ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

লোকসঙ্গীত গবেষক সৈয়দা আঁখি হক

প্রকাশিত: ০৬:২১, ১১ জানুয়ারি ২০১৯

 লোকসঙ্গীত গবেষক সৈয়দা আঁখি হক

সৈয়দা আঁখি হক। বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের তরুণ একজন লোক গবেষক। বিশেষ করে সঙ্গীত সংশ্লিস্ট বিষয় নিয়ে গবেষণা করে থাকেন। এ জন্য দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ান চট্টগ্রামের এই সন্তান। তুলে আনেন বাংলাদেশের নানা সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য। গবেষণার ফল হিসেবে এ পর্যন্ত তার বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশের পর প্রশংসিত হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকাতেও নিয়মিত লিখে থাকেন তিনি। গবেষণা এবং লেখালেখির স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বেশ কিছু পুরস্কার। সৈয়দা আঁখি হকের পিতা জন্ম, বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা চট্টগ্রামে। পিতা সৈয়দ শামসুল হক, মাতা আয়েশা হক। জন্মের পর থেকে মায়ের কণ্ঠে হাছন রাজা, রাধারমণ ও শাহ আবদুল করিমের গান শুনেছেন। শুনতে শুনতেই বেড়ে উঠেছেন। ছোট বেলায় গান গাওয়ার সময় আম্মা কাঁদতেন, তখন মাকে নানা প্রশ্ন করতেন। ভাবতেন বড়ো হয়ে তাঁদেরকে প্রশ্ন করবেন ‘কেন এমন গান লিখেছেন, যা শুনে আম্মার চোখে পানি পড়ে?’ তখন থেকেই সেসব গান এবং গানের রচয়িতা সম্পর্কে জানার কৌতূহল জাগে। শিশুকাল থেকেই নাকি ভাবুক প্রকৃতির ছিলেন, কম কথা বলতেন, হাসতেনও খুব কম। পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারায় পঞ্চম শ্রেণি থেকেই লেখালেখি শুরু। প্রথম লেখা ছাপা হয় ‘দৈনিক আজাদী’তে। এরপর দৈনিক পূর্বকোন পত্রিকায়। সেই থেকেই পথ চলা। ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতেন ডাক্তার হবেন। কিন্তু গানের প্রতি প্রচন্ড দুর্বল ছিলেন তাই গানের স্কুলে ভর্তি হোন। তার মতে পারিবারিক টানাপোড়েন, মায়ের অসুস্থতা সব মিলিয়ে গানটা ঠিক সেভাবে গাওয়া হয় নি তার। তবে তিনি মনে করেন গানের বাণীর গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, থাকবে যতদিন তিনি বেঁচে আছেন। আখি জানান প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যপুস্তকের পড়াশোনার চেয়ে বাইরের বইয়ে মন পড়ে থাকতো তার। তার আম্মা প্রচুর বই পড়তেন। সেই বইগুলোতে নতুন কিছু খুঁজে বেড়াতেন। স্কুল-কলেজের বাঁধাধরা নিয়ম ভাল লাগতো না, তবে পাশ করার জন্য যতটুকু প্রয়োজন পড়েছেন। শিশুকালে যাঁদের গানে আকৃষ্ট হয়েছিলেন কৈশোরে তাঁদের সন্ধানে নেমে পড়েন। ছুটে চলছেন আজ অব্ধি। সিলেটের অসংখ্য মরমি সাধক কবির জীবন-কর্ম-দর্শন নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপা হয় প্রায় সবক’টি জাতীয় পত্রিকায়। এরমধ্যে তিনটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। ‘কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে’ জনপ্রিয় এই গানটির রচয়িতা সুফি সাধক আরকুম শাহের জীবনদর্শন নিয়ে এ’টি তার প্রথম বই। সৈয়দা আঁখি হকের বিশ্বাস, তাঁকে জানতে হলে বইটি পড়তে হবে। ২০১৯ বই মেলায় প্রকাশিতব্য গ্রন্থ ‘গল্প গানে শাহ আবদুল করিম’ অক্ষরবৃত্ত পা-ুলিপি পুরস্কার পেয়েছে। বইটি শাহ আবদুল করিম ভক্তের তৃষ্ণা মেটাবে এমনটাই আশা করেন তিনি। সৈয়দা আঁখি হকে প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে ২০১৭ সালে অমর একুশে বইমেলায় প্রথম প্রকাশিত গবেষণা গ্রন্থ-১. ‘আরকুম শাহ : জীবনদর্শন ও গীতিবিশ্ব’, ‘পল্লিগীতির সুধাকণ্ঠ: রুপালি সুরের আল্পনা’, ‘ছোটোদের রকীব শাহ’ (২০১৭ সালে ‘বাবুই শিশুসাহিত্য পান্ডুলিপি পুরস্কার প্রাপ্ত’)। এছাড়া এ বছর বইমেলায় প্রকাশ হতে যাচ্ছে কিশোর উপযোগী গ্রন্থ ‘গল্পে গানে শাহ আবদুল করিম’। নিজের ক্যারিয়ারের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে সৈয়দা আঁখি হকের মন্তব্য হলো স্বপ্ন নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। শিশুকাল থেকেই লোকসাহিত্যের প্রতি প্রচন্ড টান অনুভব করি ভেতর থেকে। তাই আজীবন শেকড়ের সন্ধানে ছুটতে চাই। আমার ত্যাগ, শ্রম ও লেখায় যদি বাংলার লোকসাহিত্যের ভান্ডারে সামান্য কিছু রসদ যুক্ত হয় এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নতুন কিছু জানতে পারে তবেই সকল কষ্ট সার্থক হবে। সৈয়দা আঁখি হক বলেন, ২০০৯ সাল থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বৃহত্তর সিলেটে ঘুরে বেড়াচ্ছি মরমি, সুফি, বৈষ্ণব সাধকদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানতে। এতে আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছি বার বার। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে এভাবে ছুটে চলা আমার জন্য কষ্টের ছিল। আমার মতে-প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক কিংবা ব্যক্তিগত উদ্যোগে যারা এ ধরনের কাজ করছেন তাদের জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যদিও একটি সুযোগ রয়েছে কিন্তু যারা সত্যিকার অর্থে কাজ করতে আগ্রহী বা করছেন তারাই এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তবে প্রতিটি জেলা ভিত্তিক সরকারি কিংবা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোগ নিলে আমাদের লোকসংস্কৃতির ভান্ডার আরও সমৃদ্ধ হবে। লোকজসংস্কৃতি-লোকগান সম্পর্কে জানতে হলে শেকড়ের ঘ্রাণ নিতে হবে। সৈয়দা আঁখি হক আরও বলেন আমরা যতই সমঅধিকার কিংবা আধুনিকতার কথা বলি কিন্তু আমাদের পরিবার, সমাজ এখনও নারীকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারে না। তাই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে নারীর কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। মাঠপর্যায়ের কাজগুলো ধৈর্যসহকারে নারী যেভাবে তুলে আনতে পারে অনেক সময় পুরুষরা তা পারে না। তাই এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে নারীর অবস্থান তৈরি করতে হবে। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া নারী লেখক একেবারে নেই বললেই চলে। এটিও একটি বিরাট সংকট। এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে সর্বপ্রথম নারীর অদম্য ইচ্ছেগুলোকে মূল্যায়ন করে উৎসাহ এবং পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। মানবতায়, শিক্ষা-দীক্ষায় ভালো কর্মের মাঝে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টায় একটি শিক্ষিত জাতি ও একটি সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র উপহার দিতে পারব আমরা।
×