ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তোপের মুখে ॥ বিএনপির সিনিয়র নেতারা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১৩ জানুয়ারি ২০১৯

তোপের মুখে ॥ বিএনপির সিনিয়র নেতারা

শরীফুল ইসলাম ॥ ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণে নির্বাহী কমিটির সভা ডাকছে বিএনপি। ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যভাগে এ সভা ডাকার প্রস্তুতি চলছে। তবে আগের নির্বাহী কমিটির সভায় নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় এবার সভা ডাকলে দলের সিনিয়র নেতারা তোপের মুখে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা রয়েছে। এ সভায় বিএনপির উপজেলা নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে। সূত্র জানায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর ক্ষুদ্র পরিসরে দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে এক বৈঠকে ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণে কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। তাই কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও লন্ডন প্রবাসী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মতামত নিয়ে শীঘ্রই নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডাকার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তাদের মতামত পেলেই আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাহী কমিটির বৈঠকের তারিখ ঘোষণা করা হবে। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুসারে প্রতি ৬ মাস পর পর নির্বাহী কমিটির বৈঠক করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সর্বশেষ নির্বাহী কমিটির সভা হয়েছিল গত বছর ৩ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার মাত্র ক’দিন আগে। সে হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ৬ মাস সময় অতিক্রম হয়ে যাবে। নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠানের এক মাস আগে সব সদস্যকে চিঠি দিয়ে বৈঠকে অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ জানাতে হয়। আর এ কারণেই আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিতে পারলে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে নির্বাহী কমিটির সভা করা যাবে। বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়, নির্বাচনের আগে মনোনয়ন বাণিজ্য ও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করতে না পারাসহ বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতাদের নাস্তানাবুদ করার চেষ্টা করবে। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেয়ার বিষয়টিও আলোচনায় প্রাধান্য পাবে। আর এতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতাদের নাজেহাল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সূত্র জানায়, সর্বশেষ নির্বাহী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল খালেদা জিয়া জেলে থাকলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করবে বিএনপি। আর এ জন্যই ৮ ফেব্রুয়ারির মামলার রায়ে সাজা হবে এমন আশঙ্কা থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর লামেরিডিয়ান হোটেলে অনুষ্ঠিত বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভায় ৬টি শর্ত দিয়ে নির্বাচন বর্জনের আগাম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভায় নির্বাচনে যাওয়ার বিষয়ে খালেদা জিয়ার দেয়া ৬ শর্তের মধ্যে ছিল সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন, নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার ব্যবস্থা, জনগণকে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি করা, ভোটের জন্য ইভিএম বা ডিভিএম ব্যবহার না করা ও ভোটের সময় ম্যজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা। খালেদা জিয়ার দেয়া ৬টি শর্ত যে নির্বাচনকালীন সরকার বা নির্বাচন কমিশন মানবে না সেটি ধরে নিয়েই খালেদা জিয়া শর্তগুলো দিয়েছিলেন। তাই এসব শর্তকে নির্বাচন বর্জনের ইঙ্গিত হিসেবেই নিয়েছিলেন দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। কিন্তু খালেদা জিয়ার এ ইঙ্গিত উপেক্ষা করে দলের সিনিয়র নেতারা ড. কামাল হোসেনকে অভিভাবক মেনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অধীনে নির্বাচন করে। এ বিষয়টিকে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেকেই মেনে নিতে পারেননি বলে জানা গেছে। সর্বশেষ নির্বাহী কমিটির বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত হয়েছিল খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠালে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করা। কিন্তু গতবছর ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া গ্রেফতারের পর দলের সিনিয়র নেতারা আন্দোলনের কোন চেষ্টাই করেননি। এ বিষয়টিকেও দলের অনেক নেতাকর্মী ভালভাবে নিতে পারেননি। তবে আন্দোলন যে হবে না এমন ইঙ্গিত খালেদা জিয়ার সামনেই দিয়েছিলেন তৃণমূল নেতারা। নির্বাহী কমিটির সভায় বিভিন্ন জেলা নেতারা ঢাকার নেতাদের কারণেই বার বার আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে বলে খালেদা জিয়ার কাছে অভিযোগ করেন। তারা বলেন, অতীতে জেলা নেতারা জেল-জুলুম উপেক্ষা করে রাজপথে আন্দোলন সফল করলেও কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে না থাকায় সফলতা আসেনি। বিএনপির সর্বশেষ নির্বাহী কমিটির বৈঠকে দলের আগের গঠনতন্ত্র থেকে ৭ ধারাটি বাতিলের বিষয়েও অনুমোদন নেয়া হয়। এর কারণ, হিসেবে দলীয় নেতাদের জানানো হয় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ দলের এমন অনেক নেতাই রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে ওয়ান-ইলেভেনের সরকার ও বর্তমান সরকারের আমলে অনিয়ম-দুর্নীতির মামলা হয়নি। আর যে কোন সময় যে কোন নেতার বিরুদ্ধে মামলার রায়ে সাজা হয়ে যেতে পরে। আর তা হলে আগের গঠনতন্ত্র অনুসারে সাজাপ্রাপ্ত নেতা আর দলীয় পদে থাকতে পারবে না। আর এ কারণেই বিএনপির আগের গঠনতন্ত্র থেকে ৭ ধারা বাতিল করে সম্প্রতি তা নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়া হয়েছে এবং দলের নির্বাহী কমিটির সভায় তা অনুমোদন করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু তখন নীরবে সহ্য করে গেলেও এ বিষয়টি নিয়ে কেউ কথা বলেননি। তবে এবারের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে কোন কোন জেলা নেতা কথা তুলতে পারেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। জানা যায়, নির্বাহী কমিটির সভা ডাকলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক হতে পারে এমন আশঙ্কা থাকার পরও সভা ডাকার প্রস্তুতি চলছে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মতামত নিয়ে কিভাবে দলকে এগিয়ে নেয়া যায় এটাকেই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের পর বিএনপির ৫৯২ সদস্যের নতুন নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। পরে ‘আনঅফিসিয়ালি’ এ কমিটিতে আরও ক’জনকে বিভিন্ন পদে স্থান দেয়া হয়। নির্বাহী কমিটির সভায় এ কমিটির সবাই ছাড়াও পদাধিকার বলে প্রতিটি সাংগঠনিক জেলার সভাপতি অংশ নিতে পারেন। এর বাইরেও আরও শতকরা ১০ ভাগ দলীয় নেতাকে বৈঠকে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। আর বিএনপির ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদাধিকার বলে নির্বাহী কমিটির সদস্য। তাই তারাও বৈঠকে আমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন ও পরে টানা ৯২ দিনের অবরোধ কর্মসূচী ব্যর্থ হওয়ার পর রাজনৈতিকভাবে চরম সঙ্কটের মুখে পড়ে বিএনপি। সেই সঙ্কট থেকে কিছুতেই বের হয়ে আসতে পারছে না বিএনপি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও রাজনৈতিক কৌশল নিতে ভুল করায় শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয় দলটিকে। এ কারণে দলের সর্বস্তরে এখন হতাশা ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। তাই সাংগঠনিক স্থবিরতা কাটাতে হিমশিম খাচ্ছে বিএনপি হাইকমান্ড। তবে নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডেকে সবার মতামত নিয়ে সে মোতাবেক এগিয়ে গেলে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে লাভবান হবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে। আর এ কারণেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাহী কমিটির বৈঠক করতে চাচ্ছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলের নির্বাহী কমিটির সভা আহ্বানের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। এ ছাড়া গঠনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতায় নির্বাহী কমিটির সভা ডাকাও জরুরী হয়ে পড়েছে। দল পরিচালনার বিষয়ে হাইকমান্ডের কোন ভুলভ্রান্তি থাকলে তা নির্বাহী কমিটির বৈঠকে যে কেউ তুলে ধরতে পারেন। আর এর মাধ্যমে পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটিয়ে দলকে এগিয়ে নেয়া যায়। এব বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, দলের নির্বাহী কমিটির সভা হলে খোলা মনে কমিটির সদস্যরা দলের ভবিষ্যত করণীয় প্রসঙ্গে মতামত তুলে ধরতে পারবেন। এতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও সাংগঠনিক বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
×