ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বৃহস্পতিবারও বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ

গার্মেন্টসে অস্থিরতার নেপথ্যে বিশেষ মহলের ইন্ধন

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১২ জানুয়ারি ২০১৯

গার্মেন্টসে অস্থিরতার নেপথ্যে বিশেষ মহলের ইন্ধন

গাফফার খান চৌধুরী /রহিম শেখ ॥ গত নবেম্বরে নতুন মজুরি কাঠামো চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। বাস্তবায়ন করা হয় ডিসেম্বরে। নতুন মজুরি মেনেও নেয় সাধারণ শ্রমিকরা। তবে মেনে নেয়নি কিছু শ্রমিক সংগঠন। সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে শ্রমিকদের বুঝানো হয়, সাতটি গ্রেডের মধ্যে ৩ ও ৪ নম্বর গ্রেডের শ্রমিকরা (অপারেটর) কম মজুরি পাবে। কিন্তু মজুরি কাঠামো গঠনের শুরু থেকেই পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, শ্রমিকদের ভুল বুঝানো হয়েছে। কোন শ্রমিকের মজুরি কমানো হয়নি। বরং প্রতিটি গ্রেডের শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে। গত মাসে জাতীয় নির্বাচন ও নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন একসঙ্গে হওয়ায় ওই সুযোগে সরকারকে চাপে ফেলতে গত মাসের প্রথম সপ্তাহে মজুরি বৈষম্যের অভিযোগ তুলে আন্দোলনে নামে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের শ্রমিকরা। এরপর নির্বাচন শেষ হতে না হতেই মজুরি বাড়ানোর দাবিতে গত ৫ দিন ধরে চলছে শ্রমিক বিক্ষোভ। এ আন্দোলনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক একটি চক্র জড়িত বলে মনে করছে বিজিএমইএ। সংগঠনটি বলছে, শ্রমিকদের এই আন্দোলনে তৃতীয়পক্ষের ইন্ধন রয়েছে। সরকারও বলছে, আন্দোলনের নেপথ্যে বিশেষ মহল জড়িত। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে শ্রম সচিব সাংবাদিকদের এমন তথ্য জানালেও ওই মহলটির নাম প্রকাশ করেননি। জানা গেছে, দেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরি পোশাক। একই সঙ্গে কর্মসংস্থানেও বিশাল ভূমিকা রাখছে এ খাত। প্রায় ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিকের এ খাতের ৮০ শতাংশ নারী। বাংলাদেশের এ খাতের ওপর নজর সারা বিশ্বের। কোনভাবে খাতটিকে অশান্ত করা গেলে বিশ্ববাসীর নজর যেমন কাড়া যায়, সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নিজেদের স্বার্থও হাসিল করা যায়। জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, তৈরি পোশাক খাতের চলমান আন্দোলন দেশের একটি বিদেশী দালালচক্রের ইন্ধন। তারা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে শ্রমিকদের ভুল বুঝিয়ে স্বার্থ হাসিলের জন্য এসব করছে। মজুরি সমস্যা সমাধানে গত মঙ্গলবার সরকার-মালিক-শ্রমিক ত্রিপক্ষীয় কমিটি করার পরও বুধবার ২৫ থেকে ৩০টি কারখানায় হামলা-ভাংচুর চালিয়েছে এক দল বহিরাগত। বৃহস্পতিবারও বিক্ষোভ করেছে শ্রমিকরা। নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করে মালিকপক্ষ-শ্রমিকপক্ষ-সরকারপক্ষ মিলে নতুন মজুরি কাঠামোর সিদ্ধান্ত হয়। এই মজুরি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের বেতনের সঙ্গে যোগ হয়ে চলতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে শ্রমিকদের হাতে যাওয়ার কথা। এর আগেই শ্রমিক অসন্তোষ একটি অশুভ ইন্ধন বলে আমার মনে হয়েছে। জানা গেছে, সরকার ঘোষিত নতুন মজুরি কাঠামো কিছু শ্রমিক সংগঠন প্রথম থেকেই মেনে নেয়নি। তারা ১৬ হাজার টাকা নতুন মজুরি ঘোষণার দাবি জানায়। গত মাসে জাতীয় নির্বাচন ও নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন একসঙ্গে হওয়ায় ওই সুযোগে সরকারকে চাপে ফেলতে গত মাসের প্রথম সপ্তাহে মজুরি বৈষম্যের অভিযোগ তুলে আন্দোলনে নামে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের শ্রমিকরা। রাজধানীর আশপাশের কিছু কারখানার শ্রমিকরাও কাজ বন্ধ করে সড়কে নেমে মজুরি সমন্বয়ের দাবি জানায়। এ সময় অশান্ত হয়ে ওঠা কারখানাগুলো মালিকরা সাময়িক বন্ধ রাখেন। তবে পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ, শ্রম মন্ত্রণালয় ও শ্রমিক নেতারা বৈঠকে বসে নির্বাচনের আগে কোন ধরনের আন্দোলনে যাবেন না বলে একমত হন। নির্বাচন শেষ হতেই পাঁচ দিন ধরে রাজধানীর এয়ারপোর্ট, উত্তরা, আজমপুর, আব্দুল্লাহপুর, সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুরে বিক্ষোভ এবং কারখানায় হামলার ঘটনা ঘটেছে। বুধবার দেশের সবচেয়ে বড় পোশাক শিল্পাঞ্চল আশুলিয়া ও টঙ্গী বিসিক শিল্প এলাকায় শ্রমিকরা বিক্ষোভ করে। বৃহস্পতিবারও শ্রমিকরা রাজধানীর শেওড়াপাড়া ও আশুলিয়ার কয়েকটি কারখানার সামনে সড়ক অবরোধ করে সরকার ঘোষিত নতুন মজুরি কাঠামো পরিবর্তনের দাবি জানায়। শ্রমিক নেতারা জানান, নতুন মজুরি কাঠামোতে সপ্তম গ্রেডে মোট মজুরি বেড়েছে দুই হাজার ৭০০ টাকা। এর মধ্যে মূল মজুরি বেড়েছে এক হাজার ১০০ টাকা। ২০১৩ সালে মজুরি বোর্ড বাস্তবায়নের পর প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে শ্রমিকের মজুরি বেড়েছে। সে কারণে ৩ ও ৪ নম্বর গ্রেডের পুরনো অনেক শ্রমিক ঘোষিত নতুন মজুরি কাঠামোর সমপরিমাণ মূল মজুরি এখনই পাচ্ছে। কিন্তু নতুন মজুরি কাঠামোয় শ্রমিকদের বড় একটি অংশের মূল মজুরি বাড়েনি। এর ফলে ওভারটাইম করেও প্রত্যাশিত অর্থ পাবে না তারা। একই অবস্থা হবে উৎসব ভাতার ক্ষেত্রেও। পাঁচ বছর পর নতুন মজুরি কাঠামোয় প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আখতার বলেন, পোশাক খাতে সাতটি গ্রেডে মজুরি দেয়া হয়। এর মধ্যে ৩ ও ৪ নম্বর গ্রেডের শ্রমিকরা (অপারেটর) সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৩ সালের ঘোষিত মজুরি এবং পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালে ঘোষিত মজুরিতে তাদের তুলনামূলক বেতন বাড়েনি। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক রমিজ মিয়া জানান, ১০ বছর ধরে তিনি ওই কারখানায় কাজ করছেন। ৩ নম্বর গ্রেডের একজন শ্রমিক তিনি। বর্তমানে তার মোট মজুরি ৯ হাজার ৫০০ টাকা। আর মূল মজুরি ছয় হাজার টাকা। ২০১৮ সালে সরকার যে ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করেছে তাতে দেখা যায়, তার মূল মজুরি পাঁচ হাজার ১৬০ টাকা। ফলে ঘোষিত মজুরির চেয়ে তার মূল মজুরি কমে এসেছে বলে শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন। শ্রমিক সংগঠন ইউনাইটেড ফেডারেশন অব গার্মেন্টস ওয়ার্কার্সের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম বলেন, বেতন-ভাতা নিয়ে অসচেতনতার কারণেই শ্রমিকরা আন্দোলন করছেন। বাড়তি বেতন-ভাতা সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার ধারণা নেই। আর একটি পক্ষ আছে সব সময় তাদের উস্কে দেয়। বাংলাদেশ শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি ফজলুল হক মন্টু বলেন, বর্তমান সময়েই পোশাক শ্রমিকদের বেতন সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। তিনি বলেন, গত কয়েক দিনে কোথাও কোথাও আন্দোলন হয়েছে, বেতন পরিশোধ না করার কারণে। বেতন-ভাতা নিয়ে শ্রমিকদের বিভ্রান্তি দূর করতে আমরা কাজ করছি। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের আগেও শ্রমিকদের একটি পক্ষ উস্কে দিতে চেয়েছিল। এখন চেষ্টা করছে। বিজিএমইএ সূত্র জানায়, কোন শ্রমিকের মজুরি কম হবে না। কোথাও কোন অসঙ্গতি থাকলে তা সংশোধন করা হবে। প্রতিটি গ্রেডের শ্রমিকদের মজুরি বাড়বে। কোন শ্রমিকের মূল মজুরি বার্ষিক ভাতার কারণে ছয় হাজার টাকা হলে তাদের সেই ছয় হাজার টাকা মজুরি ধরেই ৫১ শতাংশ বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, যাতায়াত, খাদ্য ভাতাসহ মজুরি ১০ হাজার ৮৫০ টাকার বেশি দাঁড়াবে। এ কারণে শ্রমিকদের আতঙ্কের কিছু নেই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পোশাক খাত সূত্রে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনের সময় সরকারকে বিপাকে ফেলতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অরাজনৈতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা পোশাক অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় আসতে শুরু করে। তারা বিভিন্ন কারখানায় কাজ নেয়। তারাই কারখানার ভেতর থেকে নতুন মজুরি বৈষম্যের উস্কানি দিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়। সরকার পোশাক খাতের প্রতিনিধিকে বাণিজ্যমন্ত্রী বানিয়েছে। তিনি এরই মধ্যে এ সঙ্কট মোকাবেলায় বিজিএমইএ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে সরকার-মালিক-শ্রমিক নেতা এই ত্রিপক্ষীয় ১২ সদস্যের কমিটি গঠন করেন। এদিকে টানা পঞ্চম দিনের মতো বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকার শেওড়াপাড়ার বেশ কয়েকটি গার্মেন্টসের শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। বৃহস্পতিবার সকালে শেওড়াপাড়ায় আলফা ইউনিট ১ ও ২ লিমিটেড এর পোশাক শ্রমিকরা সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। সেখানকার কয়েকটি গার্মেন্টস থেকে শ্রমিকরা নেমে রাস্তায় অবস্থায় নেন এবং যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। একইভাবে কয়েকদিনের ধারাবাহিকতায় বকেয়া বেতন পরিশোধ ও মজুরি বাড়ানোসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ের অংশ হিসেবে রাজধানীর কালশীতে সড়ক অবরোধ করে স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের শ্রমিকরা। পরে মালিকপক্ষের আশ্বাস ও পুলিশের অনুরোধে উঠে যান শ্রমিকরা। মিরপুর মডেল থানার ওসি দাদন ফকির বলেন, আমরা মালিকপক্ষকে ডেকে সড়ক থেকে শ্রমিকদের সরিয়ে নিতে বলেছি। তাদেরকে বলা হয়েছে, বিক্ষোভ ও আন্দোলন যদি করতেই হয় তাহলে কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের ভেতরে করতে হবে। জনসাধারণের চলাচলে বাধা, জনশৃঙ্খলা ও জননিরাপত্তায় বাধা দেয়া যাবে না। শেওড়াপাড়ায় বিক্ষোভে অংশ নেয়া আলফা ইউনিট-১ লিমিটেডের পোশাক শ্রমিক মিজানুর রহমান বলেন, চেয়ারম্যান স্যার আমাদের কথা দিয়েছিলেন আমাদের দাবি-দাওয়া মানবেন কিন্তু কথা অনুযায়ী কাজের মিল পাইনি। তাই বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নেমেছি। এদিকে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবিতে টানা পঞ্চম দিন বৃহস্পতিবারও আশুলিয়ায় পোশাক শ্রমিকদের অসন্তোষ অব্যাহত থাকে। তবে, এদিন সাভারের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। এদিন সকালে আশুলিয়ার কয়েকটি পোশাক কারখানায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের সংর্ঘষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় কয়েক রাউন্ড টিয়ার সেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে পুলিশ। এতে আহত হয় অন্তত ৩০ শ্রমিক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিভিন্ন পোশাক কারখানার সামনে টহল দিচ্ছে বিজিবি। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মাঠে রয়েছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল আটটার দিকে আব্দুল্লাহপুর-ইপিজেড সড়কের বেরণ এলাকায় ও বিশমাইল-জিরাবো সড়কের কাঠগড়া এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কারখানার সামনে বিক্ষোভ করতে থাকে। পরে পুলিশ এসে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে অনেক কারখানা একদিনের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। এদিকে, সাভারে কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে বাসায় ফিরে যায়। এছাড়া, ধামরাইয়ের কালামপুর এলাকায় একটি কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে বিভিন্ন স্থানে বিজিবি মোতায়েন করা হয়। ঢাকা-১ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের এসপি সানা সামিনুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধের চেষ্টা করলে তাদের ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়া হয়। ঘটনাস্থলগুলোতে পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন রয়েছে। এছাড়া, প্রস্তুত রয়েছে পুলিশের জলকামানসহ সাঁজোয়া যান।
×