ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন রায়

স্মরণ ॥ অসিত কুমার গঙ্গোপাধ্যায়

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ১৩ জানুয়ারি ২০১৯

স্মরণ ॥ অসিত কুমার গঙ্গোপাধ্যায়

অসিত কুমার গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি সংক্ষেপে একে গঙ্গোপাধ্যায় নামে পরিচিত। ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যাংকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গবর্নর। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দেশের মুদ্রা ব্যবস্থা এবং সার্বিক ব্যাংকিং খাতকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুনর্গঠন করে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে যে কয়েকজন ব্যাংকারের অপরিসীম অবদান রয়েছে তাদের মধ্যে তিনি একজন। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর ব্যাংকিং পেশার যাত্রা শুরু। তিনি ছাত্রজীবনে যেমন অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন, তেমনি কর্মজীবনেও অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। প্রতিনিয়ত অধ্যয়ন ছাড়া যে ব্যাংকিং পেশায় অগ্রগতি সম্ভব নয়; এই আপ্তবাক্যটি তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন এবং নিজের জীবদ্দশায় তা কঠোরভাবে অনুসরণও করেছেন। তখনকার দিনে ব্যাংকিং সংক্রান্ত লেখাপড়ার বিষয়গুলো এখনকার মতো এত সহজলভ্য ছিল না। তথাপিও তিনি বিশ্বব্যাপী ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্বন্ধে প্রতিনিয়ত পড়াশোনা করতেন এবং তা থেকে অর্জিত জ্ঞান কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেছেন। তিনি ব্যাংকার হলেও সবসময় গুরুত্ব আরোপ করতেন বাণিজ্যিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্প্রসারণের ওপর। ফলে তাঁর কর্মজীবনে অনেক দৃষ্টান্তই আছে যেখানে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সম্প্রসারিত করার জন্য। তৎকালীন পাকিস্তানের ক্রেডিট ইনকোয়েরি কমিশনের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে পাকিস্তানের প্রথম বাণিজ্যিক ব্যাংক, ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক, প্রতিষ্ঠা করতে অসাধারণ অবদান রাখেন। উল্লেখ্য, আজকের পূবালী ব্যাংক সেই ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একটি অংশেরই উত্তরাধিকার। কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ কর্তৃক আয়োজিত তিন মাসব্যাপী এক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন যেখানে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অসংখ্য মেধাবী ব্যাংকার অংশ নেয়। সেই প্রশিক্ষণে সকল অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি প্রথম হন, ফলে তাকে পরবর্তী সময়ে প্রশিক্ষণ দানের জন্য একজন প্রশিক্ষক বা রিসোর্স পারসন হিসেবে মনোনীত করা হয়। ব্যাংকিং পেশার পাশাপাশি একে গঙ্গোপাধ্যায় বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতি বিষয়ক পরামর্শক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একে গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাদেশ ব্যাংকে ১৯৭৩ সালে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন এবং পরে ডেপুটি গবর্নর হিসেবে নিয়োগ পান। সদ্য স্বাধীন হওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনর্গঠন করে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে তার রয়েছে অসামান্য অবদান। শুধু তাই নয়, একটি ভগ্নপ্রায় অর্থনীতিকে সচল করার জন্য উপযুক্ত মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রেও তিনি যথেষ্ট দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। ব্যাংকিং যে একটি স্বীকৃত এবং চ্যালেঞ্জিং পেশা তা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই তো তিনি সবসময় জোর দিয়ে বলতেন, ব্যাংকিং পেশার চ্যালেঞ্জগুলো সফলতার সঙ্গে মোকাবেলা করে এই পেশায় এগিয়ে যেতে হলে ব্যাংকারদের প্রতিনিয়ত অধ্যয়নের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আজ যে বাংলাদেশে ব্যাংকিং পেশায় প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে একমাত্র প্রতিষ্ঠান বিআইবিএম (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট), তা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও রয়েছে একে গঙ্গোপাধ্যায়ের অসামান্য অবদান। তিনি ছিলেন এই বিআইবিএমের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। দীর্ঘ সময় ধরে এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র অগণিত ব্যাংকার তৈরি করেছে এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক; উভয় প্রকার অর্থ ব্যবস্থাই যে একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য তা এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকার খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। যে সময় অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণদান ব্যবস্থা বা ক্ষুদ্র ঋণের ধারণা তো দূরের কথা, বেসরকারী উদ্যোগে ব্যাংক প্রতিষ্ঠাও মানুষের চিন্তার মধ্যে ছিল না, তখনই একে গঙ্গোপাধ্যায় অপ্রাতিষ্ঠানিক এবং ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থার কথা সক্রিয়ভাবে ভাবতে শুরু করেন। আজকের নোবেল বিজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকারের রয়েছে অসাধারণ ভূমিকা। ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বে নন্দিত হলেও এর পেছনে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তিটি ছিলেন একে গঙ্গোপাধ্যায়। এই কথা তিনি কখনও বড়মুখ করে বলেননি, কেননা তিনি নাম বা প্রচারে বিশ্বাস করতেন না। কাজের মধ্যে নিমগ্ন থাকা এবং সহজ সরল জীবনযাপন ও উন্নত চিন্তা; এই ছিল তাঁর জীবনের আদর্শ। একে গঙ্গোপাধ্যায় শুধু দেশের মধ্যেই নয়, বহির্বিশ্বেও ব্যাংকিং খাতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে অবদান রেখেছেন। আমাদের দেশের অনেক ব্যাংকার, আমলা, অর্থনীতিবিদসহ অনেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে ভাল ভাল পদে দায়িত্ব পালন করলেও কোন একটি দেশের মুদ্রাব্যবস্থা ও ব্যাংকিং খাত বিনির্মাণে অবদান রাখার সৌভাগ্য হাতেগোনা দু’একজনের হয়েছিল তার মধ্যে একে গঙ্গোপাধ্যায় একজন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর পদে দায়িত্ব পালন অবস্থাতেই তিনি ১৯৮১ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কারিগরি সহায়তার আওতায় গবেষণা পরামর্শকের (রিসারস এডভাইজার) দায়িত্ব নিয়ে লাইবেরিয়া যান। এই লাইবেরিয়ায়ও তখন আমাদের দেশের মতোই ১৩৩ বছরের উপনিবেশিক শাসন থেকে মাত্র স্বাধীন হয়েই নিজস্ব অর্থ, মুদ্রা ও ব্যাংক ব্যবস্থা পুনর্গঠনের কাজ হাতে নিয়েছেল। ফলে একে গঙ্গোপাধ্যায় সদ্য স্বাধীন হওয়া নিজের দেশের মুদ্রা ও ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা খুব অনায়াসে সেখানে কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। লাইবেরিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যোগদানের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি জেনারেল ম্যানেজার পদে উন্নীত হন। লাইবেরিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনর্গঠনের মাধ্যমে সেখানে একটি কার্যকর মুদ্রা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তিনি বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন এবং যথেষ্ট সফলও হয়েছিলেন। ফলে তিনি সেখানকার গবর্নর, অর্থমন্ত্রী এবং সরকারপ্রধানের কাছে খুব প্রিয়ভাজন ছিলেন। তিনিই প্রথমবারের মতো সেখানকার সরকার কর্তৃক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গৃহীত সকল প্রকার ঋণের ওপর সুদ প্রদানের ব্যবস্থা চালু করেন। এমনকি আইএমএফ সেই দেশের আর্থিক ও লেনদেন ভারসাম্য মোকাবেলার জন্য সরকারকে যে অর্থ সহায়তা প্রদান করত তাও কেন্দ্রীয় ব্যাংক হয়ে সরকারের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করার ফলে সেই অর্থের উপরও সরকারকে নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করতে হতো। এভাবেই নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণ করার ফলে সেখানে মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা, দুই-ই ফিরে আসে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকও লাভের মুখ দেখে। একে গঙ্গোপাধ্যায় ব্যাংকার হিসেবে দেশে ও বিদেশে অপরিসীম অবদান রাখার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক মহলেও যথেষ্টই পেয়েছেন। ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রোফাইল কেন্দ্র (ইন্টারন্যাশনাল বায়োগ্রাফিক সেন্টার) উন্নয়নশীল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ একে গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রোফাইল তাদের ৮ম সংস্করণে সন্নিবেশিত করে ১৯৮৪ সালের নবেম্বর মাসে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যারোলিনাভিত্তিক ওয়ার্ল্ড ইনস্টিটিউট অব এচিভমেন্ট একে গঙ্গোপাধ্যায়কে তাঁর ব্যক্তিগত এবং পেশাগত দক্ষতা ও অবদানের জন্য অফিসিয়াল প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট তাকে ১৯৯১ সালের গবেষণা উপদেষ্টা (রিসারস এডভাইজার) হিসেবে নির্বাচন করে। লাইবেরিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই একে গঙ্গোপাধ্যায় এক বর্ণাঢ্য ব্যাংকিং পেশার সমাপ্তি টানেন। এরপর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবসর জীবনযাপন করছিলেন এবং ২০১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি এই প্রবাসেই তিনি চিরবিদায় নেন। আজ মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা তার আত্মার সদগতি কামনা করি। লেখক : ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা
×