ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে শ্রম মন্ত্রণালয়

গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতনের অসঙ্গতি দূর আজকের মধ্যে

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১৩ জানুয়ারি ২০১৯

  গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতনের অসঙ্গতি দূর আজকের মধ্যে

এম শাহজাহান ॥ প্রায় ৫১ শতাংশ বাড়িয়ে ন্যূনতম বেতন আট হাজার টাকা করার পরও কয়েকটি গ্রেডের সামান্য অসঙ্গতিকে কেন্দ্র করে অস্থির দেশের পোশাকখাত। বেতনের এই অসঙ্গতি সামনে রেখে মালিক-শ্রমিক ও শ্রমিক নেতারা একে অপরকে ভুল বুঝছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কোন শ্রমিকের বেতন কমবে না, অসঙ্গতি দূর হবে আজ রবিবারের মধ্যে। সঙ্কট নিরসনে শনিবার জরুরী ভিত্তিতে শ্রম মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করে বেতনের অসঙ্গতি দূর করতে গঠিত পর্যালোচনা কমিটি। মালিক পক্ষ বলছে, বেতন ও মজুরি নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তা ফ্যাক্টরি পর্যায়েই সমাধান সম্ভব। এই আন্দোলনে উস্কানি রয়েছে। তাদের মতে, বিএনপি-জামায়াতসহ ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে পোশাক খাতে ন্যূনতম বেতন বারো হাজার টাকার ঘোষণা দেয়া হয়। বেতন ও ওই স্কেলে নিয়ে যেতে একটি পক্ষ উস্কানি দিয়ে শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তুলছে। আর শ্রমিক নেতারা বলছেন, নতুন বেতন কাঠামো ঠিকমতো কার্যকর হলে শ্রমিকরা ঠকবেন না। এলক্ষ্যে শ্রমিক সংগঠনগুলো সরকারের সঙ্গে বসে অসঙ্গতি দূর করার লক্ষ্যে কাজ করছে। সূত্রমতে, নতুন মজুরি কাঠামো অনুযায়ী একজন পোশাক শ্রমিক এখন ন্যূনতম আট হাজার টাকা বেতন পাবেন। গত ২০১৩ সালের মজুরি বোর্ডে এই বেতন ছিল ৫৩০০ টাকা। নতুন মজুরি কাঠামোতে, শ্রমিকদের সপ্তম গ্রেডে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে আট হাজার টাকা। এরমধ্যে মূল মজুরি ৪ হাজার ১০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া ২ হাজার ৫০ টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৬০০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৩৫০ টাকা এবং খাদ্য ভাতা ৯০০ টাকা রাখা হয়েছে। কিন্তু কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের অভিযোগ, সরকার তাদের জন্য যে নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণ করে দিয়েছে, তাতে কয়েকটি গ্রেডের কর্মীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এই নতুন মজুরি কাঠামোতে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম গ্রেডে মজুরি বেড়েছে যথাক্রমে ৪১, ৪৪ ও ৪৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। অন্যদিকে আন্দোলনকারীরা বলছেন, বাস্তবে তৃতীয় গ্রেডের মূল বেতন কমে গেছে, বাকি দুই গ্রেডে বেড়েছে নামমাত্র। তাদের মতে, ২০১৩ সালে যখন সর্বশেষ বেতন বাড়ানো হয়, তখন তৃতীয় গ্রেডে মূল বেতন হয় ৪ হাজার ৭৫ টাকা। বছরে ৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধির পর ওই গ্রেডের একজন শ্রমিকের মূল বেতন এখন ৫ হাজার ২০৪ টাকা হওয়ার কথা। আর নতুন কাঠামোতে তৃতীয় গ্রেডের মূল বেতন ঘোষণা করা হয়েছে ৫ হাজার ১৬০ টাকা। তাদের এই হিসাবে তৃতীয় গ্রেডে বেতন কমেছে ৪৪ টাকা, একইভাবে চতুর্থ গ্রেডের মূল বেতন ৭৯ টাকা এবং পঞ্চম গ্রেডে ১৬৪ টাকা বেড়েছে। অথচ সপ্তম গ্রেডে নতুন শ্রমিকদের বেতন বেড়েছে ২ হাজার ৭০০ টাকা। এ প্রসঙ্গে রফতানিমুখী পোশাকখাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমএই’র সহসভাপতি (অর্থ) মোঃ নাসির জনকণ্ঠকে বলেন, মজুরি কাঠামো নিয়ে এক ধরনের ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো গ্রেডিং পদ্ধতিটি না বুঝেই রাস্তায় নেমে এসেছে। সামান্য অসঙ্গতি যদি থেকেও থাকে তা কারখানা পর্যায়ে মিটিয়ে ফেলা সম্ভব। এলক্ষ্যে দেশের সব কারখানার হিসাবরক্ষক ও অর্থবিভাগের লোকজনদের বিজিএমইএতে ট্রেনিংও দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ২০১৪ সাল থেকে মূল বেতনের উপর ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট দেয়া হচ্ছে। এই ইনক্রিমেন্ট যোগ করার পর এখন ন্যূনতমে বেতনে কারো কারো দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। কিন্তু তাদের বলা হচ্ছে বেতন বেড়েছে ২৭০০ টাকা। তিনি বলেন, যারা গত পাঁচ বছর ধরে কাজ করছেন তারা এখন আর সপ্তম গ্রেডে নেই। তাদের প্রমোশন হয়ে গ্রেড পরিবর্তন হয়েছে, বেড়েছে বেতনও। কিন্তু তারা হিসেবটি না বুঝেই আন্দোলন করছেন। তিনি বলেন, উপরের দিকের তিনটি গ্রেডে সামান্য অসঙ্গতি থাকলেও তা মিটিয়ে ফেলা অসম্ভব নয়। কিন্তু এটি নিয়ে এত বড় আন্দোলনে মনে হচ্ছে এর পেছনে উস্কানি রয়েছে। কারণ সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচনের ইশতেহারে ন্যূনতম বেতন বার হাজার টাকা করার ঘোষণা দেয়া হয়। শ্রমিকদের অনেকেই এখন বারো হাজার টাকা বেতন দাবি করছেন। প্রসঙ্গত, নতুন মজুরি কাঠামোতে শ্রমিকদের প্রথম গ্রেডে মজুরি ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৫১০ টাকা। শিক্ষানবিস শ্রমিকরা মাসে সর্বসাকুল্যে পাঁচ হাজার ৯৭৫ টাকা পাবেন, শিক্ষানবিসকাল হবে তিন মাস। অন্যদিকে পোশাক শিল্পের কর্মচারীদের চতুর্থ গ্রেডে আট হাজার ৩৭৫ টাকা ও প্রথম গ্রেডে ১৪ হাজার ৭৫ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে। শিক্ষানবিস কর্মচারী মাসে সব মিলিয়ে ছয় হাজার ১৬৪ টাকা পাবেন, শিক্ষানবিসকাল হবে ছয় মাস। পোশাক শ্রমিকরা দ্বিতীয় গ্রেডে ১৪ হাজারে ৬৩০ টাকা, তৃতীয় গ্রেডে ৯ হাজার ৫৯০ টাকা, চতুর্থ গ্রেডে ৯ হাজার ২৪৫ টাকা, পঞ্চম গ্রেডে ৮ হাজার ৮৫৫ টাকা ও ষষ্ঠ গ্রেডে ৮ হাজার ৪০৫ টাকা পাবেন। গেজেটে বলা হয়েছে, কোনো শ্রমিককে এই ন্যূনতম মজুরির চেয়ে কম মজুরি দেয়া যাবে না। শ্রমিকরা প্রতি বছর মূল মজুরির পাঁচ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধির সুবিধা পাবেন। গত ডিসেম্বর থেকে নতুন এই বেতন কাঠামো কার্যকর করা হয়েছে। এই জানুয়ারি থেকে প্রথম ৮ হাজার বেতন হাতে পাবেন শ্রমিকরা। এর আগে গত ২০১৩ সালের মজুরি বোর্ডের বেতন কাঠামো অনুযায়ী পোশাক খাতের নতুন শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ছিল ৫,৩০০ টাকা, যা ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে কার্যকর করা হয়। এর মধ্যে মূল মজুরি ৩ হাজার টাকা, বাড়ি ভাড়া ১২০০ টাকা এবং চিকিৎসা, যাতায়াত ও খাদ্য ভাতা ১১০০ টাকা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মজুরি বোর্ডের সদস্য ও শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম রনি জনকণ্ঠকে বলেন, নতুন বেতন কাঠামোতে শ্রমিকদের বেতন বেড়েছে। ন্যূনতম বেতনের সপ্তম গ্রেড নিয়ে তেমন কোন সমস্যা নেই। উপরের দিকের কয়েকটি গ্রেডে সমস্যা তৈরি হয়েছে। এসব সমস্যা আজ রবিবারের মধ্যে সমাধান হয়ে যাবে। তিনি বলেন, বেতনের অসঙ্গতি দূর করার স্বার্থে পর্যালোচনা কমিটি আন্তরিক। ইতোমধ্যে সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে একটি সিদ্ধান্তে আসা হয়েছে। শ্রমিকদের কারো উস্কানিতে কান না দিয়ে কাজে ফেরার আহ্বান জানাই। আজকে একটি ভাল খবর আসছে। এটি নিয়ে ভুল বুঝাবুঝির কোন সুযোগ নেই। শ্রম মন্ত্রণালয়ে আজকের বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ॥ নতুন মজুরি ও বেতন কাঠামো নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা দূর করতে আজ রবিবার শ্রম মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে। শনিবার বন্ধের দিনও জরুরী ভিত্তিতে বৈঠক করে বেতন ও মজুরি সংক্রান্ত সঙ্কট নিরসনে গঠিত পর্যালোচনা কমিটি। শ্রম সচিব আফরোজা খানের সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে বাণিজ্য সচিবসহ শ্রমিক ও মালিক পক্ষের পাঁচজন করে প্রতিনিধি বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। বৈঠকে সূত্র জানা গেছে, পর্যালোচনা কমিটির বৈঠকে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এসেছে। শ্রমিকদের কাজে ফিরে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। আজকের মধ্যে বেতন ও মজুরি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান বলে বলে জানিয়েছেন শ্রম সচিব আফরোজা খান। জানা গেছে, নবনিযুক্ত শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুণ্ণু জান সুফিয়ান ও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও সরকারের সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তাদের পরামর্শে এ সংক্রান্ত গঠিত পর্যালোচনা কমিটি তাদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। শ্রম সচিব আফরোজা খান আরও জানিয়েছেন, পর্যালোচনা কমিটির বৈঠকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আজ রবিবারের মধ্যে আশা করছি সব সমস্যার সমাধান হবে। তিনি বলেন, যেসব গ্রেডে অসঙ্গতি রয়েছে তা দূর করা হবে। এ বিষয়ে সরকার মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিরা আন্তরিকভাবে কাজ করছেন।
×