ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নাজনীন বেগম

সুবর্ণচরের পাশবিক নির্মমতা

প্রকাশিত: ০৬:২২, ১১ জানুয়ারি ২০১৯

সুবর্ণচরের পাশবিক নির্মমতা

নির্বাচন পরবর্তী বিজয় উৎসবে যখন সারা বাংলা মুখরিত সেই আনন্দঘন পরিবেশ হঠাৎই স্তব্ধ হয়ে যায় নোয়াখালীর সুবর্ণচরের এক নিভৃত অঞ্চলে ঘটে যাওয়া অমানবিক লাঞ্ছনায়। অত্যাচার, অবিচার আর নৃশংসতার বলি নারীরা আর কতকাল নিজেদের অসহায় এবং দুর্বল ভাববে? আনন্দ-উৎসব, যুদ্ধ, দুর্যোগ কিংবা মহামারী যাই হোক না কেন। দেশের ওপর হয়ে যাওয়া সব ধরনের ভাল মন্দ অবস্থার জাঁতাকালে পড়ে নারীরা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের দীর্ঘ নয় মাসে ২ লাখ মা-বোনের ওপর সম্ভ্রমহানিতার যে করুণ আখ্যান রচিত তা আজও মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে কলঙ্কিত অধ্যায়। শারীরিকভাবে অসহায় এই গোষ্ঠীকে বহুবার নির্যাতন আর নিষ্পেশনের শিকার হতে হয়েছে অকারণে অপ্রয়োজনে। ব্যক্তিক ক্রোধ আর প্রতিহিংসার স্পৃহা কিছু অশুভ শক্তির কাছে পরম আরাধ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। সেখানেও দুর্বল নারীরাই প্রতিশোধের দাবানলে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়। আর গোষ্ঠীগত উম্মত্ততা তো আরও শক্তিশালী হয়ে নারীদের ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। এমন অসহনীয় দুর্ঘটনা যখন বার বার সবার সামনে নগ্নভাবে উপস্থাপিত হয় তাহলে সেই কঠোর দায়ভাগ কার ওপর বর্তায়? ব্যক্তি মানুষের জিঘাংসা চরিতার্থের নগ্ন আঁচড় নাকি পরিকল্পিত কোন হিংস্র গোষ্ঠীর সম্মিলিত অপশক্তির অসভ্য, বর্বর যুগে ফিরে যাওয়ার এক দুর্দমনীয় পাশবিক আকাক্সক্ষা? যার দায় বর্তায় তথাকথিত সুস্থ সামাজিক অব্যবস্থার হরেক রকম দুর্বিপাকে জড়ানো সহিংস মনোবৃত্তির। যা বিকৃত মনোবিকাশের এক অনাকাক্সিক্ষত দুর্বৃত্তায়ন। যা কোন সমাজের চলমান সার্বিক অবয়বকে হিংস্রভাবে লাঞ্ছিত করে। সভ্যতা-বিবর্জিত, ধিক্কৃত মানসিক অস্থিরতায় শুধু নারীরা কেন সামগ্রিক সমাজের সুস্থ আর স্বাভাবিকতাকে বিভিন্নভাবে দুর্বিসহ করে তোলে। তাই এই ধরনের পাশবিক অত্যাচার ঘটার পর সারাদেশ উত্তপ্ত থাকে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়, মানবাধিকার সংস্থাগুলো নতুন উদ্যোমে তাদের দায়-দায়িত্ব শাণিত করে। এমনই দুঃসহ পরিস্থিতিতে অপরাধীরা পালিয়ে বেড়ায়, কোন এক সময় ধরা পড়ে, বিচারের মুখোমুখি হয়- আবার সেখান থেকে বের হয়ে আসতেও দেরি হয় না। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতিকেই সবচাইতে বেশি দায়ী করা হয় এমন ন্যক্কারজনক দুর্ঘটনার জন্য। সবাই ভাবতে বসে অপরাধী যথাযথ শাস্তি পেলে নতুন করে কোন সহিংসতা তৈরি হতে একটু হলেও বেগ পেতে হবে। অর্থাৎ শাস্তির ভয়ে যদি এই ধরনের সহিংস আক্রমণকে রোধ করা সম্ভব হয়। ভয়, শাস্তি, মোহ কিংবা কোন প্রাপ্তির আশায় মানুষের আকাক্সক্ষা যদি নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে তার ভেতরের মানবিকতা, মনুষ্যত্ববোধ কোথায় থাকে? সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধের মধ্যে নারীর প্রতি যে অসম্মান, শ্রদ্ধাহীনতার বিষবাষ্প প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে তাকে সমূলে উৎখাত করতে না পারলে মায়ের জাতের প্রতি অন্যায়-অবিচারেরও কোন সুরাহা হবে না। কিছুদিন আগেও রূপা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার রায়ে অপরাধীদের মৃত্যুদন্ড দেয়া হলেও এরপরে এমন দুর্বিষহ ঘটনার শিকার হতে খুব বেশি সময় নিতে হচ্ছে না। একজন পুরুষের কাছে জীবনের প্রথম নারী তার মা। পরবর্তীতে যদি বোন থাকে সেও। এক সময় বিবাহিত জীবনে স্ত্রীর সান্নিধ্যে সে নতুন কোন নারীর সঙ্গে পরিচিত হয়। শুধু কি তাই? এক সময় কন্যা সন্তানের পিতাও হয় সে। জীবনের এমন গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলো পেরুতে গিয়ে একেবারে কাছের নারীদের প্রতি তার ব্যক্তিক অনুভব, মর্যাদা বোধই শুধু নয় তাকে ভেতরের অন্তর্নিহিত চেতনায় মনন শৌর্যকে বিকশিত করা যে কোন পুরুষের নৈতিক এবং মানবিক দায়িত্ব। সেই দায়বদ্ধতা যদি তাকে ভিতর থেকে তাড়িত না করে তাহলে কোন শাস্তি কিংবা দন্ড এমন ঘৃণ্য অপকর্ম থেকে বের করে আনতে পারবে না। কয়েকদিন পর সুবর্ণচরের নারী নির্যাতনের ব্যাপারটি সবার গা সহা হয়ে যাবে। যেভাবে আগেরগুলো হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলির দায়ভাগ কেন শুধু নারীকেই সম্ভ্রম হারিয়ে নিতে হবে? অভ্যন্তরীণ কোন্দল, অন্তর্নিহিত বিরোধ, ব্যক্তিগত শত্রুতা, প্রেমে সাড়া না দেয়ার তিক্ততা জীবনভর শুধু নারীকেই একা বয়ে বেড়াতে হবে? গণমানুষের সচেতনতা, মা, স্ত্রী আর কন্যা সন্তানের প্রতিনিধি এই গোষ্ঠীকে অন্তর্নিঃসৃত শ্রদ্ধায়, সম্মানে বরণ করতে না পারলে এমন অন্যায় থেকে নিজেদের দূরে রাখা কঠিন হবে।
×