ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নেপালে গৃহযুদ্ধের ক্ষত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ৯ জানুয়ারি ২০১৯

নেপালে গৃহযুদ্ধের ক্ষত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা

নেপালে মাওবাদীদের সঙ্গে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তরা এখনও আইনী প্রতিকার পাননি। ২০০২ সালের নবেম্বর মাসের ঘটনা। দুই সন্তানের পিতা কৃষ্ণা ঘিসিং নেপালের পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা থেকে বাসে করে রাজধানী কাঠমান্ডুতে যাচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল সেখানে গিয়ে কোরিয়া যাওয়ার ভিসার জন্য আবেদন করবেন। তাকে বহনকারী বাসটি যখন দোলখা এলাকার হালহালের এক সেতু পার হচ্ছিল তখন মাও বিদ্রোহীদের পুঁতে রাখা বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। ১৯ দিন কোমায় থাকার পর যখন ঘিসিংয়ের জ্ঞান ফেরে তখন তিনি বুঝতে পারেন তার কোমর থেকে পা পর্যন্ত অবশ হয়ে গেছে। পরবর্তী নয় মাস হাসপাতালে কাটানোর পর তিনি বাড়ি ফেরেন। প্রায় এক বছর পর ২০০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর দেশের অপরপ্রান্তের লোক গয়া প্রসাদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী আটক করে। বারদিয়া এলাকার রাজাপুর থেকে তাকে মাওবাদী কর্মকা-ে যুক্ত থাকায় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়। যদিও চৌধুরী খুবই নিরীহ ছিলেন তারপরও পুলিশ তাকে লোহার পাইপ দিয়ে পেটায় এবং বৈদ্যুতিক তার দিয়ে শক দেয়। অবশেষে তাকে মুক্তি দেয়। নির্যাতনের ফলে চৌধুরীর মেরুদ- ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে কারণে তিনি এখন ক্রনিক পেইন (দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা) আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটেন। কয়েক সপ্তাহ আগে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের প্রথম দিকের এক সকালে চৌধুরী ও ঘিসিং একসঙ্গে বসে চা খাচ্ছিলেন। তারা একটি ছবি প্রদর্শনীতে যোগ দেন। প্রদর্শনীর আয়োজক ছিল কনফ্লিক্ট ভিকটিমস কমন প্ল্যাটফর্ম (সিভিসিপি) নামে একটি মানবাধিকার গ্রুপ। প্রদর্শনীতে চৌধুরী, ঘিসিং ও অপর আরও ১২ জন ক্ষতিগ্রস্তের ছবি প্রদর্শন করে তাদের কাহিনী তুলে ধরা হয়। এছাড়া গৃহযুদ্ধে ক্ষতির শিকার আরও ক’জনের কাহিনী প্রদর্শনীতে স্থান পায়। ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত চলা ওই গৃহযুদ্ধে ১৬ হাজার লোক নিহত, তিন হাজারেরও বেশি লোক নিখোঁজ ও লাখ লাখ লোক আহত হয়। নিরপরাধ লোক মাওবাদী ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর মাঝে ক্ষতির শিকার হয়। ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের ওপর হামলার ঘটনা তুলে ধরে বিচার দাবি করেন। ‘১৪ স্টোরিজ লিভিং মেমোরিজ অব ওয়ার’ নামে দেশব্যাপী ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনীটি চলে। কিছু কৃষক প্রদর্শনীতে ঘিসিং ও চৌধুরীকে ছবি দেখে চিনতে পারে। ঘিসিং বলেন, ‘অনেক সময় মনে হয় আমি এ দেশের নাগরিক নই। কেননা সরকার আমাদের জন্য কিছুই করছে না। যদিও নেপালে অন্তর্বর্তী বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ২০১৪ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার হওয়ার চার বছর পর ট্রুথ এ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন ও পৃথক কমিশন ফর দ্য ইনভেস্টিগেশন অপ এনফোর্স ডিসএ্যাপেয়ার্ড পারসনসসে ৬৫ হাজার অভিযোগ নথিভুক্ত করলেও কোন একটি ঘটনারও পুরো তদন্ত সম্পন্ন হয়নি। ক্ষতিগ্রস্তরা এখনও ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়া রয়েছে রাজনৈতিক চাপ। গৃহযুদ্ধ শেষে মাওবাদীরা মূলধারার রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে। তাদের আশঙ্কা নেতারা বিচারে দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন। জনসাধারণের মধ্যেও আগ্রহের অভাব আছে। কাঠমান্ডু ও অন্যান্য শহরে বাস করা লোকজনের দৈনন্দিন জীবনে বিশাল আকারের গ্রাম্য সংঘাত কখনই প্রভাব ফেলেনি। চৌধুরী ও ঘিসিংয়ের মতো সংঘাতপীড়িত লোকজন ভালবাসা হারিয়ে ফেলেছে অথবা নির্যাতন অথবা লাঞ্ছিত হয়েছে। তাদের এখন চলাফেরা সহজ হয়ে উঠেছে। তারা বলেন, যখন অন্তর্বর্তীকালীন বিচারব্যবস্থা শুরু হয় তখন তারা ভেবেছিলেন কিছু একটা হবে। এটি প্রথম সোভিয়েত ব্লক ও দক্ষিণ আফ্রিকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করলেও কিছুটা মান বজায় রাখে। বর্তমানে এই ব্যবস্থায় প্রায়ই চারটি স্বাধীন স্তম্ভের কথা বলা হয়। যার মধ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সত্য অনুসন্ধানে কমিশনের তদন্ত, গুরুতর অপরাধে আইনী প্রক্রিয়া, অন্তত সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ বিবেচনা করা, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা, ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করার কথা বলা হয়। যার মধ্যে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিচারব্যবস্থা অন্যতম। একই ধরনের অপব্যবহার আবার যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করতে এই সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। ২০০৬ সালে মাওবাদীরা ও সরকারের মধ্যে সর্বাত্মক শান্তি চুক্তি হওয়ার পর অন্তর্বর্তী বিচার শুরুর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। আট বছর পেরিয়ে গেলেও অন্তর্বর্তী বিচারপ্রক্রিয়া উপেক্ষিত থাকে। তারা এখন শান্তি প্রক্রিয়াকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশেষ করে মাওবাদীদের রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীতে পুনর্বাসন করা ও নতুন সংবিধান প্রণয়ন। অন্তর্বর্তী বিচার প্রক্রিয়ায় সামান্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছা রয়েছে। এই কাজটি করা হচ্ছে কারণ মাওবাদী নেতারা, নেপালি কংগ্রেস পার্টি, পুলিশ ও সেনাবাহিনী এতে করে ফেঁসে যেতে পারেন। তারপরও অন্তর্বর্তী বিচার প্রকিয়ায় উভয়পক্ষ থেকে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার। নেপাল ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের সদস্য নয়। যে কারণে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বিচার করা সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও বিষয়টি নিয়ে কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না।
×