ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দীপক চৌধুরী

বুদ্ধিদীপ্ত সৈয়দ আশরাফের রাজনীতির আয়না

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ১৩ জানুয়ারি ২০১৯

বুদ্ধিদীপ্ত সৈয়দ আশরাফের রাজনীতির আয়না

সোজা কথায় বলতে হয়, রাজনীতির শুদ্ধ পুরুষ ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। সম্ভবত আমাদের রাজনীতির সংস্কৃতি তাঁর পছন্দ কম হতো। ছিলেন অত্যন্ত মানবিক। সাংবাদিক হিসেবে আওয়ামী লীগের সংবাদ সম্মেলন বা অনুষ্ঠান কভার করার সুবাদে সৈয়দ আশরাফের অনেক কিছুই কাছ থেকে দেখার সুযোগ হতো। দলের সভাপতি শেখ হাসিনা যে জনগণের প্রতি আত্মনিবেদিত তা উল্লেখ করে বিভিন্ন সময় উদাহরণ দিয়ে বলতেন ‘ভালবাসা ও বিশ্বাসের মর্যাদা’ দিতে জানেন প্রধানমন্ত্রী। ‘জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতির বিষয়গুলো রাজনীতিবিদদের মনে রাখা দরকার’, একথাও তিনি প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতেন। ‘সংবাদ সম্মেলনে কী আশরাফ ভাই থাকবেন’ এমন জিজ্ঞাসা থাকত আমাদের সাংবাদিকদের অনেকের। কারণ, তাঁর সংবাদ সম্মেলন থেকে লেখার ‘ইন্ট্রো’ বের করতে মোটেই কষ্ট হতো না। গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পাওয়া যেত। চুম্বক কথাও থাকতো অনেক। ছোট ছোট বাক্যে কথা বলতেন। দলপ্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর একটি মানসিক বন্ধন যেন আমরা খুঁজে পেতাম। আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন ও সুবৃহৎ রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে গিয়ে বুঝতে পারতেন সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি কতটা জরুরী। তা প্রকাশও পেত তার রাজনৈতিক আচরণে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। মেধা, শ্রম ও দক্ষতা আশরাফের চারিত্রিক দৃঢ়তার এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। তাঁর মতে, দুর্নীতিকে ঘৃণা করার মানসিকতা রাজনীতিকদের মধ্যে থাকা দরকার। সৈয়দ আশরাফের ভাষায়, দুর্নীতি করলে রাজনীতি নয়। আমরা জানি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-। কিন্তু তিনি মৃত্যুদ- রদের পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে থাকতেন। সর্বোচ্চ শাস্তির বদলে দীর্ঘ সময়ব্যাপী অপরাধীর ‘কারাবদ্ধ’ জীবনের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে মত প্রকাশ করতেন। কিন্তু এটিও স্মরণ করিয়ে দিতেন, আমাদের দেশে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শাস্তির মেয়াদ বদলে যায়। খুনী বা দুর্ধর্ষ ডাকাত ও লুটেরাদের রাতারাতি মুক্তি দেয়া হয়। রাজনীতি এজন্যই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, লুটপাটের আবির্ভাব ঘটে। এখান থেকে আমাদের বেরুতে হবে শেখ হাসিনা এটাই চান। বুদ্ধিদ্বীপ্ত সরস কথা থাকত তাঁর কণ্ঠে। কঠিন মুহূর্তে বিভিন্ন ইস্যুতে তাঁকে কথা বলতে হতো। হেফাজত ইস্যু গরম হয়ে উঠল ২০১৩ সালে। সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ। গিয়েছি সভাপতির রাজনৈতিক অফিস ধানম-িতে ৩/এ। সম্ভবত, ওই বছর ৫ মে। রাজধানী ঢাকা আরামবাগ, মতিঝিল, দিলকুশা, ফকিরাপুল, বায়তুল মোকাররম, প্রেসক্লাব, পুরানাপল্টন, তোফখানাসহ প্রায় অর্ধেক শহর হেফাজতে ইসলামের দখলে। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে তাদের সমাবেশ থাকলেও তা-ব সর্বত্র। র‌্যাব-পুলিশ পাল্টা আক্রমণের শিকার। হেফাজতের কর্মীরা তা-বের ষোলোকলা পূরণ করছে। বায়তুল মোকাররমে বইয়ের দোকান পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। তাঁরা হুংকার ছাড়েন অপরাজেয় বাংলা গুঁড়িয়ে দেবেন। হাজার হাজার হেফাজত কর্মীদের সঙ্গে র‌্যাব-পুলিশের সংঘর্ষ চলছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন সরকারকে। আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীরাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সর্বত্র উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকারমন্ত্রী চুপ করে বসে থাকতে পারেন না। হেফাজতের উদ্দেশে এই অবস্থায় সেই সময় সংবাদ সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফ বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমাদের সরলতাকে দুর্বলতা ভাববেন না, রাতের মধ্যেই আপনারা ঘরে ফিরে যাবেন’। সেদিন সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর কথায় কাজ হয়েছিল। প্রমাণ হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব। পরদিন হেফাজতের কর্মীরা ঢাকা শহর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। মতিঝিলে সেই তা-বের নমুনার ছাপ ছিল দীর্ঘদিন। ২০০৭-এর জানুয়ারিতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলসহ অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতাকে জেলে নেয়া হয়। তখন দলের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলের হাল ধরেছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তাঁর সাহসী ভূমিকা ও সততা ছিল সেই সময়ের পুঁজি। লন্ডনে থাকা অবস্থায় তিনি ভারতের গুজরাটের ঐতিহ্যবাহী ঠাকুর পরিবারের মেয়ে শিলা ঠাকুরকে বিয়ে করেন। পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করে তাঁর স্ত্রী হন শিলা ইসলাম। তাদের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। যার নাম সৈয়দা রীমা ইসলাম। ল-নে একটি ব্যাংক কর্পোরেশনে চাকরি করতেন। অসুস্থ বাবার শশুষার জন্য লন্ডনের কর্মস্থল ছেড়ে ব্যাংককে ছুটে আসেন। গত বছর অক্টোবর মাসে স্ত্রী শিলা ইসলাম মারা যান। ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর কারাগারে বাবা সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতার হত্যার পর সৈয়দ আশরাফ যুক্তরাজ্য চলে যান এবং সেখানে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে সক্রিয় ভূমিকা নেন। তাঁর তীক্ষ্ন লেখনি তখন লন্ডনে বজ্রকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। একই সঙ্গে ছিলেন সুবক্তা ও সুলেখক। ৩ জানুয়ারি তিনি ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। লেখক : সাংবাদিক
×