স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীতে দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় শিক্ষার্থীদের টানা আন্দোলনের মুখে গণপরিবহন ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফেরাতে নড়েচড়ে বসেছিলো সরকার। সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে সে সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি প্রতিনিয়ত তা তদারকি শুরু হয়। কিন্তু আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর সড়ক ব্যবস্থাপনা ফের পুরনো অবস্থায় ফিরে গেছে।
গত বছরের ২৯ জুলাই রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থী মারা যায়। এর প্রতিবাদে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। এরপর ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে ১৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক সভায় অনুষ্ঠিত হয়। সভায় নগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও গণপরিবহন ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরবর্তী ২০ অক্টোবরের মধ্যে ওই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), বাংলাদেশ রোড ট্রার্সপোর্ট অথারিটি (বিআরটিএ) ও বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের (বিআরটিসি)।
সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ছিল, চলাচলের সময় সব গণপরিবহনের দরজা বন্ধ রাখা, নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠানামা বন্ধ করা, বাসের ভেতর চালক ও হেলপারের বৃত্তান্ত প্রদর্শন, সব মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীকে বাধ্যতামূলক হেলমেট ব্যবহার, চালক ও যাত্রীদের সিট বেল্টের ব্যবস্থা রাখা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সংক্রিয় ও রিমোট কন্ট্রোলড অটোমেটিক বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালুর মতো পদক্ষেপ নেয়া প্রভৃতি। কিন্তু সেসব নির্দেশনার কোনটিই শতভাগ বাস্তবায়ন করেনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
এর মধ্যে সড়কে সিগন্যাল বাতি, বাস স্টপেজ ও আন্ডারপাস ব্যবহার উপযোগী করার দায়িত্ব ছিল দুই সিটি কর্পোরেশনের ওপর। সংস্থা দুটির দাবি, তাদের দায়িত্বগুলোর মধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ পালন করা হয়েছে। বাকি ৫ শতাংশ বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
এ বিষয়ে দক্ষিণ দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক সার্কেল) আনিছুর রহমান বলেন, ‘প্রধামন্ত্রীর কার্যালয়ের যে নির্দেশনা রয়েছে, সে অনুযায়ী আমরা কাজ চলমান রেখেছি। রোড মার্কিংয়ের যে রং রয়েছে তার লাইফ হচ্ছে তিন মাস। এ কারণে ওই নির্দিষ্ট সময় পরপর আবার কাজ করতে হয়।’
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা বলেন, ‘আমাদের কাজ চলছে। এরই মধ্যে আমরা ট্রাফিক সিগন্যালগুলোর ত্রুটি মেরামত করে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকে বুঝিয়ে দিয়েছি। তাদের সঙ্গে আমাদের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সার্কেল কাজ করছে। অন্য পদক্ষেপগুলোর মধ্যে সামান্য কিছু বাকি আছে। সেগুলো খুব অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।’
সরজমিনে দেখা গেছে, দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকার প্রায় ১৩০ স্থানে বাস স্টপেজের জন্য নির্ধারিত স্থান চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে। এসব স্থানে যাত্রীদের বসার জন্য দৃষ্টিনন্দন ছাউনির ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু কোন বাসই সেই স্থানগুলোতে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করায় না। পাশাপাশি চলন্ত অবস্থায় গাড়ির দরজা বন্ধ রাখা, দূরপাল্লার বাসে যাত্রীদের জন্য সিট বেল্ট রাখা, বাসের মধ্যে চালক ও হেল্পারের বৃত্তান্ত, বড় অক্ষরে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নাম্বার লাগানোসহ বেশ কিছু নির্দেশনা থাকলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। তবে সরকারী প্রতিষ্ঠান বিআরটিসির কিছু পরিবহনে চালকদের জীবন বৃত্তান্ত ও গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নাম্বার লাগাতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের (বিআরটিসি) সচিব নূর-ই-আলম বলেন, ‘আমাদের পরিবহনে চালকের ছবিসহ জীবন বৃত্তান্ত লাগানো হয়েছে। কোন চালক এই নির্দেশনা অমান্য করলে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।’
গত বছরের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও লাইসেন্স বিষয়েও বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এরমধ্যে অবৈধ পরিবহনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া, ফিটনেস সনদ দেয়ার আগে সরজমিনে পরিবহন দেখার ব্যবস্থা, রুটপারমিট বা ফিটনেসবিহীন যানবাহনগুলোকে দ্রুত ধ্বংস ও লাইসেন্স প্রদান প্রক্রিয়া তরান্বিত করা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব কাজের মধ্যে বিআরটিএ কিছু কাজ শুরু করলেও এখনও রাস্তায় ফিটনেসবিহীন যানবহন চলতে দেখা যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় কিছু গাড়ি আটক ও অবৈধ চালকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও এখন তা মূলত অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনাগুলো সব পরিবহন মালিককে জানিয়ে দিয়েছি, যারা এই নির্দেশনা মানছেন না, তাদের বিরুদ্ধে অনেকবার ভিজিল্যান্স টিমের মাধ্যমে অভিযান করেছি। তবে এখানে অনেক প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। চালকরাও সচেতন হচ্ছেন।’ সম্প্রতি নগরীর বেশ কিছু এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জেব্রা ক্রিসিং থাকলেও রাস্তা পারাপারে তা ব্যবহার হচ্ছে না। অনেক স্থানে এই ক্রসিংয়ের ওপরেই পরিবহনগুলোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। রিমোট কন্ট্রোল ব্যবস্থায় ট্রাফিক সিগন্যালগুলোও পরিচালনার কথা থাকলেও তা চলছে পুলিশের হাতের ইশারায়। জানতে চাইলে ডিএসসিসির নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের ডিজিটাল ট্রাফিক সিগন্যালগুলোকে রিমোর্ট সিস্টেমে রূপান্তর করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে আমরা বেশ কয়েকটি হস্তান্তর করেছি। বাকিগুলো হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।’
এ বিষয়ে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক-দক্ষিণ) মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সিগন্যালগুলো আমরা পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকবার ব্যবহার করেছি। কিন্তু বিভিন্ন ত্রুটির কারণে এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি আমরা সিটি কর্পোরেশনকে জানিয়েছি।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গবর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিটের উপ-পরিচালক (সক্ষমতা বিকাশ) মোহাম্মদ আলী নেওয়াজ রাসেল বলেন, ‘ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এর আগে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী জেলার সমন্বয়ে আমাদের বেশ কিছু কো-অর্ডিনেশন মিটিং হয়েছে। হয় তো আগামী সপ্তাহে আমরা আরও কয়েকটি মিটিং করব। যে সিদ্ধান্তগুলো নেয়া হয়েছিল, সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়েছে তা না, প্রক্রিয়াধীন। মাঝখানে নির্বাচন ও অন্য কিছু কারণে একটু ডিলে (দেরি) হয়েছে।’ তবে এবার এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পুরোদমে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: