ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পৌষ সংক্রান্তি ও সাকরাইন ঘিরে উৎসব আমেজ

পুরান ঢাকায় আজ দিনভর ঘুড়ি উৎসব, রাতে আতশবাজি

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১৪ জানুয়ারি ২০১৯

পুরান ঢাকায় আজ দিনভর ঘুড়ি উৎসব, রাতে আতশবাজি

মোরসালিন মিজান ॥ পৌষ শেষ হলো। শেষ হলো বটে। পার্বণ এখনও বাকি। আজ সোমবার ঘটা করে উদ্যাপন করা হবে পৌষ সংক্রান্তি। হ্যাঁ, পৌষ বিদায়ের দিনটিকে পৌষ সংক্রান্তি হিসেবে উদ্যাপন করা হয়। আজ ঘুড়ি ওড়ানো হবে। থাকবে পিঠাপুলির আয়োজন। গ্রামে তো বটেই, শহরও বহুকাল ধরে অভিন্ন সংস্কৃতি প্রতিপালন করে আসছে। সেই ধারাবাহিকতায় আজ পুরান ঢাকায় আয়োজন করা হবে সাকরাইন উৎসবের। পঞ্জিকার হিসাব বেশ গোলমেলে। তাই একই উৎসব শাঁখারীবাজারে উদ্যাপিত হবে আগামীকাল মঙ্গলবার। পৌষ সংক্রান্তিকে পৌষ পার্বণ বা মকর সংক্রান্তিও বলা হয়ে থাকে। এটি মূলত জ্যোতিষশাস্ত্রের একটি ক্ষণ। মকর সংক্রান্তি বলতে, নিজ কক্ষপথ থেকে সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশের ক্ষণটিকে ইঙ্গিত করা হয়। এ সময় বাংলার ঘরে ঘরে পিঠাপুলি আয়োজনের রীতি প্রচলিত আছে। গ্রীষ্মকালে পিঠাপুলি অত রুচিকর হয় না। আর তাই শীতের কালটিকে বেছে নেয়া হয়। পৌষের শেষভাগে এসে শীত বেড়ে যায়। সে ধারাবাহিকতায় পৌষ সংক্রান্তি হয়ে ওঠে পিঠাপুলির সবচেয়ে বড় উৎসব। লোকজ সংস্কৃতির গবেষকদের মতে, মকর সংক্রান্তি বা উত্তরায়ণ সংক্রান্তির দিন প্রাচীন হিন্দুরা পিতৃপুরুষ ও বাস্তুদেবতার জন্য তিল কিংবা খেজুর গুড় দিয়ে তিলুয়া তৈরি করতেন। নতুন চালে তৈরি পিঠার অর্ঘ্য দান করতেন। এই কারণে পৌষ সংক্রান্তির অপর নাম তিলুয়া সংক্রান্তি বা পিঠা সংক্রান্তি। পৌষ সংক্রান্তির দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে বাস্তুপূজা অনুষ্ঠিত হয়। চলে গৃহদেবতার নবান্নের অনুষ্ঠান। একইদিন দধি সংক্রান্তির ব্রতের শুরু হয়। এই ব্রতে প্রতি সংক্রান্তিতে লক্ষ্মীনারায়ণকে দধি দ্বারা স্নান করিয়ে ব্রাহ্মণকে দধি ও ভোজ দান করা হয়। এদিন বিভিন্ন অঞ্চলে শিশু-কিশোররা বাস্তুর গান, কুলাইর ছড়া, হোলবোলের গান, বাঘাইর বয়াত গেয়ে চাল ও অর্থ সংগ্রহ করে পৌষপালা, বনভোজন ইত্যাদির আয়োজন করে। কারও কারও মনে হতে পারে, পৌষ সংক্রান্তি কোন একটি ধর্মের উৎসব। আসলে তা নয়। এ প্রসঙ্গে লেখক যতীন সরকারের একটি বক্তব্য খুব প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেন, কারও কারও মনে হতে পারে, পৌষ সংক্রান্তি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বৈ কিছু নয়। বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। আবহমানকাল থেকেই বাংলায় ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ নীতি। ফলে পৌষ সংক্রান্তিও বাঙালীর প্রতিঘরে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। সংক্রান্তি উপলক্ষে এখন গ্রামের ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে ভাপা, পাটিশাপটা, সন্দেশ, দুধ চিতই, মুগপুলি, ছিটপিঠা, নকশিপিঠা। মায়েরা-মেয়েরা রাত জেগে পিঠার গায়ে অলঙ্করণ করছেন। ফুল, লতাপাতা, পাখি, মাছের চোখ আঁকছেন। এভাবে গোটা রাত পার হয়ে যাচ্ছে। একদিকে চুলা থেকে পিঠা উঠছে। অন্যদিকে চলে গরম গরম খাওয়া। মায়ের হাতে তৈরি এসব পিঠার স্বাদ বরাবরই বেশি। আজ আত্মীয়-স্বজনদেরও নিমন্ত্রণ করে বাড়ি আনা হবে। খাওয়ানো হবে পিঠা। দূরন্ত কিশোর-তরুণরা সারাদিন ঘুড়ি ওড়াবে আজ। কাটাকাটি খেলবে। পিঠাপুলি ছাড়াও ভাল খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকবে গৃহস্থবাড়িতে। একই উৎসব পুরান ঢাকায় উদ্যাপিত হয় সাকরাইন নামে। আজও তা-ই হবে। জানা যায়, মোগল আমলে ঢাকার নবাবরা এ উৎসবের সূচনা করেন। পৌষের শেষ এবং মাঘের শুরুর ক্ষণে খাজনা আদায় শেষে নবাবরা ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব করতেন। সেই ঐতিহ্য মেনে এখন পুরান ঢাকায় ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করা হয়। আজ সকাল থেকেই বাড়ির ছাদে অবস্থান নেবে সব বয়সী ছেলেমেয়ে। বড়রা বাদ যাবেন না। সবাই মিলে ঘুড়ি ওড়াবেন। হাজার হাজার ঘুড়ি। নামও অনেক। এই যেমন- পঙ্খীরাজ, চাপালিশ, চোখদ্বার, মালাদ্বার, চশমাদ্বার, কাউঠাদ্বার, চানদ্বার। ঘুড়ির মতো বিভিন্ন নাম আছে নাটাইয়েরও। বাটিওয়ালা, মুখবান্ধা, মুখছাড়া। কত কত নাম। নানা রঙের ঘুড়ি ওড়ানো হবে। সেই সঙ্গে চলবে কাটাকাটি খেলা। একই সময় ছাদে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। আর রাতটি হবে দিনের চেয়েও বেশি আলো ঝলমলে। প্রায় প্রতিটি বাসার ছাদে দৃশ্যমান হবে ফায়ার ওয়ার্কস। রঙিন হয়ে উঠবে রাতের আকাশ। থাকবে গানবাজনার ব্যবস্থাও। এত বড় উৎসব হলেও নতুন ঢাকার অনেকে এর সঙ্গে পরিচিত নয়। তাদের জন্য বলা, আজ অন্তত যান। ঘুরে আসুন। এত মুগ্ধ হবেন যে, প্রতিবছর যেতে চাইবেন। আর যদি আজ সময় করতে না পারেন তো কাল শাঁখারীবাজারে যেতে পারেন। আগেই বলা হয়েছে, পঞ্জিকার হিসাবে গন্ডগোল থাকায় শাঁখারীবাজারে আজ মঙ্গলবার উদ্যাপিত হবে সাকরাইন উৎসব।
×