ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ জোয়ার ভাটা

প্রকাশিত: ০৭:৫০, ১১ জানুয়ারি ২০১৯

 গল্প ॥ জোয়ার ভাটা

ওর একটা স্বার্থ আছে। ওর ভালো আচরণে ওর সংগঠনে কিছু লোক বাড়বে। বাড়তি লোকগুলো প্রয়োজনের সময় ওর অনুগত হবে- এরকম সম্ভাবনাই ও দেখছে। তাই ও কেবল ভালো ব্যবহার করে বেড়াচ্ছে। তবে ভালো ব্যবহারের দাবি কেউ করে বসলে, ওর সত্যিকারের রূপ বেরিয়ে আসে, যে রূপের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই, একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের অসুবিধা দূর করা। ভালো আচরণ করা চিরকালই ওর কাছে অসুবিধার বিষয়। তাই ভালো কিছু করে ফেললে, তা থেকে উপর্যুপরি সুবিধা আদায় করে নিয়ে অসুবিধাটা পুষিয়ে নেয়। আপাতত যে সুবিধাটি নিয়ে ও চিন্তিত, সেটি হচ্ছে গোলাপনগরে জাতীয় মোর্চার কমিটি গঠন হচ্ছে, ও সভাপতি হতে চায়। দাঁড়ালেই হতে পারবে-সেটা সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে, সাধারণ সম্পাদক, সহ-সাধারণ সম্পাদক, কোষাধ্যক্ষ, আহŸায়ক, প্রচার সম্পাদক, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক- যা-যা হলে একটা দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দাঁড়ায়, তার সবগুলোতে বসাবার মতো অতজন মোর্চা-সমর্থক গোলাপনগরে নেই। ও দাঁড়ালে সামনে বসার লোক যদি না থাকে, তাহলে আর দাঁড়িয়ে থেকে কী লাভ? ও উপরে উঠলে যদি নিচে কেউ না থাকে, তাহলে কী করে বোঝা যাবে ও উপরে আছে? তাই মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে যখন শাকিল ভাই গোলাপনগরে এসেছিলেন, তিনি পইপই করে বলে গেছেন, ‘একটা কমিটি দাঁড় করাবার মতো লোকজন অন্ততপক্ষে জোগাড় করো, না হলে এলাকায় একটা মসজিদের জন্য কী করে পয়সা আনি? চাইতে গেলেই তো জিজ্ঞাসা করে বসবে, ‘তোমার এলাকায় লোকবল কী পরিমাণ আছে?’ তা না হয় মিথ্যে করে বলা গেল, কিন্তু কমিটি একটা না থাকলে কি বিশ্বাস করানো যাবে?’ শাকিল ভাইয়ের কথা শুনে জাফর মহা ফাপড়ে পড়েছে। পকেটে পয়সা নেই। মানুষের সঙ্গে কেবল ভালো ব্যবহার করে বেড়াচ্ছে। সরকারী দলে থাকতে শাকিল আর জাফর একসঙ্গে ছিল। শাকিলবিরোধী দলের জাতীয় মোর্চার কেন্দ্রীয় কমিটিতে যোগ দিলে, ওর অনুরোধে জাফরও বিরোধী দলে যোগ দেয়। তবে কোনো পদ পায়নি, বরং বিপদ হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতা হিসাবে, শাকিল এখন তাকে তুমি-তুমি করে বলে, ফরমায়েশ দেয়, জাফর নীরবে সহ্য করে, যদিও সে শাকিলের চেয়ে বারোতেরো বছরের বড় হবে। সরকারী দলে থাকতে দুজন দুজনকে আপনি-আপনি করে বলত। রাজনীতিতে হয়তো এটাই নিয়ম। জাফর সে নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলছে- সেন্ট্রাল কমিটির নেতা বলে কথা, যেখানে পৌঁছাতে ওর অন্ততপক্ষে দশ বছর লাগবে। দশ বছর সময় না হয় দেওয়া গেল- সেটা কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে, ওকে বিএ পাস করতে হবে- নেতা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ননগ্র্যাজুয়েট কাউকেই কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আসতে দেওয়া হবে না। বিএ পাস সে করতে পারবে না, ইতিহাস, পৌরনীতি, ইসলামী শিক্ষা নিয়েও না। ইংরেজীতে ফেল করবে, এমনকি দুই-তিন পেয়েও ফেল করতে পারে, কারণ সে ইংরেজী প্রশ্ন পড়েও বুঝতে পারে না, কী চেয়েছে, উত্তর দেওয়া তো পরের কথা। তাই শাকিলকে সে অবলীলায় ভাই ডাকতে শুরু করেছে, শাকিল তাকে মৌজ করে তুমি-তুমি করছে। গোলাপনগরের হাট থেকে যে পথটা ক্যানালের দিকে গিয়েছে, সে পথ দিয়ে অল্প কিছুদূর এগুলেই চারপাশে আগাছায় ঘেরা এক টুকরো জমি চোখে পড়ে, যার মাঝখানে বটগাছের মতো পুরনো একটা গাছ কোনোভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ডালপালা চোখে পড়ার মতো একদুখানাও নেই, কেবল মোটা একটা কান্ড দুহাতে জটপাকানো কয়েকটি ঝুরি বুকে জড়িয়ে ধরে আছে। নতুন ঝুরি বেরুনোর উপায় অনেক দিন ধরেই বন্ধ হয়ে গেছে। চারপাশের আগাছার মাঝখানে জমির পরিমাণ দেড়-দুই বিঘা হবে-পতিত। মন্তাজ মোল্যা গাঁয়ের পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করেছে, মসজিদ ওই জায়গাটাতেই হবে, যদিও জায়গাটা তাদের পাড়া থেকে বেশ দূরে। কিন্তু লোকেশন হিসাবে খারাপ না। এরপর থেকেই জেলেপাড়া শুরু-ওরা গিয়ে-থেকে এখনও বিশবাইশ ঘর আছে। মন্তাজ মোল্যা সরকারী দলের স্থানীয় কমিটির সভাপতি। সে শহরে গিয়েছে টাকা আনতে। নেতাকে সে গতবার বুঝিয়ে এসেছে, গ্রামে একখানা সুন্দর মসজিদ না দিলে, লোকজন ধরে রাখা কঠিন হবে, জায়গা ঠিক হয়েছে, টাকা লাগবে, টিন লাগবে, ইট-বালু-সিমেন্ট লাগবে। নেতা বলেছিল, ‘দেখি, কী করা যায়।’ সামনে ইলেকশন আসছে। মিছিল হচ্ছে, জমছে না। ডাক দিলে লোকজন চা খেতে বসে যায়, ‘এই আইসতেছি।’ দুইতিন জন ব্যানার ধরে হাটের মাঝখানে ঘুরতে থাকে। ঘণ্টাখানিক ঘুরে ঘুরে যে দুই চারজন যোগাড় হয়, কিছুক্ষণ স্লোগান দিয়ে, আবার রাস্তার ধারে চা খেতে বসে পড়ে, ‘একটু জিড়েতি হয় না, খালি গলায় কতক্ষণ চিল্লেনু যায়?’ নৃপেণ বোঝে ওদের সমস্যা, ‘মন্তাজ মুল্যা আইসতেছে। সব কিন্তু কইয়ে দিবানে।’ মনতাজ মোল্যার আসতে দেরি হচ্ছে। বোধহয় টাকার যোগাড় হচ্ছে না। সবাই এখন শহরে, কারোর নদীতে বাঁধ দিতে হবে, কারোর এতিমখানা, কারোর পুজোমন্ডপ, কারোর শহীদ মিনার, কারোর বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী, কারোর বা শুধু ফুটবল টুর্নামেন্ট। মন্তাজ মোল্যার শুধু একখানা মাইকঅলা মসজিদ। মফস্বলে মিছিল জমছে না। শহর থেকে লোকজন ফিরে এলে, মিছিল জমবে-গোলাপনগর, গোপীনাথপুর, আবাইপুর, হাজিগঞ্জের হাটে মাঠে বাটে মিছিলে মিছিলে সরগরম হয়ে উঠবে। লোকজন চা খেয়ে খেয়ে গলা পরিষ্কার করে রাখছে। গ্রামে খবর আসল, মন্তাজ মোল্যা ঢাকা থেকে রওনা দিয়েছে। সকালে খুলনার বাসে উঠেছে। সদরে নেমে কিছু কাজ সেরে লোকাল বাসে করে গোলপানগরে পৌঁছাবে। সবাই গোলাপনগর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। যে কোনো সময় যে কোনো বাস থেকে মন্তাজ মোল্যা নেমে আসতে পারে। তাকে সংবর্ধনা দিতে হবে। মালা তৈরি করা আছে। বাস থেকে পা নামালেই গলায় মালা পরিয়ে দেবে। গোলাপনগর হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ফার্স্ট গার্ল বেণুকা রাণী রাজবংশী প্রস্তুত। ও ওর মায়ের সঙ্গে এসেছে। বাসস্ট্যান্ডের একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। নৃপেণ দুবার গিয়ে ভাতিজি ও বড়বৌদিকে চা খাইয়ে এসেছে। বলে এসেছে, ওকে না বলে যেন কোথাও না যায়। বেনুকা অস্থির হয়ে পড়েছে। কখন মনতাজ মোল্যা বাস থেকে নামবে, কখন মালা পরিয়ে কাজ শেষ করে বাড়িতে যাবে, হোমওয়ার্ক করতে হবে। বিকেলের আগে না ফিরলে, একটা বিকেল মাটি হবে, মিনু-বিমলাদের সঙ্গে আজ আর খেলা হবে না, ওরা কী সুন্দর চি-বুড়ি খেলে বিকেলটা ফুর্তি করে বেড়াবে। ওর বুঝি আজ আর খেলা করা হবে না। সেজেকা’ই এই বিপদে ফেলল ওকে। গোলাপনগর বাসস্ট্যান্ডে একটা নীল রঙের বাস এসে থামল। লোকজন সরু চোখে বাসের দরজার দিকে তাকিয়ে নড়াচড়া করে উঠল। মন্তাজ মোল্যা নেমেই মফিজারকে ঠাস্ ঠাস্ করে দুই গালে দুই চড়। চড়ের ঘায়ে বেনুকার এগিয়ে দেওয়া মালাটা ছিঁড়ে দুইভাগ-একভাগ অপেক্ষমাণ দলীয় কর্মীদের পায়ের ফাঁক দিয়ে রাস্তার উপরে, অন্য ভাগ বেনুকার হাতে ধরা। ঘটনার আকস্মিকতায় বেনুকা হতভম্ব। মালা ধরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে-এ কী হলো! বেনুকা মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে আছে-মনে হয় চড় একটা ওকে মেরেছে। বেনুকার মা-ও মুখ ভোঁতা করে দাঁড়িয়ে আছে- মনে হচ্ছে অন্যটা তাকে মেরেছে। নৃপেণ ওদেরকে একটু দূরে সরিয়ে রেখে এসেছে। এদিকে গালাগাল চলছে। মনতাজ মোল্যা পান খাওয়া দাঁত বের করে গালাগাল করছে, ‘ইন্দুরির বাচ্চা! কইছি না বারবার কল দিবিনে। তোর কলের জন্যি-ই তো আমার এইরকম সর্বনাশটা হইল।’ সবাই হা-করে তাকিয়ে আছে। ‘কী সর্বনাশ হইছে, মন্তাজ কাকা?’ ভিড়ের ভেতরে কার গলা যেন শোনা গেল। ‘কী সর্বনাশ হইছে, সিডা কি তুমারে কথি হবি নাকি!’ মন্তাজ মোল্যা ঘাড় কাত করে প্রশ্নকারীর দিকে তাকাল। সবার চোখ পড়ল সেদিকে- তাই তো, ওকে কেন বলতে হবে, ও কে, আর এখানেই বা এলো কিভাবে? নৃপেণ খেকিয়ে উঠল, ‘এই, তুই হ্যানে ক্যাঁ? তোর হ্যানে কী কাম?’ জাফর বিড়বিড় করতে করতে সরে গেল, ‘ভালো মনে কইরে জানতি চালাম...।’ ‘মন্তাজ দা’, তুমার কী হইছে খুইলে কও,’ নৃপেণ যদ্দুর সম্ভব কণ্ঠে দরদ মিশিয়ে বলল। সবাই বলে উঠল, ‘কও! কও!’ ‘আমার আর কী হবি? হইলো তো আমাগের।’ মন্তাজ মোল্যার কণ্ঠে সর্বনাশের সুর। ‘আমাগের!’ ভিড়ের ভেতরে কেউ কেউ বলে উঠল। ‘হ, আমাগের,’ মন্তাজ মোল্যা একবার ঢোক গিলে বলল। ভিড়ের ভেতরে কেউ একজন অধৈর্যের সঙ্গে অনুযোগ করল, ‘আমাগের কী হইল?’ ‘কপাল পুইড়ল। ওই ইন্দুরির বাচ্চার জন্যি,’ মন্তাজ মোল্যা আবার খিস্তি করল। মফিজার দূরে তেড়চা হয়ে দাঁড়িয়ে গাল ডলছিল, মন্তাজ মোল্যার দিকে কান খাঁড়া করে রেখেছিল। নৃপেণ বলল, ‘ও কী করেছে?’ ‘কী আর করবি? মুবাইলি কল মারাইছে,’ মন্তাজ মোল্যা খেকিয়ে উঠল। ‘তাতে কী হইল?’ নৃপেণ ওর মুখে যদ্দুর সম্ভব উদ্বেগ মাখিয়ে বলল। ‘ওর মুবাইল আমি ধরতি গিছিলাম...’ ‘ধরতি গিছিলে...’ ‘ধরতি গিলাম, আর...’ ‘ধরতি গিলে, আর...’ মন্তাজ মোল্যা পাঞ্জাবির পকেটে ডান হাত ঢুকিয়ে পকেট উল্টিয়ে বের করল। জনতা সমস্বরে আক্ষেপ করে উঠল, ‘সর্বনাশ! কাইটে ফ্যালেছে!’ ‘তালি আর কী কচ্ছি? ওই ইন্দুরির বাচ্চার জন্যি-ই তো হইলো। বারবার ওরে মুবাইল মারাতি কিডা কইছে?’ সবার ভেতরে মৃদু গুঞ্জন। মন্তাজ মোল্যার চোখ টলমল করছে, ‘ম্যালা স্বপ্ন দেখিছিলাম, ইলেকশন আসবি আর মসজিদটা বানায়ে নেব...।’ মন্তাজ মোল্যা হু-হু করে কেঁদে উঠল। মফিজার এতক্ষণ ঘোরতর অপমানে অভিমান করে ছিল, এখন গুরুতর অপরাধে বুক ভাসিয়ে দিল। নৃপেণের মুখ ভার। যদ্দুর সম্ভব চোয়াল ঝুলিয়ে ফেলল। ঘটনার আকস্মিকতায় কেউ দেখেনি, চোয়াল ঝোলানোর আগে নৃপেণ একবার ফিক করে হেসে উঠেছিল; কেউ শোনেনি, নৃপেণ অস্ফুট স্বরে একবার ‘হরিবোল’ বলে ফেলেছিল। পাড়ার লোকদের সঙ্গে ওর সম্পর্ক আবার ভালো হয়ে যাবে। জেলেপাড়ার কাছে মসজিদ করার বিষয়ে জেলেপাড়ার লোকজন নিমরাজি। ওরা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। একবার মুখ ফুটেছিল। মন্তাজ মোল্যা সদর থেকে মÐপের পুরোহিত নিয়ে এসেছিল গোলাপনগরে। জেলেপাড়ার লোকদের সাথে বসে ধর্মীয় সমাধানটা করিয়ে নিয়েছে। পুরোহিত গল্প দিয়ে গেছে, কোন দেশে নাকি মসজিদ মন্দির এক ছাদের নিচেই আছে। তাতে ধর্মের দিক থেকে সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু জেলেপাড়ার রাজবংশীরা ধর্ম অতদূর মানতে যায় না, তাই ধর্মের কথা তাদের ভালো লাগেনি; ওরা সমাজ মেনে চলে, তাই সমাজে অশান্তি এলো; ওরা মনের নিয়মে চলে, তাই মনে ব্যথা পেল। সেদিন গোলাপনগরের মাছের আড়ৎদার ইদু মুন্সিও ছিল। মন্তাজ মিয়া কনুই দিয়ে দুইবার গুঁতো দিলে, ইদু মুন্সি মুখ খোলে। আড়ষ্ট গলায় কিছু বলে, ‘তুমাগের কিছু দিবানে।’ মন্তাজ মিয়া খেকিয়ে ওঠে, ‘দিবানে!-দিবানে’ মানে কি? উরা কি তুমার কাছে ভিক্ষে চাইছে?’ ইদু মুন্সি আর কিছু বলতে পারল না। গলা দুবার খাকাড়ি দিয়ে পান চাবাতে থাকল। দরবার শেষ হলে মন্তাজ মিয়া নৃপেণকে ডেকে নিয়ে গেল। ইদু মুন্সির মাছের আড়তে ওকে পার্মানেন্ট সাপ্লায়ার বানিয়ে দিলো। ইদু মুন্সি বলেছিল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা!’ নৃপেণ বলেছিল, ‘সারাবছর মাছ ওঠে না।’ ইদু মুন্সি বলেছিল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা।’ মন্তাজ মোল্যা ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘আচ্ছা-আচ্ছা’ কী! কও ক্রাইসিসির সুমায় মাছের দাম আগাম দিয়ে রাখবা,’ ইদু মুন্সি কিছু বলছিল না দেখে, মন্তাজ মোল্যা আবার ধমক দিলো। ইদু মুন্সি বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা।’ তারপর থেকে নৃপেণ সময়ে-অসময়ে ইদু মুন্সির কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসছে। সে টাকার একটা অংশ ভাতিজির পড়ার খরচের জন্য বড় বৌদির হাতে দেয়। বড় বৌদি কিছুই বলে না। পাড়ার লোকজন বলে। বড় দা’ একদিন বউকে চুলের মুঠি ধরে উঠোনে বের করে আনল। চেঁচামেচি শুনে পাশের বাড়ি থেকে জেলেবউরা আওয়াজ দিতে লাগল- ‘বউ কি আর মানুষ উঠোনে নামায়ে মারে? মারতি লাগলি, ঘরের ভিতরেই মারে, আমরা ওসব বুঝি নে মনে করছ? ওই টাকা নিয়েই তো তুরা আমাগের মুখি চুলকালি দিলি। আমরা বুজি নে, তাই না?’ রাতে, অন্ধকারে ব্যাঙ ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর শুরু করলে, বড় দা’ ভবেন বউয়ের চুলের ভেতরে হাত দিয়ে বলেছিল, ‘তোর খুব লাগেছে, তাই না রে?’ বড় বৌদি বালিশের ওপর থেকে এক ঝটকায় মাথা সরিয়ে বালিশের নিচে ঢুকিয়ে রাখল। নৃপেণ সব জানে। বড় দা’ বাড়িতে না থাকলে বৌদির হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে চলে আসে। জাফরও এ যাত্রায় বেঁচে গেল। সরকারী দলের টাকায় শীঘ্রই আর মসজিদ হচ্ছে না। নৃপেণ ওর ভাতিজি বেনুকা রাণী আর বড় বৌদি রেনুকা বালাকে নিয়ে ভ্যানে চড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলো। ওর মনও ফুরফুরে। ‘তুই কি ভয় পাইছিলি?’ নৃপেণ হাসতে হাসতে ভাতিজিকে জিজ্ঞাসা করল। ওর বুক থেকে একটা ভার যেন নেমে গেল। এ যাত্রায় জেলেপাড়ায় ঢোকার মুখে মাইকঅলা মসজিদটা আর হচ্ছে না। ভ্যানে যেতে যেতে বৌদিকে যেন সে কথা একবার বলে ফেলতে গিয়েছিল। কিন্তু ভ্যানঅলার দিকে তাকিয়ে আর বলল না। বাড়ি গিয়ে বলবে। জাফর আবার ভালো ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। হাটবাজারের লোকজনদের চায়ের বিল ও দিয়ে দিচ্ছে। মালেক, মজনু, গণি, বিরাট, বিশালরা মাঠ থেকে গরু নিয়ে ফিরতে থাকলে, ও ক্ষেত্রবুঝে সালাম-আদাব দিয়ে বেড়াচ্ছে, আর মাঝে মাঝে হাত ধরে চাচাজি চাচাজি করছে। ক’টা দিন আগেও মন্তাজ মোল্যার ফিরতে দেরি দেখে ওর মেজাজ খিঁচে উঠেছিল-টাকা বোধহয় এবার নিয়েই ফিরবে। মজিদ খাঁ ধানের বীজতলা করার জন্য কিছু টাকা চাইতে এলে ও ধমকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল, ‘টাকা কি গাছে ধরে, চালি-ই পাওয়া যায়!’ মজিদ খাঁ অপ্রত্যাশিত খিস্তি শুনে ভড়কে গিয়েছিল। আগের হাটের দিনও সে মজিদ খাঁকে হাটে পেয়ে হাত ধরে বলে এসেছিল, ‘বিপদ আপদ তো মাইনসিরই হয়, আমরা না দেখলি আর কিডা দেখবি?’ মজিদ খাঁ এক গাল হেসে, বাবাজি বাজাজি করে গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। মজিদ খাঁ আজ বাজারে জাফরকে দেখে বিপাকে পড়ে গিয়েছিল। সে বাজারের রাস্তায় জাফরের সামনে গিয়ে পড়ল। জাফর চোখ ফিরিয়ে নিয়েও, নিতে পারল না, মুখ ফসকে বলে বসল, ‘চাচাজি বীজতলা বানাইছ?’ জাফর কথাটা বলে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মজিদ খাঁর কথায় জাফর থেমে গেল, হাত ধরে চাচাকে চা খাওয়াতে নিয়ে গেল। মজিদ খাঁ শুধু বলেছিল, ‘বাপু, বানানো সারা, বড় জামাই কিছু দেছে, আর তুমার চাচির কাছে কিছু ছিল। তা-ই দিয়ে কোনোমোতে...।’ মিছিল হয়। মন্তাজ মোল্যাকে তেমন দেখা যায় না। জাফরকে দেখা যায়। লোকজন নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান দিয়ে বেড়াচ্ছে। জাফর বলে বেড়াচ্ছে, ‘শাকিল ভাই গোলাপনগরে আইসতেছে।’ মন্তাজ মোল্যার লোকজন জাফরের সাথে মিছিল করে চা খেয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে। মন্তাজ মোল্যা ওদের খোঁজ রাখে না। ওরা মন্তাজ মোল্যার খোঁজ রাখে। মন্তাজ মোল্যা খুব ব্যস্ত। গ্রামে গ্রামে দাওয়াত দিয়ে বেড়াচ্ছে। কেনাকাটা মেজবানি করার জন্য বাড়িতে জ্ঞাতিগুষ্ঠিদের নিয়ে সকালসন্ধ্যা দরবারে বসছে। সামনে ওনার বড়ো মেয়ের বিয়ে। গোপীনাথপুরের হাজি ইনসান উদ্দীনের ছেলের সাথে। এর আগেও গোটা পাঁচেক সমন্ধ এসেছিল। পত্তায় পড়েনি দেখে পাত্রপক্ষ না বলে দিয়েছিল। হাজি ইনসান উদ্দিনরাও আগে একবার দেখে গিয়ে না-বলে দিয়েছিল। এবার ঢাকা থেকে ফিরে এসে, মন্তাজ মোল্যা গ্রামের দু’চারজনকে ধরে হাজি ইনসান উদ্দিনের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্ভাবনা আর একবার ঝালাই করার উদ্যোগ নিয়েছিল। পাত্রপক্ষের লোকরা মাঝরাত পর্যন্ত কথাবার্তা বলে, বিয়ের দিন দিয়ে গেছে। নৃপেণ সরকারী দলের হয়ে লোকজনদের মিছিলে ডাকে। তেমন সাড়া পাচ্ছে না। চা খাওয়াতে চায় না দেখে, ওরা একজন দুজন করে জাফরের সঙ্গে হাত মিলাচ্ছে। জাফর হাতের মুঠোর ভেতরে ওদের হাত চেপে ধরে কত কথা বলে। ইলেকশনের আগেই বোধহয় কমিটি গঠন করা সম্ভব হবে। শাকিল ভাইকে খবরটা দিতে হবে। মসজিদের টাকা এসে গেলে লোকজনকে আর ডাকাডাকি করতে হবে না, লোকজন এমনি আসবে। শাকিল ভাই গ্রামে আসছে শুনে মন্তাজ মোল্যা নিজের লোকজন খুঁজে নিয়ে চাঙ্গা করতে শুরু করল। সে মিছিলে আসছে। তার মেয়ের বিয়ের ঝামেলা মিটে গেছে। মেয়ে এক যাত্রায় দুটোই পার হয়ে গেছে, একই বাড়িতে হয়েছে- একটা নিয়েছে ইনসান মোল্যার ছোটছেলে, অন্যটা ইনসান মোল্যার সৎ ভাইয়ের বড়ছেলে। বড়টাকে বিয়ে করতে এসে ছোটটার ওপরও ওদের নজর পড়ল। ওরা মন্তাজ মোল্যার সঙ্গে কথা বলে বুঝল, মেয়ে এটাও সে দিতে রাজি। তারপর আরেকটু কথাবার্তা বলে বুঝল, সে আয়োজনও তার আছে, আর সে রাতেই সে তুলে দিতে পারবে। তবে আর দেরি করা কেন? মন্তাজ মোল্যা স্লোগান দিচ্ছে, ‘মার্কাডা কী?’ বিক্ষিপ্ত স্বরে লোকজন উত্তর দিচ্ছে, ‘গুঁইসাপ!’ ‘কোন্ সে মার্কা?’ ‘গুঁইসাপ।’ স্বর বিক্ষিপ্ত হবার কারণে, স্লোগান মনে হচ্ছে না, চেঁচামেচি মনে হচ্ছে। অন্যসময় হলে, মন্তাজ মোল্যা খেকিয়ে উঠত। আজ চায়ের দোকান দেখে মিছিল থামিয়ে দিলো। হে-হে করে হেসে বলল ‘একটু চা খাইয়ে নে তুরা।’ শাকিল ভাই ভ্যানে করে টিন আর একটা বড় মাইক নিয়ে গ্রামে এসেছিল। জাফরের বাড়িতে রেখে গেছে। যাবার আগে পাড়ার মুরব্বিদের নিয়ে জেলেপাড়ায় গিয়েছিল। সবাইকে ডেকে নিয়ে মসজিদের জন্য দাগ কেটে খুটো গেড়ে গেছে। নৃপেণও ছিল। জাফর মন্তাজ মোল্যাকে বাড়ি গিয়ে খবর দিয়ে এসেছিল। মন্তাজ মোল্যার ছোটছেলে বেরিয়ে এসে বলেছিল, ‘আব্বার ডাইরিয়া।’ হৈ-হৈ করে সবাই কাজ শুরু করে দিলো। বটগাছ কাটার দায়িত্ব দেওয়া হলো নৃপেণকে। নৃপেণ লোকজন নিয়ে সাতসকালে উঠেই ঘ্যাঁস্ ঘ্যাঁস্ বটগাছ কাটতে বসে গেল। জাফর লুঙ্গির এক কোনা তুলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে কাজ তদারকি করছে। তার মুখে আজ কেবল বোলচাল। কাজ থামিয়ে হাঁটুর উপরে হাত ঝুলিয়ে বসে বিড়ি টানতে দেখলেই খিস্তি, ‘মজা কইরতি আইছ তাই না? ইলেকশনের আর কয়দিন আছে খবর আছে?’ এমন সময় মফিজারকে দেখা গেল বিড়ি টানতে টানতে ভ্যানে করে আসছে, দুইপায়ের মাঝখানে কোদাল রেখে ভ্যানের সামনে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। ভ্যান থামতে থামতে, জাফর লুঙ্গির কোনা ছেড়ে দিয়ে ত্রস্ত পায়ে ভ্যানের কাছে এগিয়ে গেল, ওর দুইগালে ঠাস্ ঠাস্ করে দুই চড় মেরে ভ্যান থেকে নামিয়ে আনল, ‘ইন্দুরির বাচ্চা, তোর এখন আসার সুমায় হইলো?’
×