ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কবিতায় পরাবাস্তবতা

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ১১ জানুয়ারি ২০১৯

 কবিতায় পরাবাস্তবতা

পরাবাস্তবতা হচ্ছে এমন এক ধরনের বাস্তবতা যার সঙ্গে চাক্ষুষ বাস্তবতার কোন মিল নেই। ইংরেজীতে সুররিয়েলিজম (surrealism) বলা হয়। বস্তুত চেতনার মূল ভিত্তি হলো অযুক্তি ও অবচেতন। ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক ধারণা মিলানো যায় এখানে। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের ভাবনা- মানুষ অবচেতন মনে অনেক কিছুই করে বা ভাবে। তিনি বলেন- এ ভাবনা চেতন মনের চেয়ে অবচেতন মনেরই বেশি। পরাবাস্তবতা হচ্ছে মানুষের চেতনটা যখন শিথিল হয় তখন মানব মনে অবচেতন প্রভাব ফেলে। এটি হচ্ছে- কবির প্রতীক ও চিত্রকল্পসমূহের মধ্যে যোগসূত্র। মূলত সুইজারল্যান্ড থেকে উঠে আসা ‘ডাডাইজম’ এর পরবর্তী আন্দোলন হচ্ছে ‘সুররিয়েলিজম’ বা ‘পরাবাস্ততা’। এখন আবার যা জাদুবাস্তবতা বলছেন অনেকে। মার্ক আর্নেস্ট এর সংজ্ঞা আমরা তুলে ধরতে পারি। সুররিয়েলিজমকে তিনি বলেছেন- সুর রিয়ালিস্টের লক্ষ্য হচ্ছে- অবচেতনার বাস্তব চিত্র আঁকা নয় কিংবা অবচেতনার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে কল্পনার আলাদা এলাকাও সৃষ্টি করাও নয়। এর লক্ষ্য হলো চেতন ও অবচেতন মনের সঙ্গে বাইরের জগতের সব দৈহিক ও মনের বেড়া তুলে দেয়া।(… to create a super-reality in which real and unreal meditation and action, meet and mingle and dominate the whole life.) ইতালিতে জন্মগ্রহণ করা ফ্রেঞ্চ আপোলিনিয়ার (১৮৮০-১৯১৮) ‘সুররিয়েলিজম’ শব্দটি উল্লেখ করেন। তাঁর লেখা কবিতায় আদি-সুররিয়েলিজম কাব্যের নিদর্শন রয়েছে। ‘টাইরেসিয়াম-এর স্তন’ নাটকে প্রথম সুররিয়েলিজম প্রয়োগ করেন তিনি। পরে তা ইংরেজী ও জার্মান সাহিত্যেও এ ধারা সম্প্রসারণ হয়। ‘চাঁদের আলো’ কবিতায় তিনি পরাবাস্তবতাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন এভাবে- ‘ক্রোধীর ঠোঁটে শ্রবণসুখকর চাঁদ আর রাতের লোভার্ত নগর ও উদ্যান মৌমাছির মতো নক্ষত্রদের ভ্রম হয় এই আলোকময় মধুতে আঙুরবাগান আহত আকাশ থেকে ঝরছে মধুর মধু চাঁদের রশ্মি যেন মধুর ঝিকিমিকি ...হাওয়ায় গোলাপে মিশছে মধুর চন্দ্রিমা।’ বাঙলা সাহিত্যে অনেকে পরাবাস্তবতার বেশ কিছু প্রয়োগ করেছেন। বর্তমানকালের প্রায় সব কবিই পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বা কাজী নজরুল কবিতা/গানে সামান্য পরাবাস্তবতার উপাদান ব্যবহার করেছেন। যেমন ‘আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই, সেই পাহাড়ের ঝরনা আমি...।’ বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, শক্তি চট্টপাধ্যায়, সুনীল, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, মান্নান সৈয়দ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ কবিতায় পরাবাস্তবতা এনেছেন মাঝে মধ্যে। আধুনিক বাংলা কবিতায় কবি বিষ্ণু দে তাঁর ‘ঊর্বশী ও আর্টেমিস’ কাব্যগ্রন্থে প্রথম সার্থক সুররিয়েলিজম বাপরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেন। তবে পরাবাস্তবতার উপাদান সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তাঁর ‘ঝরাপালক’, ‘বনলতা সেন’, ‘ধূসর পান্ডু লিপি’ কাব্যগ্রন্থে পরাবাস্তবতার ব্যবহার অনেক বেশি। তাঁকে ‘পরাবাস্তবতার কবি’ বলা হয়ে থাকে। পরাবাস্তবতার সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন এ বিষয়ে। কয়েকটি উদাহরণ দিই। ‘জানতাম তোমার চোখে একদা জারুলের বন ফেলেছে সম্পন্ন ছায়া, রাত্রির নদীর মতো শাড়ি শরীরের চরে অন্ধকারে জাগিয়েছে অপরূপ’- (কোন এক পরিচিতাকে, শামসুর রাহমান) ‘অনেক আকাশ’ কবিতায় সৈয়দ আলী আহসান ধরা দিয়েছেন এভাবে- ‘... সোনার ঘাসের পাতা ঘুমের মতো অজস্র পাতার ফাঁকে হৃদয়ের নদী হয় চাঁদ নেমে ঘাসে’- (সংক্ষেপিত) আল মাহমুদ বেশ কয়েক জায়গায় পরাবাস্তবতার উপাদান ব্যবহার করেছেন। ‘নদীর ভেতরে নদী’ কবিতায় পরাবাস্তবতার একটু প্রয়োগ দেখি- ‘নদীর ভেতরে যেন উচ্চ এক নদী স্নোয়া করে। তিতাসের স্বচ্ছ জলে প্রক্ষালনে নেমেছে তিতাসই। নিজের শাপলা লয়ে নেমে নদী নদীর ভেতরে ঠাট্টা বা বিদ্রুপ নেই, শ্যেনচক্ষু, নেই চারণের বালি।’ মান্নান সৈয়দ বলতেন- সুর রিয়েলিজমই হলো প্রকৃত বাস্তবতা। তিনিও কবিতায় সার্থক পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেছেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ ’(১৯৬৭)। এখানে সুররিয়েলিজমের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তিনি জীবনান্দ দাশ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা লিখেছেন এবং গবেষণা করেছেন। আর এ কারণে জীবনান্দ প্রভাব বিস্তার করেছে কবির মনে। কয়েকটি কবিতায় পরাবাস্তবতার উদাহরণ- ১) ‘দেখেছি ঘাসের মেঝে ছিন্ন লাল মুন্ডু নিয়ে খেলে বিনা অপব্যয়ে সূর্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে কালো রেলগাড়ি।’ (কবিতা, রাত্রপাত) ২) ‘জ্যোৎসনা হয় জল্লাদের ডিমের মতো জলহীন মুন্ডু জোড়া-জোড়া চোখ সাতটি আঙুলের ও একমুষ্টি হাত রক্তকবরীর অন্ধকার এবং একগুচ্ছ ভুল শিয়ালের সদ্যোমৃত যুবতীকে ঘিরে জ্বলজ্বলে চিৎকার’- ( জ্যোৎসনা কবিতায়) ৩) ‘একেকটি দিন একেকটি সবুজভুক সিংহ’ কবিতায়- ‘পরিবর্তনের ছাদ বিড়ালের মতো অন্যমনস্ক হওয়ার সুযোগে পা টিপে-টিপে এগোল বরফের মানুষ নাজেহাল ছোটো-ছোটো নুড়ির আওয়াজ যখন দর্জি কাপড় হয়ে গেল মাংসভুক চেষ্টায়’। পরাবাস্তবতার কবি জীবনানন্দ দাশের কয়েকটি কবিতার কিছু চরণ তুলে ধরি। তিনি পাঞ্জাবির পকেটে চাঁদের উঁকি দেয়া দেখতে পান- ‘দেখি তাঁর চুলে রাত্রি থেমে আছে চোখে সবুজ প্রিজমের ভেতর থেকে লাফিয়ে পড়ে ফড়িং ... বেরিয়ে আসছে সান্ধ্যবেলার সবগুলো তারা দেখি তার পাঞ্জাবির ঢোল পকেটে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ।’ ‘বনলতা সেন’ কবিতাগ্রন্থের ‘তুমি’ কবিতায় জীবনানন্দ লিখেছেন- ‘নক্ষত্রের চলাফেরা ইশারায় চারদিকে উজ্জ্বল আকাশ; বাতাসে নীলাভ হয়ে আসে যেন প্রান্তরের ঘাস; কাঁচপোকা ঘুমিয়েছে- গঙ্গাফড়িং সে-অ ঘুমে; আম নিম হিজলের ব্যাপ্তিতে পড়ে আছ তুমি। মাটির অনেক নিচে চলে গেছ? কিংবা দূর আকাশের পারে তুমি আজ? কোন কথা ভাবছ আঁধারে?’ তাঁর অনেক কবিতায় পরাবাস্তবতার গন্ধ পাওয়া যায়। বর্তমানের অনেক কবিই পরাবাস্তবতা বা জাদুবাস্তবতার প্রয়োগ করছেন সুনিপুণভাবে। আসলে আধুনিক কবিতাকে গতিশীলতা আনতে পরাবাস্তবতার কাছে যেতেই হবে। আর উত্তরাধুনিক কবিতায় এর চাহিদা আরও বেশি। আবু আফজাল মোহা. সালেহ
×