ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাটকের যবনিকা ॥ স্বপদে ফিরলেন বিক্রমাসিংহে

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ৯ জানুয়ারি ২০১৯

নাটকের যবনিকা ॥ স্বপদে ফিরলেন বিক্রমাসিংহে

শ্রীলঙ্কায় প্রধানমন্ত্রীর পদে ফিরে এলেন রানিল বিক্রমাসিংহে। গত ১৬ ডিসেম্বর তার এই পদে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে বাহ্যত ট্র্যাজেডি হয়ে উঠতে যাওয়া একটি বাহিনী আনন্দঘন পরিণতি লাভ করল। সেই সঙ্গে দেশটিতে ৭ সপ্তাহ ধরে চলমান রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা গ্রীষ্ণের দমকা হাওয়ার মতই আলোড়ন তুলে আবার মিলিয়ে গেল স্বস্তির ছাপ রেখে। এই সাত সপ্তাহের মধ্যে প্রথমে দুটি বিবদমান সরকার পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় থেকেছে এবং তারপর কোন সরকারই ছিল না। বিক্রমাসিংহে গত অক্টোবরে যেভাবে সহসা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন তেমনিই সহসাই সেই পদে ফিরে এলেন। শ্রীলঙ্কায় গণতন্ত্রই যে শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হলো সেটা এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা নির্বাহী ক্ষমতা সম্প্রসারণের যে বিপজ্জনক উদ্যোগ নিয়েছিলেন অনেক উত্তেজনা ও টানাপোড়েন চলার পর সেই উদ্যোগের রাশ টেনে ধরতে বিচারবিভাগ ও আইনবিভাগ একজোট হয়। পরিণতি এই দাঁড়ায় যে সাবেক লৌহমানব মাদিন্দ্র রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রী পদে উড়ে এসে জুড়ে বসতে ব্যর্থ হয়ে মুখ গোমড়া করে মঞ্চ থেকে বিদায় নেন। রাজাপাশসকে প্রধানমন্ত্রী পদে বসাতে হেনা চেষ্টা নেই যা প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা করেননি। তথাপি শ্রীলঙ্কার জনগণ জানে যে গত কয়েক সপ্তাহে তাদের দেশে যেসব ঘটনা গেছে তা অনেক দীর্ঘ এক নাটকের একটি অংশ মাত্র। ২ কোটি ২০ লাখ লোকের এই দেশটি তিক্ত বিভাজন ক্ষতবিক্ষত, অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত নাজুক এবং জনতুষ্টিবাদের দিকে বিপজ্জনকভাবে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা সম্পন্ন। আগামী দুই বছরের মধ্যে প্রেসিডেন্ট, আইনসভা ও প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা। এ অবস্থায় বর্তমান বিরতিকালটা বেশি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। সদ্যসমাপ্ত নাটকের যবনিকা উঠেছিল ২৬ অক্টোবর যখন প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহের সঙ্গে একত্রে চলার পর হঠাৎ করেই তাকে বরখাস্ত করে বসেন। এ দু’জন বাহ্যত ছিলেন মিত্র। ২০১৫ সালে উদারভাবাপন্ন বিক্রমাসিংহে প্রেসিডেন্ট পদ লাভে সিরিসেনার প্রায়সে সমর্থন দিয়েছিলেন। দু’জনে একত্রে এক ব্যাপকভিত্তিক কোয়ালিশন গঠন করেন যার মধ্য দিয়ে রাজাপাকসের ১০ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। রাজাপাকসের আমলে সেনাবাহিনী সংখ্যালঘু তামিলদের ২৫ বছরের বিদ্রোহ সাফল্যের সঙ্গে দমন করলেও তার সরকার স্বজনপ্রীতি, দমননীতি ও দুর্নীতির দিকে এবং ভারত ও পাশ্চাত্যের মতো ঐতিহ্যগত মিত্রদের তুলনায় চীনের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছিল। সিরিসেনা তার কার্যকালের শুরুতে রাজাপাকসের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছিলেন। আগে তিনি রাজাপাকসের দলে ছিলেন। পরে তা থেকে বেরিয়ে আসেন। প্রেসিডেন্ট হয়ে আসার পর তিনি রাজাপাকসের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে নির্বাহী ক্ষমতা খর্ব করার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী অনুমোদনও করেছিলেন। কিন্তু সময় যত যেতে থাকে ততই তিনি বিক্রমাসিংহের সঙ্গে একত্রে চলতে ক্রমবর্ধমান অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে থাকেন। বিক্রমাসিংহের অনুসৃত নীতিগুলো সিরিসেনার জাতীয়তাবাদী অনুসারীদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। নীতিগুলোর অন্যতম ছিল যুদ্ধপরবর্তী ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং আর্থিক সংস্কার। কিন্তু তারপরও প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা যেভাবে বিক্রমাসিংহকে সরিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদে রাজাপাসকে শপথ গ্রহণ করান তাতে গোটা জাতি স্তম্ভিত হয়ে যান। এ ছাড়াও তিনি পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে এমন কিছু করে বসেন যা কারও পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ তিনি নিজেই প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার সীমা বেঁধে দিতে সাহায্য করলেও এটা ক্রমাগতই স্পষ্ট হয়ে উঠে যে তিনি স্বয়ং সেই সীমা লঙ্ঘন করেছেন। তিনি প্রথমে পার্লামেন্টকে অবকাশে পাঠান এমনটা ধরে নিয়ে যে এ সময় রাজাপাকসে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ইউএনপি সদস্যকে স্বপক্ষে টেনে আনতে পাবেন। কিন্তু যখন পরিষ্কার হয়ে গেল যে বিক্রমাসিংহের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্ট সদস্য রয়ে গেছে তখন প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে আকস্মিক নির্বাচন দিয়ে বসেন। এ ছিল এক গুরুতর নিয়ম লঙ্ঘন কারণ পার্র্লামেন্টের মেয়াদ সাড়ে চার বছর হওয়ার পরই কেবল তিনি এমন পদক্ষেপ নিতে পারেন। এদিকে এক উদ্ভট ব্যবস্থা চলতে থাকে। রাজাপাকসের নিযুক্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ ও ডিক্রি জারি করতে থাকলেও এক জটিল অবস্থা সৃষ্টি হয়। কারণ বিক্রমাসিংহে পদচ্যুত হলেও তাঁর সরকারী বাসভবন ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান। সুপ্রীমকোর্ট পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়ার ওপর স্থগিতাদেশ দেয়। এতে করে বার বার একথা প্রমাণ করার সুযোগ ঘটে যে পার্লামেন্টে বিক্রমাসিংহের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এরপর সুপ্রীমকোর্টের ৭ বিচারপতির সবাই একবাক্যে রায় দেন যে সিরিসেনার পদক্ষেপগুলো অসাংবিধানিক। অপর এক আদালত রাজাপাকসের সরকারকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত ঘোষণা করে এবং একে অবৈধ ঘোষণায় উদ্যত হয়। এ অবস্থায় প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা হাল ছেড়ে দেন। অথচ এর কিছুদিন আগেই তিনি শপথ করে বলেছিলেন যে ২২৫ জন এমপির সবাই চাইলেও তিনি বিক্রমাসিংহকে কখনই প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন না। শ্রীলঙ্কার এই ঘটনাবলী থেকে প্রমাণিক হলো সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো ও সুশীল সমাজ এতই শক্তিশালী যে তারা ন্যায়নীতি বিবর্জিত কোন প্রেসিডেন্ট অথবা ক্যারিশমা সমৃদ্ধ কোন জনতুষ্টিবাদী নেতার যে কোন আঘাত প্রতিহত করতে সক্ষম। চলমান ডেস্ক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×