ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কোটি কোটি টাকা ছড়ানো হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ১৪ জানুয়ারি ২০১৯

  কোটি কোটি টাকা ছড়ানো হচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ সহায়ক বইয়ের নামে ডজন দেড়েক পাবলিকেশন যশোর অঞ্চলে ১শ’ কোটি টাকার নিষিদ্ধ নোট গাইড বিক্রির টার্গেট নিয়ে মাঠ চষছে। জেলা প্রশাসন ও জেলা শিক্ষা প্রশাসন তথা সরকারী নির্দেশনা ভূলুণ্ঠিত করে ওই নোট গাইড ছাত্রদের ধরাতে এ অঞ্চলের শিক্ষকদের ম্যানেজ করতে কোটি কোটি টাকা ছড়ানো হচ্ছে বলে তথ্য মিলেছে। গত ডিসেম্বরে বার্ষিক পরীক্ষা চলাকালে বিভিন্ন পাবলিকেশনের শতাধিক কর্মী প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক-সভাপতি ও বিভিন্ন শিক্ষক সমিতির নেতাদের কাছে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। আর নতুন বছরে ক্লাস শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে টাকার ছড়াছড়ি। বৃহত্তর যশোরের ৪ জেলার প্রত্যেকটি উপজেলায় বান্ডিল বান্ডিল টাকা নিয়ে এখন ছুটছেন নিষিদ্ধ গাইড সরবরাহকারী পাবলিকেশনগুলোর লোকজন। যশোর জেলা শিক্ষা অফিসের একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০০৮ সাল থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে দু-একটি বিষয় ছাড়া বেশির ভাগ বিষয় সৃজনশীল পদ্ধতির আওতায় আনা হয়। শিক্ষার্থীদের মুখস্ত বিদ্যা পরিহার, গাইড বই ও কোচিংনির্ভরতা কমানোর জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই সৃজনশীল পদ্ধতির প্রচলন করলেও তা ভেস্তে দেয়ার চেষ্টা করছে চিহ্নিত সব প্রকাশনী ও তাদের সহযোগী অসাধু শিক্ষকরা। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, মূলত নোট গাইড চালাতে বার্ষিক পরীক্ষার পরপরই বিভিন্ন প্রকাশনা কোম্পানির কর্মী বাহিনী মাঠে নেমে পড়ে। আর এখন ছুটছেন বান্ডিল বান্ডিল টাকা নিয়ে। বিভিন্ন লাইব্রেরিতেও মোটা অংকের কমিশন ও উপঢৌকন দিয়ে এরা গাইড ঢোকাচ্ছে। আর তা বিক্রি নিশ্চিত করতে এবার কোটি কোটি টাকা উৎকোচ দেয়া হচ্ছে। চিহ্নিত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বৃহত্তর যশোরের ৪ জেলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সভাপতি, প্রধান শিক্ষক, এলাকার শিক্ষক নেতা, এমনকি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা পর্যায়ে ম্যানেজ ও দেনদরবার কার্যক্রম চালাচ্ছে। অধিকাংশ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের স্কুলে পৌঁছে গেছে পাবলিকেশনের লোকজন। গাইড পড়তে বা কিনতে উৎসাহিত না করতে জেলা প্রশাসক ও জেলা শিক্ষা আফিসারের সামনে শপথ করলেও শিক্ষক নেতা নামধারী চিহ্নিতরা নির্লজ্জের মতো তা ভুলে গিয়ে গাইড চালাতে জোর তৎপরতা ছালিয়ে যাচ্ছেন। সূত্র জানিয়েছে, পপি পাবলিকেশন, লেকচার পাবলিকেশন, গ্যালাক্সি, নিউটন পাবলিকেশন, স্কয়ার, আশার আলো পাবলিকেশন, পুঁথিঘর পাবলিকেশনের সংসদ, ফুলকুড়ি পাবলিকেশন, গ্রালাক্সি পাবলিকশেনসহ ডজন দেড়েক পাবলিকেশন এখন মাঠে টাকা ছড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আশার আলো পাবলিকেশন প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত গাইড ছাপিয়ে বাজারজাত করছে। মাঠ চষছে হাফ ডজন কর্মী। পুঁথিনিলয় পাবলিকেশনের পক্ষে মাঠে নেমেছেন এক ধুরন্ধর। একইভাবে প্রত্যেক পাবলিকেশন ৪ জেলার প্রতিটি উপজেলায় লোক লাগিয়ে শিক্ষক ও স্কুল ধরতে ব্যস্ত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র গুনে প্রধান শিক্ষকের হাতে মাথাপ্রতি ৪০ টাকা ও মাধ্যমিকে ছাত্র মাথাপ্রতি প্রধান শিক্ষক ও সভাপতিকে ৭০ টাকা করে দেয়ার চুক্তি হচ্ছে বলে তথ্য এসেছে। সূত্রের দাবি, প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতি ১ লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ দিতে মরিয়া পাবলিকেশনগুলো। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কয়েকটি শিক্ষক সমিতি ইতোমধ্যে কয়েকটি পাবলিকেশনের কাছ থেকে টাকা গ্রহণও করেছে। গাইডের মান যায় হোক না কেন, তা যে কোন উপায়ে চালাতে ওই টাকা আগাম নিয়েছেন তারা। অভিভাবক বলেছেন, গাইডের দাম আকাশ ছোয়া হাঁকিয়ে মূলত পাবলিকেশনগুলো উৎকোচ দেয়া টাকা তুলে নিচ্ছে। কয়েকটি কোম্পানির গাইড ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেলেও জিম্মি দশায় পড়ে সন্তানের পড়ালেখার কথা চিন্তা করে কষ্ট হলেও কিনতে বাধ্য হতে হচ্ছেন অভিভাবকরা। অভিভাবকদের আরও অভিযোগ, শিক্ষাব্যবস্থা সৃজনশীল হলেও শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের নীরবতার কারণে যশোরের বই বাজার গাইডে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। যশোর শহর ও শহরতলীর কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম শ্রেণী পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে গাইড কিনতে নির্দেশনা দেন স্যারেরা। কয়েক অভিভাবকের অভিযোগ, শিক্ষক সমিতি থেকে উৎকোচের বিশেষ অংশ পেয়ে গাইড কিনতে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন স্কুলের শিক্ষকরা। সরকার শিশু শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল বই দিলেও শিক্ষকরা তা পড়ান না। আর তারা শিশু শিক্ষার্থীদের গাইড কিনতে বলেন। সচেতন মহল বলছে, নোট গাইডের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদফতর, মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও জেলা শিক্ষা অফিসের জোরালো বক্তব্য কোনো কাজেই আসছে না। এ ব্যাপারে কথা হয় যশোর জেলা শিক্ষা অফিসার এএসএম খালেকের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, কোন সহায়ক গাইড বা সহায়ক বই গ্রহণযোগ্য নয়। কোন শিক্ষক গাইড বিক্রেতা বা প্রকাশনীর সঙ্গে সখ্য গড়লে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
×