ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

পপি দেবী থাপা

দেশকে ভালবেসে সাবরিনা মুস্তোপো

প্রকাশিত: ০৭:৪৬, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯

দেশকে ভালবেসে সাবরিনা মুস্তোপো

বিদেশে উচ্চশিক্ষার পর লাভজনক চাকরি, বিলাসী জীবন ছেড়ে নিজের দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে ঝাঁপ দেয়ার ক্ষমতা কজনের থাকে? ইন্দোনেশিয়ার এক তরুণী ঠিক সেই ঝুঁকি নিয়ে দেশের মানুষের কল্যাণকে সামনে রেখে এক ব্যবসা শুরু করেছেন। ভূমিকা রাখছেন দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে। সাবরিনা মুস্তোপো। তার নিত্যসঙ্গী সুটকেস, ল্যাপটপ, বিমানের টিকেট- কাজের সূত্রে সাবরিনা মুস্তোপোকে প্রায়ই ভ্রমণ করতে হয়। জন্ম ইন্দোনেশিয়ায় হলেও স্কুলশিক্ষা সিঙ্গাপুরে, আমেরিকার এক নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়েছেন উচ্চশিক্ষা। তবে ২০১৩ সালে তিনি পাকাপাকিভাবে নিজের দেশ ইন্দোনেশিয়ায় ফিরে আসেন। সেখানে তিনি এক কোকো কারখানা চালু করেছেন। দেশের মানুষের ভাগ্য বদলে দিতে ছুটে বেড়াচ্ছেন দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। সাবরিনা বলেন, ‘আমি সব সময়েই ইন্দোনেশিয়ায় ফিরে কিছু একটা গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। সে কারণে আমি কখনও আমার ইন্দোনেশীয় নাগরিকত্ব ছাড়িনি। এখানে অনেক কিছু করার আছে বলে আমি মনে করি। বিপুল সম্ভাবনা সত্ত্বেও আমার দেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তাই আমি ফিরে এসেছি।’ প্রায় ২০০ চাষী তার কোম্পানিতে কোকো বিন বা বীজ সরবরাহ করে। সাবরিনা ঘুরেফিরে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই দেখা করেন। পরিবর্তন চাইলে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তৌফিক হিদায়াতকে কোম্পানির নতুন ব্র্যান্ডের চকলেট চেখে দেখতে দিচ্ছেন। তার ক্ষেতে কোকো বিন উৎপাদন কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, সে বিষয়েও আলোচনা করছেন। তুচ্ছ বিষয়ও গ্রামাঞ্চলে সমস্যা হয়ে উঠতে পারে। সবে গত বছর তৌফিকের বাসায় বিদ্যুত সংযোগ এসেছে। তবে ইন্টারনেট সংযোগ এখনও দূর অস্ত। সাবরিনা বলেন, ‘অবকাঠামোর অবস্থা খুবই খারাপ। ল্যাপটপ খুলে কিছু জানারও উপায় নেই। কোকো বিনসে কালো রং ধরলে তার অর্থ কী, তা জানার জন্য গুগল ঘেঁটে দেখাও সম্ভব নয়।’ কৃষি অর্থনীতিবিদ ও খাদ্যবিজ্ঞানী সাবরিনা সে কারণে শুধু চাষিদের কাছ থেকে কোকো বিন কিনেই সন্তুষ্ট হন না, তাদের প্রশিক্ষণও দেন। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কোকো উৎপাদনকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়ার নিজস্ব কোন চকোলেট ব্র্যান্ড নেই বললেই চলে। সাবরিনা বলেন, ‘আমাদের শুধু কাঁচামাল বিক্রি করা উচিত নয়।’ তৌফিক হিদায়াতও এ বিষয়ে একমত। প্রথমদিকে তার মনে গভীর সংশয় ছিল। তৌফিকের ভাষায়, ‘সাবরিনা যখন প্রথমবার এখানে আসেন, অন্যান্য কোম্পানির তুলনায় বেশি দামে কোকো কেনার প্রস্তাব এবং সেইসঙ্গে পেশাদারি পরামর্শও দেন, তখন আমরা এই, ‘শহরের মেয়ের কাণ্ড দেখে হাসাহাসি করেছিলাম। তারপর আমরা বুঝলাম, যে তিনি সত্যি এই পথে এগোতে চান।’ কোকো বিন থেকে চকোলেট তৈরি করে সাবরিনা ছটি দেশে বিক্রি করছেন। তিনি নিজে বেলজিয়ামের এক বিখ্যাত চকোলেট প্রস্তুতকারী কোম্পানিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। বাবা-মায়ের গ্যারেজে প্রণালী অনুযায়ী প্রথমবার চকোলেট তৈরি করেন তিনি। এখন তার কোম্পানিতে ৫০ জনেরও বেশি কর্মী কাজ করেন। তার মতে, উন্নয়নশীল দেশের তকমা ঝেড়ে ফেলতে হলে সরকারকে শিক্ষাখাতে আরও বিনিয়োগ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হবে। অসংখ্য অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয় বলে তার কোম্পানিও এই সমস্যার ভুক্তভোগী। সাবরিনা মুস্তোপো বলেন, ‘সম্ভব হলে আমরা ঘুস দেই না। কিন্তু কখনও কখনও বাস্তববাদী হতেই হয়। ইন্দোনেশিয়ায় দুর্নীতি কমছে বটে, কিন্তু পুরনো এই সমস্যা যা রাতারাতি লোপ পাবে না। বিবেকের দংশন ছাড়া কোনটা করা যায় বা যায় না, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আমরা কোম্পানি হিসেবে তা বিবেচনা করি।’ সদা ব্যস্ত সাবরিনার হাতে নিজের জন্য তেমন কোনো সময় থাকে না বললেই চলে। গাড়িতে বসেই অনেক সময়ে অফিসের কাজ সারতে হয়। তবে এ নিয়ে তার মনে কোন খেদ নেই। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে, মানুষের ভাগ্য বদলে ভূমিকা রাখতে পেরে তিনি খুশি। বিদেশী কোম্পানির উপদেষ্টা হিসেবে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি মোটেই অনুতপ্ত নন। তার ভাষায়, ‘বিদেশে থাকতে আমি সেরা আইডিয়াগুলো দেখার সুযোগ পেয়েছি। আশা করি সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ইন্দোনেশিয়াকে কিছুটা অগ্রসর করতে পারব।’ সমাজের উঁচুস্তরে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সাবরিনা মুস্তোপো যথেষ্ট সচেতন। তবে তার ভাষায়, ‘আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের অসংখ্য মানুষ কিছু একটা করে দেখাতে চায়।’
×