ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ আশরাফ সহজে সৃষ্টি হয় না

প্রকাশিত: ০৪:০০, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯

সৈয়দ আশরাফ সহজে সৃষ্টি হয় না

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংক্ষিপ্ততম বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রয়োজনীয় সব বক্তব্য তুলে ধরার অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিলেন। আজ তাঁকে অনুসরণ করেই আমি অল্প কথায় এই বিশাল মানুষটির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। মাটির কাছাকাছি থেকেও নিজেকে আকাশের উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারার মতো এক বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। তাঁর মতো আপাদমস্তক সজ্জন, মিষ্টভাষী, নির্লোভ, মোহমুক্ত ও সৎ এবং আদর্শিক রাজনীতিবিদ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা, রুচিবোধ, সংস্কৃতিবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ তাঁকে নিয়ে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। আন্দোলন-সংগ্রামে, দলীয় কর্মকা-ে, সংসদীয় কার্যক্রমে, রাষ্ট্র পরিচালনায় বিভিন্নভাবে তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। ব্যক্তিগতভাবেও তাঁকে জানা-বোঝার সুযোগ হয়েছে। আমার বলতে কোন দ্বিধা নেই, একই সঙ্গে ঈর্ষণীয় ও অনুকরণীয় এরকম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সমকালীন সময়ে আমি খুব একটা দেখি না। বিভিন্ন বিষয়ে ছিল তাঁর অগাধ পা-িত্য। রাজনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাস, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে তার বিচরণ ছিল না। রবীন্দ্রনাথ থেকে শেক্সপিয়ার হয়ে দস্তয়ভস্কি পর্যন্ত অনায়াসে হেঁটে যেতেন আলোচনার পথ ধরে। উন্নয়নমুখী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সর্বত্র তাঁর মতামত ছিল স্পষ্ট এবং দৃঢ়। ইংলিশ লীগ থেকে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ানশিপ সব খবরই ছিল তাঁর জানার পরিধির মধ্যে। ক্রিকেটার অতীত-বর্তমান দুটোই ছিল তাঁর আগ্রহের বিষয়। অথচ মৃদুভাষী এই মানুষটিকে কখনও পা-িত্য জাহির করতে দেখা যায়নি। তাঁর রসজ্ঞান ছিল অসাধারণ। কিভাবে একজন ভিন্ন ধর্মের নারীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে সম্ভব হয়েছিল তার বর্ণনা তিনি যেভাবে দিতেন তা শুনে কোন ব্যক্তির পক্ষে হাসি সংবরণ করা সম্ভব হতো না। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। কিন্তু এই পদ তাঁকে কখনও আচ্ছন্ন করেনি। নিজেকে কিছুটা আড়ালে রেখে সুচারুভাবে দলকে পরিচালনা করেছেন তিনি। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল প্রবাদপ্রতিম। একজন রাজনীতিকের জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু হতে পারে না। দেশের সঙ্কটের সময় এই শান্ত মানুষটিকেই দেখেছি আমরা কঠোর হতে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, হেফাজতি তা-বে খোদ রাজধানীতে যখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল তখন এই সৈয়দ আশরাফই এগিয়ে এসে দৃঢ় ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর সেদিনের সেই দৃঢ়তা অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে আশাবাদ ও সাহস যুগিয়েছিল। আরেকটি কথা না বললেই নয়। আমরা অনেকেই জানি না যে, দেশের স্বার্থের কথা ভেবে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও নীরবে কাজ করে গেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল মারপ্যাঁচে মহাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রক্ষা একটি অতীব দুরূহ কাজ। সেই দুরূহ কাজটি সম্পন্ন করতে সৈয়দ আশরাফ নীরবে ভূমিকা রেখেছেন। আমি অত্যন্ত গর্ব করেই বলতে পারি, সৈয়দ আশরাফের মতো ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসতে পারাটা আমার জীবনে একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা। রাজনীতিবিদ হয়। সংসদ সদস্য হয়। মন্ত্রী হয়। কিন্তু একজন সৈয়দ আশরাফ সহজে সৃষ্টি হয় না। ক্ষমতায় থেকেও ক্ষমতার মোহ থেকে তিনি নিজেকে সব সময় মুক্ত রেখেছেন। তাঁর অন্তিমযাত্রায় লাখো মানুষের ঢল প্রমাণ করে এ দেশের মানুষ সৈয়দ আশরাফের মতো লোককেই নেতা হিসেবে চায়। লাখো মানুষের অশ্রুসিক্ত চোখ এ কথাই বলে, এ দেশের মানুষ সৈয়দ আশরাফের আদর্শকে লালন করতে চায়। লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সংসদ সদস্য
×