ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আস্থার সঙ্কটে ফেসবুক

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ১৪ জানুয়ারি ২০১৯

 আস্থার সঙ্কটে ফেসবুক

২০১৮ সালটি ছিল ফেসবুকের ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক বছর। আগামী দিনগুলো সংস্থাটির জন্য আরও বেদনাদায়ক হতে পারে। অথচ এক বছর আগেও এ ধরনের ভাবনা অচিন্তনীয় ছিল। এই বিশাল সোশ্যাল-নেটওয়ার্কিং প্রতিষ্ঠানটি নিজের মূল সার্ভিস ছাড়াও ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসএ্যাপ ও ফেসবুক মেসেঞ্জার চালিয়ে থাকে এবং এগুলোর ক্রমশ প্রসার ঘটে চলেছিল। কিন্তু জানুয়ারি মাস থেকেই প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু বিতর্ক, ভ্রান্ত পদক্ষেপ এবং ভুল মূল্যায়নের মতো ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে। পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ২০১৬ সালে মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ ঠেকাতে সংস্থাটি তেমন কিছুই করেনি। উল্টো ফেসবুককে স্বীকার করতে হয়েছে যে, অনুমতি না নিয়েই তারা ৯ কোটি ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য উপাত্ত বাইরের ফার্মগুলোর হাতে দিয়েছে। পরবর্তীকালে ডাটা লঙ্ঘনের অভিযোগ এসেছে ফেসবুকের বিরুদ্ধে সেখানে ৫ কোটি ব্যবহারকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি আরও কিছু দুঃসংবাদ এসেছে ফেসবুকের জন্য। গত ১৪ নবেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক খবরে অভিযোগ করা হয় মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ কি পরিসরে হয়েছিল জাকারবার্গ ও সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেরিল স্যান্ডবার্গ তার গুরুত্বকে ডিরেক্টর বোর্ডের কাছে খাটো করে দেখিয়েছিলেন। তারা দোষটা অন্যান্য ফার্মের ঘাড়ে চাপানোর ও সমালোচকদের স্তব্ধ করার চেষ্টায় এমন কিছু লবিস্ট ও ফার্ম নিয়োগ করেছিলেন যাদের সাধারণত রাজনৈতিক প্রচারাভিযানে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এসব তথ্য প্রকাশ পাওয়ায় এমন ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, ফেসবুক চরম অব্যবস্থাপনায় পড়েছে। ২০১৮ সাল শুরু হওয়ার পর থেকে এর শেয়ারের দাম ২৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বৃহৎ ইন্টারনেট ফার্ম ইয়াহু এক সময় ভরা জোয়ারে ভেসে চলেছিল। তারপর তাতে ধস নামে। অনেকে ইয়াহুর এই পতন দশার সঙ্গে ফেসবুকের বর্তমান অবস্থার তুলনা করে থাকে। তবে এই তুলনা ঠিক নয়। তুঙ্গে থাকার সময়ও ইয়াহু কখনই ফেসবুকের মতো এত বিশাল ও লাভজনক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গর্ববোধ করেনি। তাছাড়া প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র ও দৃশ্যপটও ছিল ভিন্ন। ইয়াহুর পতনের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে অনলাইন সার্চের ক্ষেত্রে ইয়াহু তার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী গুগলের কাছে হেরে গিয়েছিল। ২০১২ সাল থেকে শুরু করে গত বছর ভেরাইজনের কাছে বিক্রি হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ইয়াহুর সিইও ছিলেন মেরিসা মেয়ার। ব্যবহারকারীরা ইয়াহু ত্যাগ করার সময় মেরিসা বিজ্ঞাপনদাতা এবং কর্মচারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারেননি। আজ এমন কোন কোম্পানি নেই যা ফেসবুকের এ্যাপগুলোর সঙ্গে সত্যিকার অর্থে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে পারে। এর আংশিক কারণ হলো, দারুণ সফল ফটো এ্যাপ ইনস্টাগ্রামের মতো প্রতিযোগীদের বিপুল অর্থ দিয়ে নিজের মধ্যে নিয়ে নিয়েছে ফেসবুক। তার ভবিষ্যত পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে এখন এই ইনস্ট্রাগ্রাম। কিন্তু যারা ইয়াহুর ধস দেখেছেন তারা এর মধ্যে অশুভ সাদৃশ্য দেখতে পান। এর এক প্রধান নির্দেশক হলো প্রধান নির্বাহী বদল। মেয়ারকে আনার আগে তিন বছরের মধ্যে ফেসবুকের চারজন প্রধান নির্বাহী এসেছেন আর গেছেন। ফেসবুকের সিংহভাগ ভোটিং শেয়ার জাকারবার্গের নিয়ন্ত্রণে। তিনি যাচ্ছেন না, তবে অনেক শীর্ষস্থানীয় নির্বাহী কর্মকর্তা চলে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে আছেন ইনস্টাগ্রামের প্রতিষ্ঠাতারা, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি এ্যাপ ওকুলাসের প্রধান, হোয়াটসএ্যাপের একজন যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা এবং ফেসবুকের সার্বিক পরামর্শকের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা। যত সিনিয়র লোকজন ফেসবুক ছেড়ে চলে গেছেন এবং যাওয়ার আগে কোম্পানির নিন্দা করেছেন তা নজিরবিহীন। এক কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন মেরিসা মেয়ার দায়িত্ব নেয়ার আগে ইয়াহুর যে দশা হয়েছিল আজকের ফেসবুকের অবস্থাও তাই। ফেসবুক অন ব্লাইন্ড নামে একটি এ্যাপ আছে যেখানে লোকে কাজ নিয়ে আলোচনা করে। ওখানে ফেসবুক পরিস্থিতি নিয়ে নানাজনে নানা মন্তব্য করেছে। এক র্কচারী পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ’ বলে আখ্যায়িত করেছে। এ ধরনের মন্তব্য কর্মচারীদের নৈতিক মনোবলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সেরা হাতগুলো ফেসবুক ছেড়ে কম বিতর্কিত কোম্পানিগুলোতে চলে যেতে পারে। আর থেকে যেতে পারে মাঝারি মানের লোকজন যাদের রেখে দেয়ার জন্য ফেসবুককে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে। ফেসবুক এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে টেক শিল্পের শীর্ষে এক নাজুক ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি। এই নতুন বছরে প্রতিষ্ঠানটিকে বেশ কিছু বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। লোকে ফেসবুকের বিভিন্ন এ্যাপ ব্যবহার কমিয়ে দিতে পারে। এতে ফেসবুকের মুনাফা দারুণভাবে কমতে পারে। ১৮ বছরের উর্ধ বয়সী নারী-পুরুষরা ফেসবুকের মূল সামাজিক নেটওয়ার্কে দু’বছর আগের তুলনায় ৩১ শতাংশ কম সময় ব্যয় করছে। এতে এ্যাড বিক্রি করার সুযোগ কমে আসবে। অবশ্য এই সমস্যা মোকাবেলায় ফেসবুকের জবাবের একটা বড় অংশ হলো ইনস্টাগ্রাম। এটাই বলতে গেলে ফেসবুকের ত্রাণকর্তা। এখন ইনস্টাগ্রামে যত পোস্ট দেখতে পাওয়া যায় তার প্রায় এক প্রথমাংশই হলো বিজ্ঞাপন। এক বছর আগে বিজ্ঞাপন যা ছিল এখন তা সম্ভবত দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞাপন এত বৃদ্ধি পাওয়ায় লোকে বিরক্তিবোধ করতে পারে। তারা ফেসবুক ব্যবহার যেমন কমিয়ে দিয়েছে তেমনি ইনস্টাগ্রামের পেছনে কম সময় ব্যয় করাই বাঞ্ছনীয় বলে মনে করতে পারে। ইতোমধ্যে ব্যবহারকারীরা এমন সব প্রোডাক্টের পেছনে অধিকতর সময় ব্যয় করছে সেগুলোতে বিজ্ঞাপন প্রচারের একই রকম সুযোগ-সুবিধা নেই। ব্যবহারকারীদের দৈনন্দিন জীবন ও অভিজ্ঞতার ধারাবাহিক বিবরণের ছবি ও ভিডিও পরিবেশনের একটি ধারণা আছে যাকে বলা হয় ‘স্টোরি’। স্প্যাপ নামে একটি ম্যাসেজিং এ্যাপ এই ‘স্টোরি’র পথিকৃৎ। ফেসবুক এটাকে অনুকরণ করেছে মাত্র। ইনস্টাগ্রাম ও ফেসবুক উভয়ের ক্ষেত্রে এই স্টোরি জনপ্রিয়। নিউজফিড বলে অভিহিত প্রচলিত ল্যান্ডিং পেজগুলোতে লোকে পোস্ট দেখে বেড়ায় এবং সেগুলোর মাঝে বিজ্ঞাপন ছড়ানো থাকে। এগুলোর তুলনায় লোকের ব্যক্তিগত স্টোরিতে বিজ্ঞাপন পরিবেশনের সুযোগ ও স্থান কম থাকে। হোয়াটসএ্যাপের মতো ম্যাসেজিং এ্যাপগুলোরও জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তবে বর্তমানে লোকসানও গুনছে। ফেসবুক অনিবার্যরূপে এ্যাড পরিবেশন করবে এবং তা জেনে হোয়াসএ্যাপের যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতারা প্রতিষ্ঠানটি ছেড়ে চলে গেছেন। তবে ফেসবুক এটাও জানে সে এমন একটা পরিবেশে এাড চালু করার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন যেখানে লোকে ব্যক্তিগত পরিসরে যোগাযোগ করে থাকে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলোর কনটেন্ট পাবলিক পরিসরে ব্যবহার করা থেকে অধিকতর ব্যক্তিগত বা ঘরোয়া পরিসরে যোগাযোগ স্থাপনের এই যে উত্তরণ এটাই ফেসবুকের ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝুঁকি। জাকারবার্গও সে কথা স্বীকার করেছেন এবং এই উত্তরণকে ডেস্কটপ কম্পিউটার থেকে মোবাইলে উত্তরণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেছেন যে স্টোরি ও ম্যাসেজিং থেকে অর্থোপার্জনে কিছু সময় লাগবে এবং ফেসবুকের আয়বৃদ্ধি মন্থর হতে পারে। নতুন প্রোডাক্টগুলো ফেসবুকের মূল প্রোডাক্টের মতো আকর্ষণীয় কখনও হতে পারবে কি না তা অবশ্য অপরীক্ষিতই রয়ে গেছে। ফেসবুকের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে ঝড় উঠেছে। ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার পেছনে ফেসবুকের ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ আছে। এই সামাজিক মাধ্যমে সেই সময় পরিবেশিত বেশ কিছু এ্যাড ভোটারদের প্রভাবিত করেছিল। তবে এই সংক্রান্ত বিতর্ক ফেসবুকের প্লাটফর্ম ব্যবহারে বিজ্ঞাপনদাতাদের উৎসাহ-উদ্দীপনাকে এখনও পর্যন্ত ম্লান করতে না পারলেও পরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতেও পারে। বিপণন শিল্পের দুটো প্রধান অভিযোগ আছে- একটা হলো ব্যবহারকারীদের এ্যাডের ক্ষেত্রে আগে ফেসবুক যেমন ভাল ভূমিকা পালন করত এখন তেমন করছে না। দ্বিতীয়ত ফেসবুক গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করছে। নিউইয়র্কের পাইভোটাল রিসার্চ নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ব্রায়ান ওয়াইজার ফেসবুককে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে কোম্পানিটি ১৮ থেকে ৩৪ বছর বয়সের অধিক সংখ্যক আমেরিকানের কাছে পৌঁছতে পারছে বলে বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে যে দাবি করেছে তা সঠিক নয়। দর্শক সংখ্যা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে বেশি করে দেখানোর অভিযোগে ফেসবুকের বিরুদ্ধে মামলা করা সত্ত্বেও কোম্পানিটি এখনও ওই দাবি থেকে সরে আসেনি। ফেসবুকের ওপর বিজ্ঞাপন দাতাদের আস্থার ভিত যেমন টলে উঠেছে তেমনি আবার ওয়াশিংটনের রাজনীতিকরা এই কোম্পানির ওপর ধৈর্যহারা হয়ে পড়ছেন। ফেসবুকের কার্যকলাপ উল্লেখযোগ্যতভাবে খর্ব করার জন্য নতুন আইন প্রবর্তিত হবে তেমন সম্ভাবনা নেই বলেই মনে হয়। তবে আইন প্রণেতারা প্রতিষ্ঠানটির কার্যকলাপ যেভাবে খতিয়ে দেখছেন তাতে ফেসবুক ডাটা ব্যবহারে অধিকতর সতর্ক হচ্ছে। এর ফলে বাজারের চোখে ফেসবুকের আকর্ষণ কমবে। সুতরাং জাকারবার্গ ও স্যান্ডবার্গকে গ্রাহক ও বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে প্রমানণ করতে বেগ পেতে হবে যে ফেসবুক শুধু বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজনই নয় উপরন্তু ফেসবুকের পেছনে অর্থ ও সময় ব্যয় করা যথেষ্ট অর্থবহ। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×