ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পৌষ সংক্রান্তি ও সাকরাইন উৎসবের প্রস্তুতি চলছে

নানা রঙের ঘুড়ি নিয়ে তৈরি পুরান ঢাকা

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ১০ জানুয়ারি ২০১৯

নানা রঙের ঘুড়ি নিয়ে তৈরি পুরান ঢাকা

মোরসালিন মিজান ॥ সুতো ছিঁড়ে তুমি গোটালে নাটাই/আমি তো কাঙাল ঘুড়ি,/বৈরী বাতাসে কী আশ্চর্য/একা একা আজও উড়ি...। না, আর একা একা ওড়া নয়। অগণিত রঙিন ঘুড়ি একসঙ্গে আকাশে উড়বে। সময়টা চলে এসেছে। সামনে পৌষ সংক্রান্তি। আগামী রবিবার নানা আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পৌষকে বিদায় জানাবে বাঙালী। পরদিন সোমবার উদ্যাপিত হবে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসব। পৌষের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার একই উৎসবে মাতবে শাখারি বাজার। দুই দিনব্যাপী আনন্দ উৎসবে মূল অনুষঙ্গ হবে ঘুড়ি। প্রায় প্রতিটি বাসার ছাদ থেকে ঘুড়ি উড়ানো হবে। ছেলে বুড়ো সকলেই উড়াবে। হাজার হাজার ঘুড়ি। সাদা-লাল-নীল-হলুদ-বেগুনী আরও কত রং। ভাবতেই মন কেমন নেচে ওঠে! এ কারণে আগেভাগেই শুরু হয়ে গেছে প্রস্তুতি। মনের মতো ঘুড়ির খুঁজে ব্যস্ত সবাই। ইতিহাসটা একটু স্মরণ করা যেতে পারে। যতদূর তথ্যÑ আজ থেকে ২ হাজার ৮০০ বছর পূর্বে চীনে সর্বপ্রথম ঘুড়ি আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তীতে এশিয়ার অন্যান্য দেশেও দেখা যায় ঘুড়ি। ভারত, জাপান কোরিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ঘুড়ি। ঘুড়ি খেলাও কম পুরনো নয়। ১ হাজার ৬০০ বছর পূর্বে ইউরোপে ঘুড়ি খেলার প্রচলন ঘটে বলে জানা যায়। আর বাংলাদেশে ঘুড়ি তো লোক ঐতিহ্যের অংশ। সাকরাইন উৎসবে রাজধানী ঢাকাও ঘুড়ির হয়ে যায়। জানা যায়, মোগল আমলে ঢাকার নবাবরা এ উৎসবের সূচনা করেন। পৌষের শেষ এবং মাঘের শুরুর ক্ষণে খাজনা আদায় শেষে নবাবরা ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব করতেন। সেই ঐতিহ্য মেনে এখন পুরান ঢাকায় ঘুড়ি উৎসবের আয়োজন করা হয়। কিছু ঘুড়ি পাতলা কাগজ দিয়ে তৈরি। কিছু আবার পলিথিন দিয়ে। বাঁশের পাতলা চটি অথবা নারিকেলের শলা দিয়ে কাঠামো তৈরি করা হয়। ঘুড়ির আবার অনেক নাম। এদিন আকাশে উড়তে দেখা যায় পঙ্খীরাজ, চাপালিশ, চোখদ্বার, মালাদ্বার, চশমাদ্বার, কাউঠাদ্বার, চানদ্বার, ইত্যাদি নামের ঘুড়ি। ঘুড়ির মতো বিভিন্ন নাম আছে নাটাইয়ের। বাটিওয়ালা, মুখবান্ধা, মুখছাড়াÑ কত কত নাম! ঘুড়ির ‘লেঞ্জা’ তৈরিতেও সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটানো হয়। ঘুড়ির লেজ বা লেঞ্জা দারুণ ঢেউ তুলে আকাশে ওড়ে বেড়ায়। সেই ঢেউ, যে ঘুড়ি ওড়ায় না, তারও বুকে এসে লাগে! ঘন হয়ে উড়তে থাকা রং-বেরঙের ঘুড়ি আকাশকে শুধু নীল থাকতে দেয় না। স্থির হয়ে থাকতে দেয় না। উৎসবের রঙে সাজায়। বহু দূর থেকে এই দৃশ্য দেখা যায়। পথচারীরা তাই নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটার কথা ভুলে যান। হাঁটেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। কী যে আনন্দ নিয়ে ঘুড়ি দেখেন তারা! হ্যাঁ, শাঁখারীবাজারে ঘুড়ির সবচেয়ে বড় সংগ্রহ। এত বড় যে, দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। অধিকাংশ দোকানে এখন ঘুড়ি বিক্রি হচ্ছে। পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় তরুণ থেকে শুরু করে ছোট ছোট ছেলেরা দল বেঁধে আসছে। ঘুড়ি সুতো আর নাটাই নিয়ে মনের আনন্দে বাড়ি ফিরছে তারা। বুধবার শাঁখারীবাজারে গিয়ে দেখা যায়, উৎসবের আগেই উৎসবের আমেজ। ছোট ছোট দোকানের সামনের অংশে ঘুড়ি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। নানা রং আর ডিজাইনের ঘুড়ি। দূর থেকে দেখতে কী যে ভাল লাগে! দোকানের ভেতরেও ঘুড়ি। স্তূপ করে রাখা হয়েছে। এত ঘুড়ি? কে কিনবে? প্রথমে এমন একটি প্রশ্ন মনে উঁকি দিয়েছিল বৈকি। পরে দেখা গেল, ক্রেতার কোন অভাব নেই। এমনকি কোন দোকানে একটু সময় দাঁড়ানো মুশকিল হয়ে গিয়েছিল। নিশ্চয়ই প্রতিদিন শত শত ঘুড়ি বিক্রি করেন, তাই না? জানতে চাইলে শুধরে দেন এক দোকানি। বলেন, হাজার হাজার। এর পর আর বোঝার বাকি থাকে না, কেন সাকরাইন উৎসবের দিন এত বড় আকাশও ঢেকে যায়! অধিকাংশ ঘুড়ি পাতলা কাগজে বানানো। বাতাসে স্বাচ্ছন্দ্যে ওড়া চাই। জানা যায়, ওড়ার উপযোগী করতেই এমন কাগজ ব্যবহার করা হয়। আর মূল কাঠামোটি বাঁশের চিকন কাঠি দিয়ে তৈরি। একটি কাঠি ধনুকের মতো বাঁকা। এর ঠিক মাঝখানে তীরের মতো আরেকটি কাঠি বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে আকার আকৃতি ও রঙের দিক থেকে একটির সঙ্গে অন্যটির পার্থক্য আছে। একেকটির একেক রকম ডিজাইন। ডিজাইনের সঙ্গে মিল রেখে নামকরণ করা হয়েছে। এই যেমন, একটি ঘুড়ির গায়ে দাবার ঘরের অনুরূপ নক্সা। তাই এর নাম দাবা ঘুড্ডি। অন্যটির গায়ে মাছরাঙা পাখির অবয়ব। নাম তাই মাছরাঙা ঘুড্ডি। মানুষের চোখ, চোখের ভ্রু, গরুর সিংসহ অসংখ্য ফর্ম ব্যবহার করেও ঘুড়ি তৈরি করা হয়েছে। জাতীয় পতাকার মতো দেখতে ঘুড়ি আছে। বডির মতো ঘুড়ির লেজ নিয়ে বিস্তর কাজ করা হয়েছে। একটি ঘুড়ির লেজ দেখতে পুরুষের তা দেয়া গোঁফের মতো। নাম রাখা হয়েছে মোছওয়ালা ঘুড্ডি। আরও মজার মজার নাম আছে। উদাহরণ হতে পারে গোল লেঞ্জা, কলসী লেঞ্জা। বলার অপেক্ষা রাখে না, লেঞ্জা মানে লেজ। ঘুড়ির পাশাপাশি নাটাই এবং সুতোও দেখে বুঝে কিনতে হয়। কারণ সাকরাইনে ঘুড়ি ওড়ানো হয় না শুধু, কাটাকাটি খেলা হয়। এ জন্য সবচেয়ে ভাল সুতো ও নাটাই বেশি টাকা দিয়ে কিনে নিতে দেখা যায় ক্রেতাদের। রাধা মাধব নামের একটি দোকানে কথা হয় বিক্রেতা তুষারের সঙ্গে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এক সময় শাঁখারীবাজারেই ঘুড়ি তৈরি হতো। এখন বাইরের কারিগররা বানান। আমরা তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করি। মূলত নদীর ওই পারের (কেরানীগঞ্জ) কারিগররা এসব ঘুড়ি বানান। কিছু ঘুড়ি তৈরি করেন জুরাইন গে-ারিয়া ও মিরপুরের কারিগররা। এক সপ্তাহ আগে দোকানে ঘুড়ি উঠিয়েছেন বলে জানান তিনি। রিপনের দোকান নামে পরিচিত একটি দোকানে কথা হয় মোঃ সানোয়ারের সঙ্গে। তিনি জানান, আগে লোকে সারা বছরই কম বেশি ঘুড়ি উড়াত। এখন ঘুরি মানেই সাকরাইন। উৎসবের দিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই বিক্রি বাড়ছে বলে জানান তিনি। বিক্রি বেশি হওয়ায় একটি চায়ের দোকান বন্ধ করে সেখানে ঘুড়ি বিক্রি করা হচ্ছে। দোকানি বলরাম জানান, তার ছেলে কৃষ্ণ ঘুড়ি সাকরাইনের দিন পর্যন্ত এখানে ঘুড়ি বিক্রি করবে। সূত্রাপুর থেকে ঘুড়ি কিনতে এসেছিল কিশোর আবদুল্লাহ। সঙ্গে ফুফাত ভাই জিসান। তারা জানালো, বাড়ির ছাদে ১৪ ডিসেম্বর সারাদিন ঘুড়ি উড়াবে তারা। নারিন্দা থেকে সদলবলে এসেছিল রাকিবুল। ঢাকা গবর্নমেন্ট মুসলিম হাই স্কুলের শিক্ষার্থী বলছিল, ঘুড়ি কেনার জন্য বাসার কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে এসেছে। কেন? জানতে চাইলে সে বলে, সময় বেশি নেই। ভাল ঘুড়ি যদি শেষ হয়ে যায়! এদিকে ঘুড়ি ওড়ানো এবং কাটাকাটি খেলা ছাড়াও বিভিন্ন বাসার ছাদে থাকবে সঙ্গীত নৃত্যসহ নানা আয়োজন। পিঠাপুলি হবে। আর সন্ধ্যায় আলোর ফোয়ারা। ফায়ারওয়ার্কস। সব মিলিয়ে দারুণ ব্যাপার। অপেক্ষা করে আছে পুরান ঢাকা।
×