ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্বাধীনতা সংগ্রামে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১১ জানুয়ারি ২০১৯

স্বাধীনতা সংগ্রামে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর উক্তি তাঁর নারী কবিতাটিতে। তিনি লিখেছেন- কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষ্মী নারী। বাঙালী জাতির জীবনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন অনন্য প্রাপ্তি। আর সে স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর পরোক্ষভাবে যদি কেউ স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে, আন্দোলনকে বেগবান করতে, এর মাত্রাকে আপামর জনসাধারণের মাঝে ছড়িয়ে দিতে মোক্ষম ভূমিকা পালন করে থাকেন তিনি আর কেউ নন, জাতির জনকের সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। শেখ মুজিব বঙ্গমাতাকে রেণু বলেই ডাকতেন। বেগম মুজিব ছিলেন শেখ মুজিবের রাজনৈতিক কর্মকা-ের একজন সুচিন্তিত সহযোদ্ধা এবং পরামর্শক। বঙ্গমাতার বিভিন্ন রূপকে এই আলোচনায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়ে পাঠক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছে। বঙ্গমাতার অবদানকে বঙ্গবন্ধু স্বীকার করেছেন এভাবে ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল- বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনী। ‘বেগম মুজিবের অনুপ্রেরণা না পেলে হয়ত বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে এতটা সবিস্তারে জানা সম্ভব হতো না। জনবান্ধব শেখ মুজিবের ন্যায় বেগম মুজিবও রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি ছিলেন সহনশীল ও যত্ন বান। বঙ্গবন্ধুর মতে, তিনি মাদারীপুর বোনের বাড়ি যাচ্ছিলেন দুজন রাজনৈতিক সহকর্মী নিয়ে। শীতের রাত ছিল, চাদর না থাকায় কষ্টের অন্ত ছিল না তাদের। বেগম মুজিব তার নিজের গায়ের চাদর খুলে দিয়েছিলেন কর্মীদের সুরক্ষার জন্য। যোগ্য নেতার সহধর্মিণী হিসেবে বেগম মুজিব ছিলেন অনন্য। মায়ের দেখানো পথেই হাঁটছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রায়শই ফোন করে খোঁজ নেয়ার রীতি তিনি চালু রেখেছেন। কারণ, একটি রাজনৈতিক দলের মূল চাবিকাঠি হচ্ছে তৃণমূলের কর্মীরা। এ প্রসঙ্গে সদ্য প্রয়াত জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের উক্তি উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন, তৃণমূলের কর্মীরা কখনও দলের সঙ্গে বেইমানি করে না, বেইমানি করে নেতারা। আগরতলা মামলা দায়ের করার পর তৎকালীন পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা বেগম ফজিলাতুন নেছাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গ্রেফতারের হুমকি দেয়। লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ বিষয়ে শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব জোরালো আপত্তি জানান এবং এক রকম প্রতিহত করেন। যে দিন প্যারোলে মুক্তির প্রতীক্ষায় আওয়ামী লীগের নেতারা জেলগেটের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন, সেদিনই বিষয়টি অবগত হয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ডেকে পাঠান এবং চিঠি সংবলিত শেখ মুজিবের কাছে পাঠান। এ কাজে মরহুম ওয়াজেদ মিয়াও সহযোগিতা করেন। জেল গেটে শেখ হাসিনাকে দেখে উপস্থিত নেতারা অনেকেই বলেছিলেন- এ কেমন মেয়ে, বাবার মুক্তি চায় না। পরে অবশ্য প্রমাণিত হয়েছিল সেদিন প্যারোলে মুক্তি নিলে কি হতো! কেননা এই মহীয়সী নারী দেশের সার্বিক আন্দোলনের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করে তিনি সকল বিষয় অবহিত করেন। বাঙালীরা ঐক্যবদ্ধ, তাই বেগম মুজিবের দৃঢ় বিশ্বাস আগরতলা ষড়যন্ত্র নামে খ্যাত মামলা প্রত্যাহার করতেই হবে। বঙ্গবন্ধু যেন শক্ত থাকেন সে বিষয়ে তিনি পরামর্শ দেন। বেগম ফজিলাতুন নেছার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বেগবান হয়। প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে বাঙালীর মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হলেন নিঃশর্তে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালীরা তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়ে বরণ করে নেয় লাখো জনতা তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে। মার্চ মাসের শুরুতেই সারা বাংলা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। সবকিছু চলছে আওয়ামী লীগের নির্দেশে মূলত বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি নির্দেশে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করা হয়েছে। ২ মার্চ ছাত্ররা সেই পতাকা উড়িয়ে দিয়েছে, তুলে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাতে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে ভাষণ দেবেন। শেখ হাসিনা সে দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, বাসায় গিজগিজ করছে মানুষ। বেগম মুজিব সবাইকে তাঁদের ঘর থেকে বাইরে যেতে বললেন। ঘরে তখন বঙ্গবন্ধু, বেগম মুজিব আর হাসিনা। তিনি বললেন, তুমি ১০টা মিনিট শুয়ে রেস্ট নাও। শেখ হাসিনার ভাষায়- ‘আমি মাথার কাছে বসা, মা মোড়াটা টেনে নিয়ে আব্বার পায়ের কাছে বসলেন। মা বললেন, মনে রেখ তোমার সামনে লাখো মানুষের বাঁশের লাঠি। এই মানুষগুলোর নিরাপত্তা এবং তারা যেন হতাশ হয়ে ফিরে না যায় সেটা দেখা তোমার কাজ। কাজেই তোমার মনে যা আসবে তাই তুমি বলবা, আর কারও কোন পরামর্শ দরকার নেই। তুমি মানুষের জন্য সারা জীবন কাজ কর, কাজেই কী বলতে হবে তুমি জান। এত কথা, এত পরামর্শ কারও কথা শুনবার তোমার দরকার নেই। এই মানুষগুলোর জন্য তোমার মনে যেটা আসবে, সেটা তুমি বলবা।’ কি অসাধারণ দায়িত্ববোধ এবং দেশপ্রেম ছিল বঙ্গবন্ধুর, ১০৪ ডিগ্রী জ্বর নিয়ে সভামঞ্চে হাজির হয়েছিলেন। এটি এমন এক আবেগিত, তেজোদীপ্ত, মর্মস্পর্শী এবং উদ্বেলিত ভাষণ যেটি বিগত ২৫০০ বছরের মধ্যে যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ে উদ্দীপনা এবং উৎসাহ প্রদানে সর্বোৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত হয়েছে বাস্তবায়ন সাপেক্ষে। ভাষণটির প্রত্যেকটি শব্দ মোক্ষম মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছিল বলেই বাঙালী জাতি অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছিল। জ্যাকব এফ ফিল্ডের we shall fight on the beaches: The speeches that inspired history গ্রন্থে গবেষণার মাধ্যমে বিষয়টির যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছেন। শেখ হাসিনার স্বামী বিশিষ্ট পরমাণুবিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ বইয়ে লিখেছেন, ‘ওই দিন দুপুরে বঙ্গবন্ধু কারও সঙ্গে কোন কথা না বলে গম্ভীরভাবে খাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, এতদিন ধরে যে আলাপ-আলোচনা করলে, তার ফলাফল কী হলো কিছু তো বলছ না। তবে বলে রাখি, তুমি যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সমঝোতা কর, তবে একদিকে ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী সুবিধামতো সময়ে তোমাকে হত্যা করবে, অন্যদিকে এ দেশের জনগণও তোমার ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হবে। এ কথা শুনে বঙ্গবন্ধু রাগান্বিত হয়ে শাশুড়িকে বলেন, আলোচনা এখনও চলছে, এই মুহূর্তে সবকিছু খুলে বলা সম্ভব না। এই পর্যায়ে শাশুড়ি রেগে গিয়ে নিজের খাবারে পানি ঢেলে দ্রুত ওপরতলায় চলে যান। তিনি না খেয়ে সারা দিন শুয়ে থাকলেন, কারও সঙ্গে কথা বললেন না।’ সুতরাং বোঝা যায়, বেগম মুজিবের অন্তর্দৃষ্টিতা এবং গভীরতা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কতটুকু বেগবান করেছিল, শাণিত করেছিল। পরিশেষে কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার সারসংক্ষেপ এভাবে টানা যায়, সাধারণ ছেলে থেকে অসাধারণ ছেলেতে পরিণত হওয়ার পেছনে বেগম মুজিবের অবদান ছিল অবশ্যাম্ভাবী। একজন আটপুরে বাঙালী নারী হয়েও স্বামীকে তিনি সর্বোচ্চ যোগ্য সাহচর্য দিয়েছিলেন। যাঁর কারণে শেখ মুজিব হতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ পেয়েছে আজীবন লালিত স্বাধীনতাকে। বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বেগম মুজিবদের মতো মহীয়সী নারীদের অভাব অনুভূত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বেগম মুজিবের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তাঁদের দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পরিবারের দেখানো পথেই দলের নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় খোঁজখবর নিয়ে দলকে সুসংগঠিত করে স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। বেগম মুজিবের মতো মহীয়সী নারীদের নিয়ে নতুন প্রজন্মের গবেষণা করার প্রয়োজনীয়তা বর্তমান সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর মর্যাদার যৌক্তিক দাবিটি তাহলে আরও যুৎসইভাবে সমগ্র বিশ্বে উপস্থাপন করা সম্ভবপর হবে এবং নারীরা এ মহান নারীর জীবনীকে অনুসরণ করে চলবে।
×