ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গ্রিস দেশের দ্বীপসুন্দরী...

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ১১ জানুয়ারি ২০১৯

  গ্রিস দেশের দ্বীপসুন্দরী...

ভোর থাকতে থাকতেই গ্রিসের রাজধানী এথেন্স থেকে আমাদের প্লেন রওনা হলো সান্তোরিনি দ্বীপের উদ্দেশে। আধ ঘণ্টার উড়ান। নিচে এগিয়েন উপসাগরের নীল জলরাশি। চোখ বুজে ভাবতে চেষ্টা করলাম সাড়ে তিন হাজার বছর আগের একটা দিনকে। এই নীল জলরাশির মধ্যে একটা পাহাড়ের জ্বালামুখ থেকে গলন্ত লাভা এবং ছাই ছিটকে বেরিয়ে আসছে। ভীষণ রেগে গেছেন সেই পাহাড়বাবু। তারপর এক সময় রাগে ফেটে পড়া বলতে যা বোঝায় সত্যি সত্যি সেটাই হলো। পাহাড়বাবু আর রাগ সামলাতে না পেরে ফেটে একেবারে চৌচির হয়ে নিজের গহ্বরের মধ্যে নিজেই হুড়মুড় করে সব কিছু নিয়ে পড়লেন। ধীরে ধীরে এগিয়েন উপসাগর এসে সেই জ্বালামুখের গহ্বরটাকে নিজের কোলে টেনে নিল, নীল জলের মমতার আঁচলে পাহাড়বাবুকে ঢেকে দিয়ে তেনাকে শান্ত করল। পাহাড়বাবুর রাগ উধাও আর সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়বাবু নিজেও উধাও হয়ে গেছেন। শুধু জেগে রইল পাহাড়ের নিচের অংশটা, সমুদ্রের জলের ওপরে ভাঙা ভাঙা একটা নেকলেসের মতো। ভূতত্ত্ববিজ্ঞানে আগ্নেয়গিরির এভাবে নিজের মধ্যে ভেঙে পড়াটা নতুন কিছু নয়। আর ওই ভাঙা ভাঙা নেকলেসের মতো জেগে থাকা পাহাড়ের নিচের অংশটারও ভূতত্ত্ববিজ্ঞানে একটা নাম আছে— সেটা হচ্ছে ‘কালডেরা’। আমার ভাবনার এই কালডেরা নেকলেসের এক দিকের পাড় সমুদ্রপৃষ্ঠের জলরাশির সঙ্গে সমতল। অন্য দিকটা চড়াইভাবে উঠে গেছে হাজার ফুটেরও বেশি উঁচুতে। যেখান থেকে এক পা এগোলেই গড়িয়ে পড়তে হবে হাজার ফুটেরও বেশি নিচের এগিয়েন উপসাগরের নীল জলে। সিট বেল্ট বাঁধার তলবে চিন্তায় ছেদ পড়ল। বুঝলাম, আমরা পৌঁছে গেছি আমার ভাবনার সেই ভেঙে পড়া সুপ্ত আগ্নেয়গিরির কালডেরাতে। সাড়ে তিন হাজার বছর পরে সেই কালডেরার নেকলেস আজ বিশ্বের এক অন্যতম সুন্দরী দ্বীপ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আমরা পৌঁছে গেছি গ্রিসের দ্বীপসুন্দরী সান্তোরিনিতে। এয়ারপোর্টে আলেজান্দ্রো অপেক্ষা করছিল। সে আমাদের পৌঁছে দেবে নেকলেসের সেই হাজার ফুটের বেশি উঁচু পাড় বরাবর একটা বুটিক হোটেলে। চল্লিশ বছরের আলেজান্দ্রোর জন্ম, শিক্ষা, বিবাহ, চাকরিজীবন- সবই এই দ্বীপে। প্রথম সুযোগেই আলেক্সান্দ্রো জানিয়ে দিল, ‘আমাদের সান্তোরিনি কিন্তু গ্রিসের অন্য জায়গার মতো নয়।’ অর্থাৎ, সান্তোরিনির অর্থনৈতিক অবস্থা মূল ভূখণ্ডের গ্রিসের তুলনায় অনেক ভাল। গ্রিস এখন অনেকটা যেন ‘জলসাঘর’-এর জমিদার ছবি বিশ্বাস। ঐতিহ্য আছে, আধুনিক সভ্যতার অনুরণনে সৃষ্টি সাজানো বাগান আছে। অথচ পয়সা নেই ঋণের কিস্তি মেটানোর। গত কুড়ি বছর উস্কোখুস্কোভাবে সংসার চালিয়ে গ্রিস আজ অর্থনৈতিকভাবে ক্লান্ত এবং বিপর্যস্ত। অবশ্য সান্তোরিনির ব্যাপারটা অন্য রকমের। সুন্দরী সান্তোরিনিতে সময় কাটাতে সারা বছরই ভ্রমণ পিয়াসীদের চাঁদের হাট লেগে থাকে। আর তার দৌলতে সান্তোরিনি তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ, সুয়োরানির সচ্ছলতায় সুন্দরী। নেকলেসের মতো দ্বীপের হাজার ফুট উঁচু পাড়ের গা ঘেঁষে চলে গেছে হেঁটে যাওয়ার বাঁধানো এক পথ। দ্বীপ বেশি বড় নয়। কিন্তু তার মধ্যে রয়েছে তিন-চারটি লোকালয়। সবচেয়ে বড় লোকালয় বা শহরের নাম ফিরা। আমাদের বুটিক হোটেল সেই ফিরা শহরে। সেই হেঁটে চলার পথের ধারে। গাড়ি যাবে না সে হোটেল পর্যন্ত। গজগজ করতে করতে বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে আলেক্সান্দ্রোর পেছন পেছন কিছুটা হেঁটে অবশেষে পৌঁছনো গেল হোটেলে। হোটেলের এই সিঁড়িতে রিসেপশন তো অন্য সিঁড়িতে ঘর। ধাপে ধাপে উঠে এসে ঘরে ঢুকে বসলাম। সময় নিয়েছিলাম বোধহয় জানলাটা খোলার। আর জানলাটা খুলতেই সিনেমার মতো একটা ব্যাপার ঘটে গেল! এক মুহূর্তের মধ্যে চলে এলাম রূপকথার এক স্বপ্নরাজ্যে। হাজার-এগারো শ’ ফুট ওপরে আমি দাঁড়িয়ে আছি। চোখের সামনে অনন্ত বিস্তারিত এগিয়েন উপসাগরের নীল জলরাশি যা আমি দেখছি অনেক উপর থেকে। বাঁকা চাঁদের মতো উঁচু দ্বীপ বৃত্তের আকারে ঘুরে গেছে। দ্বীপের পাড়ের তল ধরে সাদা রঙের সব ঘরবাড়ি। মাঝেসাঝে এগিয়েন সাগরের রঙের সঙ্গে রং মিলিয়ে নীল রঙের গম্বুজ। এক একটা দিন আসে যে দিন আর কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, আজ সব কিছু পরে থাক পরের দিনের জন্য। আমারও সে দিন তাই হলো। দরজা খুলে বাইরে এসে বসে পড়লাম সারাটা দিনের জন্য। এক সময় দিন গড়িয়ে সূর্যাস্তের সময় এল। ছোট ভাঙা ভাঙা ঢেউয়ে সমুদ্র তখন হয়ে গেছে সাদা রঙের আর পাহাড়ের রং হয়ে গেছে কালো। চিমটি-কাটা বাস্তবকে অনুভব করে বুঝতে চাইলাম, না, এ স্বপ্ন নয়, এ সত্যি। এ যে গ্রিসের স্বপ্নের দ্বীপ সান্তোরিনি। পরের দিন আলেক্সান্দ্রোই আবার আমাদের ভরসা হলো। সে আমাদের ঘুরিয়ে দেখাবে সারাটা দ্বীপ। গর্বের সঙ্গে সে জানাল সান্তোরিনির সুস্বাদু টমেটোর কথা। জানাল সান্তোরিনির আগ্নেয়গিরির ছাই মেশানো জমিকে কর্ষণ করে নিজেকে গায়ে-গতরে সাজিয়ে নিতে পারা, সান্তোরিনির আঙুর ফলের কথা। আর সেই আঙুর থেকে তৈরি সান্তোরিনির বিশ্ববিখ্যাত মদিরার কথা। সেই বিশ্ববিখ্যাত মদিরার স্বাদ নেয়াও বাদ গেল না মদিরা বানানোর প্ল্যান্টের গেস্টরুমে বসে। এরপরে গেলাম সাড়ে তিন হাজার বছর আগের আর্কটিরি উপনিবেশের ধ্বংসাবশেষ দেখতে। ধ্বংসাবশেষের পুরোটাই ঢেকে দেয়া হয়েছে কাচের চাদোয়া দিয়ে, ঠিক যেন বাড়ির অন্দরমহল। একদিন সারাটা দিন ধরে ছোট ইয়টে চেপে এগিয়েন উপসাগরের নীল জলের ঢেউয়ে ভাসতে ভাললাগল। ভাললাগল ভাসতে ভাসতে সুন্দরী সান্তোরিনিকে নিকট-দূর থেকে দেখতে। ভাললাগল চারপাশের আরও অনেক ছোট ছোট দ্বীপের মাঝ দিয়ে ভেসে বেড়াতে। তারপর একদিন এসে গেল ঘরে ফেরার মুহূর্ত। মন চাইছে না ফিরে যেতে। সকালে আবার কিছুক্ষণ এসে বসলাম আমাদের ঘরের বারান্দাটাতে। হাজার ফুট নিচের নীল জলের দিকে তাকিয়ে ঠিক করে নিলাম, একদিন আবার ফিরে আসব এই স্বপ্নের দেশে। আমাদের হোটেলের নিচে হেঁটে চলা পথটার পাশে হেলান দিয়ে বসার একটা বেঞ্চ আছে। যেখান বসলে এই স্বর্গকে খুব ভালভাবে দেখা যায়। আমি ওই বেঞ্চটাকে আমার মনের কুঠুরিতে জায়গা করে দিয়েছি। একদিন আমি ঠিক ফিরে আসব। বন্ধুদের সঙ্গে ওই বেঞ্চটাতে বসে আড্ডা মারব চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে। মাঝে মাঝে আড়চোখে চেখে নেব এই স্বপ্নের সৌন্দর্যকে, চিমটি-কাটা বাস্তবের পাড়ে দাঁড়িয়ে! সূত্র : আনন্দবাজার
×