললেন, সুমনার পিরিয়ডের এ সমস্যা একমাসে বেশ কয়েকবার জরুরী জন্মবিরতিকরণ পিলের কারণে হয়েছে। এটা ঠিক হয়ে যাবে আর এভাবে সব সময় জরুরী জন্মবিরতিকরণ পিলের ওপর নির্ভর করা যাবে না। ওটা শুধু জরুরী অবস্থার জন্যই। আপনারা যেহেতু আরও দু’বছর সন্তান নিতে চাচ্ছেন না তাহলে একটা নিয়মিত জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন। কনডম ব্যবহার কিম্বা নিয়মিত পিল খাওয়া এ দুটো পদ্ধতির যে কোনটা শুরু করতে পারেন। সুমনা শামীমের মুখের দিকে তাকাল। একটু দ্বিধা করে বলল, শুনেছি বাচ্চা হওয়ার আগে পিল খেলে পরিবর্তীতে গর্ভধারণে সমস্যা হয়? স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মৃদু হেসে বললেন, পিল নিয়ে সাধারণ মানুষের অনেক ভুল ধারণা রয়েছে। কিছু নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা বাদ দিলে যে কোন স্বল্পমাত্রার পিল জন্মবিরতিকরণে যেমন প্রায় শতভাগ কার্যকর তেমনি অত্যন্ত নিরাপদ। পিল বা খাবার বড়ি নিয়মিত খেল তা ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু উৎপাদন বন্ধ রাখে। পিল ছেড়ে দেয়ার পরপরই সাধারণ পুনরায় নিয়মিত ডিম্বাণু উৎপাদন শুরু হয় এবং পরবর্তীতে দ্রুত গর্ভধারণ করা সম্ভব হয়। এ ক্ষেত্রে যদি কেউ বেশ অনেক বছর টানা খেয়ে যান, তাহলে হয়ত গর্ভধারণে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে। পিল ছেড়ে দেয়ার পর গর্ভধারণের চেষ্টা করার আগে দু’তিন বার নিয়মিত রজঃস্রাব হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ভাল। জন্মবিরতিকরণ পিল খেতে যদি কেউ ভুল করেন আর পিল চলা অবস্থায় গর্ভধারণ করেন তাহলে অনেকে ভয় পেয়ে যান যে, গর্ভপাত হয়ে যেতে পারে বা গর্ভস্থ শিশুর শারীরিক কোন বিকলাঙ্গতা ঘটতে পারে। এসব ধারণারও কিন্তু কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কিন্তু পিল খেলে ও মোটা হয়ে যাবে? শামীমের গলায় উৎকণ্ঠা। আরও একটি অসঠিক ধারণা, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেন। প্রথম দিককার জন্মবিরতিকরণ বড়িগুলো ছিল উচ্চমাত্রার এবং সেগুলোতে যে প্রজেস্টেরণ হরমোন ব্যবহার করা হতো তাতে কিছুটা ওজন বাড়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বর্তমানে যেসব বড়ি পাওয়া যায় বা আমরা খেতে বলি সেগুলো সবই স্বল্পমাত্রার আর প্রজেস্টেরণ হরমোনও শরীরের চর্বিবান্ধব। ফলে শতকরা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশেরই ওজন বড় জোর দু’কেজি এদিক ওদিক হতে পারে। অনেকে জন্মবিরতিকরণ বড়ি শুরুই করেন এমন বয়সে (যেমন ত্রিশের পর) যখন এমনিতেই একজন নারীর বয়সজনিত স্বাভাবিক ওজন বৃদ্ধি শুরু হয়। মাঝ থেকে দোষ গিয়ে পড়ে পিলের ওপর। সুমনা বলে, শুনেছি এসব জন্মবিরতিকরণ বড়ি ক্যান্সার ঝুঁকি বাড়ায়? বরং উল্টোটা ঘটে। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, জন্মবিরতিকরণ বড়ি মেয়েদের ডিম্বাশয় এবং জরায়ুর ভেতরের আবরণ বা এম্রোমেট্রিয়ামের ক্যান্সার ঝুঁকি প্রায় অর্ধেক কমিয়ে দেয়। তবে দীর্ঘদিন খেলে জরায়ুর মুখের ক্যান্সার এবং স্তন ক্যান্সার ঝুঁকি কিছুটা বাড়ে বলে মনে করা হয়, এক্ষেত্রেও এখনও কোন শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ তথ্য-প্রমাণ নেই। কিন্তু যার নিজের আগে স্তন ক্যান্সার হয়েছিল বা রক্ত সম্পর্কের কাছের আত্মীয়ার হয়ে থাকলে তাকে আমরা জন্মবিরতিকরণ বড়ি খেতে বারণ করি। আপনার পরিবারে স্তন ক্যান্সারের এমন কোন ইতিহাস আছে কি? না, কারো হয়েছে এমন শুনিনি, সুমনার উত্তর। পরিবারের কারও অল্প বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা স্ট্রোক হয়েছিল বা অন্য কোন ধরনের রক্ত জমাট বেঁধে যাওযার অসুখ আছে? জী না। আপনার গত এক বছরে জাস কিম্বা যকৃতের প্রদাহ অর্থাৎ হেপাটাইটিস হয়েছিল কি? না তো! তীব্র মাইগ্রেনের ব্যথা বা হাঁপানি আছে? না। আচ্ছা, এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন? শামীম একটু অবাক হয়ে জানতে চায়। আসলে জন্মবিরতিকরণ বড়ি ব্যবস্থাপত্র দেয়ার আগে আমাদের এসব নিয়মিত প্রশ্ন করে দেখে নিতে হয় বড়ি দেয়া যাবে কিনা, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ বলেন। যেহেতু সুমনা, আপনার বা আপনার পরিবারের কারও ওসব সমস্যা নেই, আপনি জন্মবিরতিকরণ বড়ি নিশ্চিন্তে খেতে পারেন। খাবার নিয়ম হচ্ছে আগামী পিরিয়ডের প্রথম দিন থেকে শুরু করবেন এবং প্রতিদিন একই সময়ে খাবেন, ভাল হয় রাতে খেলে তাহলে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। প্রথম পাতা শুরু করার পর দশটি বড়ি খাওয়া পর্যন্ত সঙ্গে কনডম ব্যবহার করতে হবে। প্রথম প্রথম একটু মাথা ঘোরাতে বা বমি ভাব লাগতে পারে। তবে নিয়মিত খেলে এসব সমস্যা চলে যাবে আর বর্তমানে যেসব পিল পাওয়া যায় সেগুলোতে এসব সমস্যা এমনিতেই কম হয়। আপনি যতদিন গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকতে চান ততদিন টানা জন্মবিরতিকরণ বড়ি খেয়ে যেতে পারেন। নিয়মিত জন্মবিরতিকরণ বড়ি খাওয়া চালিয়ে গেলে এবং প্রতিদিন একই সময়ে খেলে এ সমস্যা দু’এক মাসের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। তবে সমস্যা বেশি হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। আর নিয়মিত জন্মবিরতিকরণ বড়ি সেবন আরও বেশ কিছু স্বাস্থ্য সুবিধা দেয়। যেমন, পিরিয়ডে রক্ত কম ভাঙ্গে, ফলে রক্ত স্বল্পতার সমস্যা কমে আসে। পিরিয়ড পূর্ববর্তী স্তন ব্যথা, তলপেট ব্যথা ইত্যাদি কমে যায়। হাঁড়ে ক্যালসিয়াম বৃদ্ধি পায়। আমি আবারো বলছি, অহেতুক অমূলক সব ভয় থেকে বেরিয়ে স্বল্প মাত্রার জন্মবিরতিকরণ বড়ি নিয়মিত সেবন করলে একদিকে অযাচিত গর্ভধারণ যেমন প্রতিহত করা যায়, তেমনি নানা স্বাস্থ্য সুবিধাও পাওয়া যায়। সুমনা ও শামীম বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে আসে। ডাঃ মুনা সালিমা জাহান প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সহকারী অধ্যাপক স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ এ্যান্ড মিটফোর্ড হসপিটাল, ঢাকা
×