ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গার্মেন্টস ভাংচুর করা হচ্ছে সন্ত্রাসীদের দিয়ে

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৩ জানুয়ারি ২০১৯

 গার্মেন্টস ভাংচুর করা হচ্ছে সন্ত্রাসীদের  দিয়ে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ গার্মেন্টস সেক্টরকে অস্থিতিশীল করতে পরিকল্পিতভাবে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের দিয়ে বিভিন্ন কারখানায় ভাংচুর করানো হচ্ছে। মূলত গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন চাঙ্গা রাখতেই এমন কৌশল নিয়েছে গার্মেন্টস শ্রমিকদের কিছু কিছু সংগঠনের কতিপয় অসাধু নেতা। চলমান গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনে ভাংচুর চালানোর সঙ্গে সরাসরি জড়িত দুই মাস্টারমাইন্ডসহ পাঁচ জন র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা গার্মেন্টসে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত থাকলেও, তাদের মূল কাজই হচ্ছে আন্দোলনের সময় গার্মেন্টস শ্রমিক নেতৃবৃন্দের কথামতো নাশকতা ও ভাংচুর চালানো। তাদের প্রধান কাজই হচ্ছে, টাকার বিনিময়ে শ্রমিক নেতৃবৃন্দের নির্দেশনা মোতাবেক বিভিন্ন গার্মেন্টসে ভাংচুর ও নাশকতা চালানো। ইতোমধ্যেই গ্রেফতারকৃতরা চলমান আন্দোলন আরও চাঙ্গা রাখতে টঙ্গী এলাকার নয়টি গার্মেন্টসে ভাংচুর চালানোর কথা স্বীকার করেছে। ভাংচুর করার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে আন্দোলন জিইয়ে রাখা। তাদের নির্দেশদাতা বেশ কয়েকজন গার্মেন্টস শ্রমিক নেতার মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড রয়েছে র‌্যাবসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে। সেসব কল রের্কডের পর্যালোচনা চলছে। ওইসব নির্দেশদাতা শ্রমিক নেতাদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা লাভের পর পরই গার্মেন্টস সেক্টর অশান্ত হয়ে উঠে। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের যেসব এলাকায় তুলনামূলক বেশি গার্মেন্টস কারখানা আছে, সেসব এলাকায় ব্যাপক আন্দোলন হচ্ছে। আন্দোলনের আড়ালে অনেক গার্মেন্টসে ভাংচুর চালানো হয়েছে। টানা আন্দোলনের মধ্যে বহু গার্মেন্টস কারখানায় ব্যাপক ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। গার্মেন্টসে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি করছে পুলিশ ও র‌্যাবসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, যেসব গার্মেন্টসে ভাংচুর হয়েছে, সেসব গার্মেন্টসের নিরাপত্তায় থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে। ফুটেজের পর্যালোচনা চলছে। সেই ফুটেজে পাওয়া ছবি মোতাবেক হামলাকারীদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। অভিযানের ধারাবাহিকতায় র‌্যাব-১ এর একটি দল গত ১১ জানুয়ারি শুক্রবার রাত চারটার দিকে গাজীপুর জেলার টঙ্গীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গার্মেন্টসে ভাংচুর ও নাশকতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছে, মোঃ শামীম (২৪), পিতা- মোঃ আবদুল মতিন, মাতা- মোসাঃ সাজেদা বেগম, গ্রাম- লাউতলী, পোস্ট- মুখী, থানা- গফরগাঁও, জেলা- ময়মনসিংহ। সে টঙ্গীর মিরাশ পাড়ার নুরুল আমিনের বাড়িতে ভাড়ায় থাকত। মোঃ রোমান (২৭), পিতা- মোঃ মজিবুর রহমান, মাতা- মোসাঃ মোর্শেদা বেগম, গ্রাম ও পোস্ট- খাগডহর, থানা- কোতোয়ালি, জেলা- ময়মনসিংহ। সে টঙ্গীর পাগাড় হাজী মার্কেট, পাঠানপাড়ার শরিফুলের বাড়ির ভাড়াটিয়া। মোঃ আলমগীর হোসেন (২৪), পিতা- মোঃ শহিদুল ইসলাম, মাতা- মোসাঃ পিয়ারা বেগম, গ্রাম- নতুনদাতপুর, ডাকঘর- বালশাবাড়ি, থানা- উল্লাপাড়া, জেলা- সিরাজগঞ্জ। সে টঙ্গীর হাজী পাঠানের বাড়ির ভাড়াটিয়া। মোঃ আবু সাঈদ (৩২), পিতা- মোঃ আবুল কাশেম, মাতা- মোছাঃ ফিরোজা বেগম, গ্রাম ও পোস্ট- প্রতাপপুর, থানা- দাগনভূঁইয়া, জেলা- ফেনী। সে টঙ্গীর আরিচপুর এলাকার হাজী বাড়ি মোড়ের মুকুল মিয়ার বাড়ির ভাড়াটিয়া। মোঃ সোহেল সরকার (২৪), পিতা- মৃত চাঁন মিয়া সরকার, মাতা- মোসাঃ সোনাভান বেগম, গ্রাম- শক্তিপুর, পোস্ট- কোচা শহর, থানা- গোবিন্দগঞ্জ, জেলা- গাইবান্ধা। সে টঙ্গীর গোপালপুর কাঁচাবাজার এলাকার সুমির বাড়ির ভাড়াটিয়া। র‌্যাব-১ অধিনায়ক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, গ্রেফতারকৃতরা টঙ্গীর ট্রিবলি এ্যাপারেলস লিমিটেড নামের গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক হিসেবে কর্মরত। শ্রমিক হলেও তারা গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাঠ পর্যায়ের নেতা। তাদের মূল কাজই হচ্ছে, চাকরির পাশাপাশি গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনে পরিকল্পিতভাবে নাশকতা চালানো। এজন্য তারা গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকে। এবারও ঠিক তাই হয়েছে। গার্মেন্টসে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর পরই তারা গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের উর্ধতন নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। উর্ধতন নেতাদের তাদের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, নেতারা তাদের বলে, তোমরা মাঠে নেমে যাও। ভাংচুর চালাও। নতুবা আন্দোলন বেশি দিন টিকবে না। আর আন্দোলন না টিকলে তোমাদের দাবি পূরণ হবে না। তাদের কথামতো গ্রেফতারকৃতরা আরও অন্তত ৪০/৫০ জনকে ম্যানেজ করে। এরপর তারা দলে দলে ভাগ হয়ে টঙ্গী এলাকার গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে এক এক করে ভাংচুর চালাতে থাকে। এমন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গ্রেফতারকৃতদের নির্দেশে এবং তারা নিজেরা উপস্থিত থেকে গত ৯ জানুয়ারি টঙ্গীতে পেট্রিয়ট, জিনস এ্যান্ড পলো, গুল্ড স্টার, রেডিসন-১, নর্দান ও সুমি গার্মেন্টসহ নয়টি গার্মেন্টসে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলছেন, নয়টি গার্মেন্টসে ব্যাপক ভাংচুর চালানোর মাস্টারমাইন্ড হিসেবে তিন জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরাও মাস্টারমাইন্ড হিসেবে তিন জনের নাম প্রকাশ করেছে। প্রত্যেক মাস্টারমাইন্ড তিনটি করে মোট নয়টি গার্মেন্টসের ভাংচুরের নেতৃত্ব দিয়েছে। ওই তিন মাস্টারমাইন্ড হচ্ছে, সোহেল, আলমগীর ও সোহাগ। তিন জনের মধ্যে একমাত্র সোহাগকে গ্রেফতার করা যায়নি। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। সোহাগ একজন গার্মেন্টস শ্রমিক হলেও পেশাদার নাশকতাকারী। শুক্রবার রাত সাড়ে তিনটার দিকে তাকে গ্রেফতার করতে তার বাসায় অভিযান চালানো হয়। তাকে পাওয়া যায়নি। তার ঘরে তল্লাশি চালিয়ে দেখা গেছে, সে যেখানে থাকে, সেখানকার জানালার গ্রিল কাটা। কাটা গ্রিল আলগা করে লাগানো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালালে সেই গ্রিল সরিয়ে পালিয়ে যায়। শুক্রবার রাতে অভিযানকালেও সোহাগ সেভাবে পালিয়ে যায়। গ্রেফতারকৃতরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের বেশ কিছু শীর্ষ নেতার নাম প্রকাশ করেছে। যাদের নির্দেশে গার্মেন্টস সেক্টরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ওইসব নেতাদের অনেকেরই মোবাইল ফোনের কথোপকথন তাদের হাতে রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন মাধ্যমেও তাদের কাছে গার্মেন্টসে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার তথ্য আছে। সেই তথ্য মোতাবেক নেপথ্যের কারিগরদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। মূলত গার্মেন্টস সেক্টরে অরাজকতার সঙ্গে একটি গোষ্ঠীর উস্কানি আছে। ওই গোষ্ঠীর উস্কানিদাতাদেরও আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ২০১০ সাল থেকেই চক্রটি বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টরকে নানা অজুহাতে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তারই ধারাবাহিকতায় পুলিশ ও র‌্যাবের হাতে গার্মেন্টস সেক্টরে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির ইন্ধনদাতা হিসেবে এ্যাডভোকেট মন্টু ঘোষ, মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটি নামের একটি শ্রমিক সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার ও পরিচালক বাবুল আকতার, শ্রমিক নেত্রী শাহনাজ ওরফে শানু, আসমা বেগম, পারুল, শাহনাজ বেগম, রুপা ও পারভীনসহ অন্তত ৭৬ জন গ্রেফতার হয়েছিল। সূত্র বলছে, গার্মেন্টস সেক্টর অস্থিতিশীল করার নেপথ্যে গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের অন্তত ২০ জন নেতা জড়িত। যারা নামেই গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা। অথচ জীবনে কোন দিনই গার্মেন্টসে কাজ করেননি। এসব নেতাদের প্রায় সবাই একেক জন ২৫/৩০ বার করে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। প্রসঙ্গত, বিদায়ী বছরের জুলাইতে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি মাসিক ১৬ হাজার টাকার পরিবর্তে ৬ হাজার ৩৬০ টাকা দেয়ার প্রস্তাব করেন মালিকরা। এ সংক্রান্ত গঠিত বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থাকা জাতীয় শ্রমিক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক শামসুন্নাহার ভূঁইয়া ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ২০ টাকা করার প্রস্তাব দেন। এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেও ওই সময় আন্দোলন চলছিল। উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১ ডিসেম্বর তিন হাজার টাকা মূল বেতন ধরে পোশাক শ্রমিকদের সর্বশেষ ৫ হাজার ৩০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে সরকার। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ওই বেতন পেতে শুরু করেন শ্রমিকরা। এরপর গত বছরের ১৪ জানুয়ারি শ্রম মন্ত্রণালয় স্থায়ী মজুরি বোর্ড পুনর্গঠন করে দেয়। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন বোর্ড গঠনের আগ থেকেই ১০ হাজার টাকা মূল বেতন ধরে মোট ১৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। মজুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বোর্ড সভায় জানান, দুই পক্ষের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করে অতি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি এ্যাডভোকেট মন্টু ঘোষের সভাপতিত্বে এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেনের পরিচালনায় বেতনভাতা বাড়ানো সংক্রান্ত নানা কর্মসূচী পালিত হয়। শনিবারও বিক্ষোভ, ভাংচুর ॥ অর্থনৈতিক রিপোর্টার জানান, বকেয়া বেতন, ন্যূনতম মজুরিসহ নানা দাবিতে শনিবার মিরপুরের শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১৪, টোলারবাগ, বাংলা কলেজের সামনে ও টেকনিক্যাল এলাকায় সড়ক অবরোধ করে রাখে গার্মেন্টস কর্মীরা। সকাল ১০টা থেকে সড়ক অবরোধের দরুন যান চলাচল বন্ধ র্ছিল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। এক পর্যায়ে মালিকদের অনুরোধ ও পুলিশ মাইকে ঘোষণা দিলে শ্রমিকরা পিছু হটে। শনিবার বিকেল ৩টার দিকে প্রায় পুরো এলাকা অবরোধমুক্ত হলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়ে আসে। এর আগে গত রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা পাঁচদিন রাজধানী, সাভার ও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। একদিনের বিরতিতে আবার শনিবার রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভে নামেন তারা। এদিকে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে শনিবারও গাজীপুরের বিভিন্নস্থানে বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কর্মবিরতি, বিক্ষোভ ও ভাংচুর করেছেন। শনিবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সকাল ১০টার পর থেকে মিরপুরের শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১৪, টোলারবাগ, বাংলা কলেজের সামনে ও টেকনিক্যাল এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন আশপাশের এলাকার পোশাক শ্রমিকরা। সকাল সাড়ে ১০টা থেকেই রাজধানীর শেওড়াপাড়া ও মিরপুর-১৪ এলাকায় নেমে আসেন শ্রমিকরা। এর ফলে পুরো এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কাফরুল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আশরাফ বলেন, শেওড়া পাড়ায় শ্রমিকরা নামলেও কিছুক্ষণ পর তারা সরে যেতে রাজি হলেও মিরপুর-১৪ এলাকার রাস্তায় অবস্থান করে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। এরপর বাংলা কলেজ-টেকনিক্যাল মোড় এলাকার সড়কেও পোশাক শ্রমিকরা অবস্থান নেন। এসময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা একটি মোটরসাইকেল ও একটি প্রাইভেটকার ভাংচুর করেন। ডিএমপির মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মোঃ জামাল হোসেন জানান, গত কয়েকদিনের মতো শনিবার মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় শ্রমিকরা রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ করেন। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসব এলাকায় বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এ সময় সেখানে উপস্থিত হয়ে গার্মেন্টস মালিকরা শ্রমিকদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা কাজে ফিরে যান। সরকার যে বেতন কাঠামো ঠিক করেছে সে অনুযায়ী আপনাদের বেতন দেয়া হবে। যদি সরকারী নিয়ম অনুয়ায়ী বেতন দিতে না পারি তাহলে ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেব। যদি ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দেই- সেক্ষেত্রে আমার ফ্যাক্টরিতে কর্মরত শ্রমিকদের অগ্রিম এক মাসের বেতনও দেয়া হবে। পদের আশ্বাসের পর শ্রমিকরা কিছুটা নমনীয় হন। এরপর গার্মেন্টস মালিক ও পুলিশের আশ্বাসে তারা সড়ক থেকে সরে যান। এর ফলে প্রায় ৫ ঘণ্টা পর মিরপুরের বিভিন্ন সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। শ্রমিকদের অভিযোগ, তাদের জন্য সরকার ঘোষিত নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণ করলেও মালিকপক্ষ তা দিচ্ছে না। এদিকে, মালিকপক্ষের কাছ থেকে বার বার আশ্বাস সত্ত্বেও বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে তারা। মিরপুর-১৪ নম্বরে হাফিজুর রহমান নামে একজন পোশাক শ্রমিক অভিযোগ করে বলেন, আমাদের যে এক মাসের মধ্যে সব ঠিক করে দেবেন এটা মিথ্যা আশ্বাস। এমন অনেক শুনেছি। তাই দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাস্তায় নামতেই থাকব। এদিকে বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে শনিবারেও গাজীপুরে বিভিন্নস্থানে বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কর্মবিরতি, বিক্ষোভ ও ভাংচুর করেছে। টঙ্গীতে আন্দোলনরত ৫ শ্রমিককে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা তুলে নেয়ার খবরে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানা ও গাড়ি ভাংচুর এবং মহাসড়ক অবরোধ করেছে। এসময় একাধিক পয়েন্টে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়েছে। এতে কয়েকজন আহত হয়। শ্রমিক অসন্তোষের মুখে এদিন জেলার প্রায় অর্ধশত কারখানা ছুটি ঘোষণা করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। পুলিশ ও শ্রমিকরা জানায়, সরকার ঘোষিত মজুরি কাঠামোয় বৈষম্যের অভিযোগে তা দূর করে ন্যূনতম বেতন ভাতা বৃদ্ধি ও বাস্তবায়নের দাবিতে শনিবারেও গাজীপুরের বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ করেছেন। এদিন ওই দাবিতে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কোনাবাড়ি, টঙ্গী, গাজীপুরা, ভোগড়া, চান্দনা চৌরাস্তা, ইসলামপুর, সাইনবোর্ড, বোর্ডবাজার ও নলজানী এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা সকাল হতে কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ শুরু করে। একপর্যায়ে শ্রমিকরা মিছিল নিয়ে কারখানা থেকে বেরিয়ে আসে। এসময় তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য তারা আশপাশের বিভিন্ন কারখানায় গিয়ে শ্রমিকদের আহ্বান জানায় এবং কারখানায় ইটপাটকেল ছুড়ে ভাংচুর করে। বিক্ষোভকারীরা ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ ও গাড়ি ভাংচুর শুরু করে। এতে মহাসড়কগুলোর কয়েকস্থানে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় মহাসড়কের ওপর থেকে অবরোধকারীদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে শ্রমিকদের সঙ্গে শিল্প পুলিশ, থানা পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে কয়েকজন আহত হয়। এদিকে টঙ্গী বিসিক এলাকার এক কারখানার শ্রমিক নাজমুলসহ কয়েক শ্রমিক জানান, বেতনভাতা বৃদ্ধির দাবিতে শনিবার টঙ্গী বিসিক এলাকার বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা সকাল হতে আন্দোলন করছিল। এ সময় স্থানীয় ট্রিপল ই (ট্রাইভল) পোশাক কারখানার পাঁচ শ্রমিককে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা ধরে নিয়ে গেছে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে ওই এলাকার বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং তারা কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা পার্শ্ববর্তী টঙ্গী স্টেশন রোড মোড় এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও টঙ্গী-নরসিংদী সড়ক মোড়ের ওপর অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করতে থাকে। এ সময় তারা বেশ কয়েকটি গাড়ির কাঁচ ভাংচুর করে। পুলিশ অবরোধকারীদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলে শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওই কারখানাসহ ওই এলাকার প্রায় ৪০টি কারখানা শনিবারের জন্য ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। ছুটি ঘোষণার পর এসব কারখানার শ্রমিকরাও কারখানা থেকে বেরিয়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে সড়কে নেমে পড়লে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও টঙ্গী-নরসিংদী সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। টঙ্গী (পূর্ব) থানার ওসি মো. কামাল হোসেন জানান, খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাদের বুঝিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা পর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও টঙ্গী-নরসিংদী সড়ক থেকে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সরিয়ে দিলে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। তিনি আরো বলেন, শ্রমিক অসন্তেষের ফলে স্থানীয় বিসিক এলাকার প্রায় ৪০টি কারখানা শনিবারের জন্য ছুটি হয়ে যায়। তবে সাদা পোশাকে পাঁচ শ্রমিককে ধরে নেয়ার খবরের সত্যতা স্বীকার করে ওসি কামাল বলেন, তাদের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে কারা বা কি কারণে তাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সে ব্যাপারে কোন তথ্য জানাতে পারেননি তিনি। এ ব্যাপারে স্থানীয় কয়েকটি কারখানার কর্মকর্তারা জানান, কারখানার কর্তৃপক্ষ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বেতন ভাতা শ্রমিকদের দিচ্ছে। কিন্তু বহিরাগত কিছু শ্রমিক বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের জোরপূর্বক কারখানা থেকে বের করে নিয়ে গিয়ে সড়কে গ-গোল করেছে। ভুল ধারণা থেকে শ্রমিকরা অযৌক্তিকভাবে এ আন্দোলন করছে। সরকার ঘোষিত বেতন কাঠামোয় পোশাক কারখানার সিনিয়র-জুনিয়র অপারেটরদের মূল বেতনসহ আনুষঙ্গিক খাতের ভাতাদি বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকারের আগের ঘোষিত গেজেটে কর্মীদের দক্ষতা অনুযায়ী তাদের গ্রেড নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাদের বেতন ভাতা কম দেয়ার কোন সুযোগ নেই। অথচ বিভিন্ন মহল সিনিয়র ও দক্ষ অপারেটরদের ভাতাদি বৃদ্ধি করা হয়নি বলে গুজব ছড়িয়ে আন্দোলনে ইন্দন দিচ্ছে। এতে শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লে তারা অযৌক্তিকভাবে বেতন ভাতা বাড়ানোর দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ ও আন্দোলন করে ভাংচুর করে আসছে। শ্রমিক অসন্তোষ পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কারখানা দেখা দিচ্ছে। ইতোমধ্যে শ্রমিক অসন্তোষের মুখে বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এসব কারখানা খুলে দেয়া হবে। শিল্পাঞ্চল পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ সাহেব আলী পাঠান জানান, সরকার ঘোষিত মজুরি কাঠামো অনুযায়ী বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করে আসছে। শ্রমিক অসন্তোষের মুখে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শনিবার গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের ভোগড়া বাইপাস সড়ক এলাকার স্কয়ার, চান্দনা-চৌরাস্তা ও আশেপাশের এলাকার বডি ফ্যাশন, টিএনজেড, টপ নিট ওয়্যার, কোনাবাড়ির রেজাউল গার্মেন্টস, টঙ্গী থানাধীন গাজীপুরার মন্ডল গ্রুপ, ওরিয়ন ও নিপ্পন, নলজানী এলাকার কোজিমা এবং টঙ্গী বিসিক এলাকার প্রায় সবক’টিসহ জেলার প্রায় অর্ধশত পোশাক কারখানা শনিবারের জন্য ছুটি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এসব এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি কারখানা কর্তৃপক্ষ ওইসব কারাখানা বন্ধ ঘোষণা করে নোটিশ টানিয়ে দিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এসব কারখানা বন্ধ থাকার কথা ওই নোটিশে উল্লেখ করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।
×