ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদুল আলম জয়

খেলার মাঠ থেকে সংসদে ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ৯ জানুয়ারি ২০১৯

খেলার মাঠ থেকে সংসদে ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ

আশরাফ উদ্দিন আহম্মেদ চুন্নু, কায়সার হামিদ, জুয়েল রানা, মাসুদ রানা, ইমতিয়াজ আহমেদ নকিব, আরিফ খান জয়, আরমান, আলফাজ বাংলাদেশের সোনালি প্রজন্মের জাদুকরী ফুটবলার। এদের মতোই প্রতিভাবান ফুটবলার ছিলেন কুষ্টিয়ার কুমারখালীর কৃতী সন্তান, তারুণ্যের প্রতীক ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ। একসময় এসব খ্যাতনামা ফুটবলারদের সঙ্গে খেলেছেনও। খেলা চালিয়ে গেলে হয়ত হতে পারতেন দেশসেরা ফুটবলারদের একজন। তবে খেলার মাঠ ছেড়ে মোটেও আপসোস করতে হয়নি ৪২ বছর বয়সী তরুণ জর্জকে। বরং তিনি যা করে চলেছেন তা এককথায় অসাধারণ। মেধাবী জর্জ খেলার ময়দান ছেড়ে ছাত্রজীবন থেকেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। তাঁর পরিবার বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কাজটাও সহজ হয়ে যায়। উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্যে ১৯৯২-৯৩ সেশনে ভর্তি হন উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইন বিভাগে লেখাপড়া করা জর্জ পরবর্তীতে হয়েছেন ব্যারিস্টার। এ জন্য তিনি ২০০৫ সালে লন্ডন গিয়েছিলেন। তবে এবার সদ্য শেষ হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সবকিছু ছাপিয়ে গেছেন। কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসন থেকে আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতাদের টপকে মনোনয়ন পেয়ে চমকে দিয়েছিলেন। এরপর ভোটের লড়াইয়েও বিপুল ব্যবধানে জিতে প্রথমবারের মতো এমপি হয়েছেন গোলাম কিবরিয়া ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে জর্জ পেয়েছেন ২৭৮৮৬৪ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির বর্ষীয়ান নেতা সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমি পাত্তাই পাননি। তিনি পেয়েছেন মাত্র ১২৩১৯ ভোট। এবারের নির্বাচনে কিছুসংখ্যক তরুণ নেতা এমপি হয়েছেন তাদের মধ্যে জর্জ অন্যতম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়ে তরুণ জর্জকে পছন্দ করেন। প্রধানমন্ত্রীর আস্থার প্রতিদানও দিয়েছেন তিনি। এবার ক্রীড়াঙ্গনের সবমিলিয়ে ১৩ জন এমপি হয়েছেন। সবাই কমবেশি পরিচিত হলেও জর্জের খেলোয়াড়ী অধ্যায়টা খুব বেশি মানুষের জানা নেই। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রতিশ্রুতিশীল স্ট্রাইকার। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর চেনাতে থাকেন নিজের জাত। তাক লাগানো পারফরমেন্স প্রদর্শন করে দলভুক্ত হন রাবি দলে। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় দলের অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেন। রাবির পাঠ চুকিয়ে ঢাকা আসার পর জর্জ পেশাদার ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। খেলেন তখন প্রিমিয়ার ডিভিশনে খেলা দুই ক্লাব অগ্রণী ব্যাংক ও বাড্ডা জাগরণী সংসদে। সবমিলিয়ে জর্জের পেশাদার ক্যারিয়ারের মেয়াদকাল ছিল ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৯। ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে জর্জ খেলেন অগ্রণী ব্যাংকের হয়ে। স্ট্রাইকার হিসেবে দেখাতে থাকেন নিজের কারিশমা। ওই সময় জর্জ খেলেছেন তখনকার খ্যাতনামা ফুটবলার জুয়েল রানা, মাসুদ রানা, ইমতিয়াজ আহমেদ নকিব, আরিফ খান জয়দের সঙ্গে। দৃষ্টিনন্দন, আত্মবিশ্বাসী পারফরমেন্স প্রদর্শন করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন সদ্য এমপি হওয়া জর্জ। বাড্ডা জাগরণীতে সবশেষ ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে খেলা জর্জ পরবর্তীতে আইন পেশায় মনোনিবেশ করেন। প্রথমবার মনোনয়ন পেয়ে এমপি হলেও রাজনীতিতে আচমকা আসেননি তিনি। তার পরিবারের রয়েছে গৌরবময় রাজনৈতিক ইতিহাস। এ সূত্র ধরেই তিনি এখন কুষ্টিয়ার কুমারখালী-খোকসার মানুষের কা-ারী। জর্জ কতটা প্রতিশ্রুতিশীল ফুটবলার ছিলেন সেটা বোঝা যায় সাবেক তারকাদের কথায়। সাবেকরা জর্জের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। এই যেমন সাবেক তারকা ফুটবলার কায়সার হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘একজন দক্ষ খেলোয়াড় ছিলেন জর্জ। খেলা চালিয়ে গেলে ভাল একজন ফুটবলার পেত দেশ।’ জর্জকে ভাল মানুষ আখ্যা দিয়ে কায়সার বলেন, ‘নির্বাচনের প্রচারণার সময় আমরা কুষ্টিয়া গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি জর্জের প্রতি মানুষের ভালবাসা। নিঃসন্দেহে অন্য প্রার্থীদের চেয়ে সে ভাল, যোগ্য। যে কারণে তাঁকে এমপি হিসেবে বেছে নিতে দ্বিধা করেনি জনগণ। আমি বিশ্বাস করি, জনগণের বিশ্বাস ও ভালবাসার মর্যাদা সে রাখবে’। টান আর ভালবাসার কারণেই নির্বাচনের আগে প্রচারণার জন্য কুমারখালী গিয়েছিলেন সোনালি অতীত ক্লাবের সাবেক তারকা ফুটবলাররা। সেখানে ২২ ডিসেম্বর প্রীতি ম্যাচ খেলেন আশরাফ উদ্দিন আহম্মেদ চুন্নু, শেখ মোহাম্মদ আসলাম, কায়সার হামিদ, আরমান, আলফাজ, বাবলুরা। শুধু খেলাই নয়, জর্জের পক্ষে সাধারণ মানুষের কাছে ভোটও চান। ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ জর্জ সব শ্রেণীপেশার মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান। তবে খেলাপাগল হওয়ায় এটা নিয়েও কিছু করার ইচ্ছে আছে। একটা সময় বাংলাদেশের যে কোন খেলাধুলার বড় বহর আসতো কুষ্টিয়া থেকে। সময়ের পরিক্রমায় প্রবাহটা বেশ কমেছে। আবারও দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব বাড়বে কুষ্টিয়ার সন্তানদের, এমন প্রত্যাশা জর্জের। জনকণ্ঠকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে সেলিম আলতাফ জর্জ এমপি বলেন, ‘আমি মনেপ্রাণে চাই আবার দেশের ক্রীড়াঙ্গনে কুষ্টিয়ার প্রতিনিধিত্ব বাড়বে। এক্ষেত্রে আমার করণীয় কিছু থাকলে অবশ্যই করব।’ কুষ্টিয়ায় আন্তর্জাতিকমানের স্টেডিয়াম নেই। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে কিনা এমন প্রশ্নে জর্জ বলেন, ‘এটি ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। তবু যদি আমার চেষ্টায় এমন কিছু করা যায় তাহলে পদক্ষেপ নেয়া হবে।’ নিজের এলাকাসহ সবক্ষেত্রে খেলাধুলার উন্নয়নে কাজ করার ইচ্ছার কথাও জানান তিনি। রাজনীতিটা রক্তের সঙ্গেই মিশে আছে জর্জের। এ বিষয়ে তরুণ এই নেতা বলেন, ‘আমার রাজনীতির শুরু জন্ম থেকেই। কেননা আমার পরিবারের সবাই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। জন্ম থেকেই রাজনীতি আমার রক্তে মিশে গেছে।’ এক ডজন প্রবীণ ও মাঠে থাকা তুখোড় নেতাদের টপকে কুষ্টিয়া-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন জর্জ। বয়সে নবীন ও এলাকায় নতুন মুখ হলেও ভোটাররা মুখ ফিরিয়ে নেননি। এক্ষেত্রে তাদের পারিবারিক রাজনীতির গৌরবময় প্রেক্ষাপট বেশ কাজে দিয়েছে। কুমারখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য বঙ্গবন্ধুর সহচর গোলাম কিবরিয়ার নাতি তিনি। তাঁর চাচা আবুল হোসেন ও চাচি সুলতানা তরুণও সংসদ সদস্য ছিলেন। আরেক চাচা সামছুজ্জামান অরুণ কুমারখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান পৌর মেয়র। বাবা প্রয়াত আলতাফ হোসেন কিরণ মুক্তিযোদ্ধা ও স্কুলশিক্ষক ছিলেন। মা মমতাজ বেগম অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। বর্তমানে তিনি কুমারখালী মহিলা পরিষদের সভানেত্রী ও পাবলিক লাইব্রেরীর সাধারণ সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শহীদ গোলাম কিবরিয়া কুষ্টিয়া তথা কুমারখালী-খোকসার অহংকার। তিনি বর্তমান এমপি সেলিম আলতাফ জর্জের দাদা। গোলাম কিবরিয়া কুমারখালী-খোকসা অঞ্চলে ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে এমসিএ নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৩ সালে হন এমপি। এমপি থাকাবস্থায় ঈদের নামাজে আঁততায়ীয় গুলিতে (১৯৭৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর) মৃত্যুবরণ করেন। গোলাম কিবরিয়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। বাংলাদেশের সংবিধানের একজন সিগনেটরি সদস্যও ছিলেন গোলাম কিবরিয়া। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রয়াত আবুল হোসেন তরুণ দুইবার সংসদ সদস্য ও একবার উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আবুল হোসেন তরুণের সহধর্মিণী ও গোলাম কিবরিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ বেগম সুলতানা তরুণও একবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। গোলাম কিবরিয়ার চতুর্থ পুত্র সামছুজ্জামান অরুণ কুমারখালী পৌরসভার মেয়র। তাঁর দ্বিতীয় ছেলে প্রয়াত আলতাফ হোসেন কিরন ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, অভিনয়শিল্পী ও সংগঠক। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় গোলাম কিবরিয়ার যোগ্য নাতি ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ এখন কুমারখালী-খোকসার জননেতা। সবার আশা, জনগণের কল্যাণে কাজ করে দেশ ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়বে জর্জের সুনাম।
×