ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

নীল রাজ্যের কিশোরী ফুটবলারদের সুপ্ত বাসনা...

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ৯ জানুয়ারি ২০১৯

নীল রাজ্যের কিশোরী ফুটবলারদের সুপ্ত বাসনা...

আজ আপনাদের শোনাব একটি ‘নীল-রাজ্য’-এর কিছু মানুষের কাহিনী। রাজধানী ঢাকা থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রায় ৪০০ কিমি দূরে ১৬৪৩.৪০ বর্গ কিমি আয়তন হচ্ছে এই রাজ্যের। এর অবস্থান কর্কটক্রান্তি রেখার সামান্য উত্তরে। এই রাজ্যের পূর্বে রংপুর এবং লালমনিরহাট জেলা। দক্ষিণে রংপুর এবং দিনাজপুর জেলা, পশ্চিমে দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলা এবং পঞ্চগড় জেলা এবং উত্তরে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলা। আজ থেকে দু’শ’ বছরেরও বেশি সময় আগে এ অঞ্চলে নীল চাষের খামার স্থাপন করে ইংরেজ নীলকরেরা। এ অঞ্চলের উর্বর ভূমি নীল চাষের অনুকূল হওয়ায় দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে এই এলাকায় বেশি সংখ্যায় নীলকুঠি ও নীল খামার গড়ে ওঠে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই এই এলাকার দুরাকুটি, ডিমলা, কিশোরগঞ্জ, টেঙ্গনমারী প্রভৃতি স্থানে নীলকুঠি স্থাপিত হয়। সে সময় বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের মধ্যে এই এলাকাতেই বেশি পরিমাণে শস্য উৎপাদিত হতো এখানকার উর্বর মাটির গুণে। আর এ জন্যই নীলকরদের ব্যাপক আগমন ঘটে এই অঞ্চলে। গড়ে ওঠে অসংখ্য নীল খামার। বর্তমান শহরের তিন কিলোমিটার উত্তরে পুরনো রেল স্টেশনের কাছেই ছিল একটি বড় নীলকুঠি। তা ছাড়া বর্তমানে অফিসার্স ক্লাব হিসেবে ব্যবহৃত পুরনো বাড়িটি ছিল একটি নীলকুঠি। ধারণা করা হয়Ñ স্থানীয় কৃষকদের মুখে ‘নীল খামার’ রূপান্তরিত হয় ‘নীল খামারী’তে। আর এই নীলখামারীর অপভ্রংশ হিসেবে উদ্ভব হয় নীলফামারী নামের। এই হচ্ছে ‘নীল-রাজ্য’-এর ইতিকথা। নীলফামারী স্টেডিয়ামের সবকিছুই সুন্দর। বিশেষ করে মাঠটি। এত সুন্দর মাঠ ঢাকাতেও নেই। তবে একটাই ঘাটতিÑ এই স্টেডিয়ামে কোন প্রেসবক্স নেই! নেই ইন্টারনেট সংযোগ। খেলা শুরুর আগে হঠাৎ করেই চোখ পড়ল গ্যালারিতে বসে থাকা সাত কিশোরীর দিকে। তাদের হাতে ভুভুজেলা। একটু পর পরই তা ফুঁ দিয়ে আশপাশের সবার কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে আর খিলখিল করে হাসিতে ভেঙ্গে পড়ছে। প্রত্যেকের পরনে জার্সি। পিঠে লেখা ‘নীলফামারী ফুটবল একাডেমি।’ কৌতূহল হলো কথা বলার। এক্ষেত্রে সহায়তা নিলাম জনকণ্ঠের নীলফামারী প্রতিনিধি তাহমিন হক ববী ভাইয়ের। খেলা দেখার ফাঁকে ফাঁকে মেয়েদের সঙ্গে মিনিট বিশেকের আড্ডায় জানা গেল অনেক কিছুই। সেগুলো নিয়েই আজকের এই নাতিদীর্ঘ ফিচার। নীলফামারী ফুটবল একাডেমির ‘পেপার ওয়ার্ক’ আরম্ভ ২০০৭ সালে। এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ২০১০ সাল থেকে। একাডেমির সভাপতি এবং হেড কোচের দায়িত্বে আছেন ঢাকার ফুটবলের পরিচিত মুখ, রেফারি ভুবন মোহন তরফদার। একাডেমিতে আপাতত আছে ৬০ ছেলে এবং ২০ মেয়ে। নীলফামারী সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে (এর পাশেই একাডেমিটি অবস্থিত) সপ্তাহে ছয়দিন (শুক্রবার বন্ধ) ফুটবলারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ দেন সাবেক ফুটবলার এবং এএফসি ‘বি’ লাইসেন্সধারী কোচ রুমেল ইসলাম। প্রশিক্ষণের সময় গ্রীষ্মকালে বিকেল ৪টা থেকে ৬টা এবং শীতকালে বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত। ফুটবল শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের। সে বিষয়টি বিবেচনা করেই একাডেমি কৃর্তপক্ষ বেশ ইতিবাচক কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। সেগুলো হলো : এই একাডেমিতে কোন ভর্তি ফিস নেয়া হয় না। শিক্ষার্থীদের যাতায়াত ভাড়া এবং খাবার খরচ দেয়া হয়। তবে এগুলো করতে গিয়ে একাডেমিকে প্রায়ই আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এ প্রসঙ্গে একাডেমির সভাপতি ভুবন মোহন তরফদার বলেন, ‘আমি নিজেরা চাঁদা তুলে যথাসম্ভব চেষ্টা করি একাডেমির খেলোয়াড়দের সাহায্য করতে। এ ছাড়া নূর সাহেব (সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, নীলফামারীরর সন্তান) মাঝে মাঝে কিছু সাহায্য করেন। তবে এগুলো যথেষ্ট নয়। আমাদের কোন স্পন্সর নেই। আমাদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হলো ফুটবলের সঙ্কট। কিছুদিন পর বল নষ্ট হয়ে গেলে নতুন-ভালমানের ফুটবল কিনতে হিমশিম খেতে হয়। এটা একটা বড় সমস্যা।’ একাডেমিতে শুরুর দিকে মেয়েদের ভর্তি করাতে ভীষণ বেগ পেতে হয়েছে ভুবনকে, ‘পাড়া-প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজন তো বটেই, এই মেয়েদের অভিভাবকরাই চাইতেন না তাদের মেয়েরা ফুটবল খেলুক। আমরা তাদের বিভিন্নভাবে বোঝাই এবং বর্তমান জাতীয় দলের মেয়েদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড, খেলায় সাফল্য, খ্যাতি অর্জন এবং আর্থিক পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টি তাদের সামনে উদাহরণস্বরূপ হাজির করি। এতে অনেকটাই কাজ হয়েছে।’ এই একাডেমির সাত ফুটবলার হচ্ছে মুন্নি সাহা, হাসনা বানু, মিষ্টি আক্তার, তাপসী রায়, পূর্ণিমা রায়, হাবিবা ইয়াসমিন কুইন এবং উম্মে হাসনাত। মুন্নি গোলরক্ষক। হাসনা সেন্টার ব্যাক। মিষ্টি ফরোয়ার্ড। তাপসী সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার। পূর্ণিমা রাইট ব্যাক। হাবিবা সেন্টার ব্যাক। উম্মে হাসনাত গোলরক্ষক। মুন্নী ২০১৪ সালে এই একাডেমিতে ভর্তি হয়। বাকিরা ২০১২ সালে। সবাই একযোগে জানায়, ‘আমরা বড় মাঠে প্রাকটিস করি ২০ জনের মতো। ছেলেরা আছে ৬০ জনের মতো। তাদের সঙ্গে আমরা মাঝে মধ্যেই প্রস্তুতি ম্যাচ খেলি। তাতে কখনও ছেলেরা জেতে, কখনও আবার আমরা জিতি।’ মেয়েদের কাছ থেকে জানা গেল আরেকটি তথ্যÑ বাড়ি থেকে অনুশীলনে যাতায়াতের সুবিধার্থে সবাইকে একটি করে ‘দুরন্ত’ বাইসাইকেল দিয়েছেন এই এলাকার এমপি এবং সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। বাংলাদেশের জাতীয় নারী ফুটবল দল যেভাবে এগিয়ে চলছে, প্রতিপক্ষ দলগুলোকে গোলবন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে, নীলফামারী ফুটবল একাডেমির এই কিশোরী ফুটবলাররাও স্বপ্ন দেখে একদিন তারা জাতীয় দলের জার্সি পরে খেলবে। কুইনের গল্পটা অবশ্য একটু ভিন্ন। সে ২০১৩ সালে এএফসি অ-১৪ বালিকা আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ খেলার জন্য বাংলাদেশ দলের দলে ডাক পেয়েছিল এবং খেলেছিল (শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ওই আসরে বাংলাদেশ তৃতীয় হয়েছিল। পেয়েছিল ফেয়ার প্লে ট্রফিও)। বাবা পৌরসভার অবসারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তাকে বেশ ভয় পায় কুইন। তার ভয়েই কি না ২০১৬ সালে খেলা ছেড়ে দেয় সে! পরে অবশ্য আবারও ফিরে আসে খেলায়। কিন্তু ততদিনে জাতীয় দলে ঢোকার রাস্তাটা অনেক কঠিন হয়ে গেছে তার জন্য। কুইন এখন আবারও স্বপ্ন দেখছে জাতীয় দলের হয়ে খেলার। নীলফামারীর কোন মেয়ে ২০১৩ সালের পর এখনও জাতীয় দলে খেলেনি। এই ছয় কিশোরী জাতীয় দলে খেলে নীলফামারীর মুখ উজ্জ্বল করতে চায়। এদেরই একজন মুন্নি সাহা। বয়স ১৪। পড়ে সপ্তম শ্রেণীতে। গ্রাম বাবরীঝাড়। পজিশন গোলরক্ষক। প্রিয় গোলরক্ষক মাহমুদা আক্তার। মুন্নির ভাষ্য, ‘আমি সবসময়ই ভাবি, যদি খেলোয়াড় না হতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে ফুটবল-রেফারি হব।’ যদিও শুরুতে ফুটবলের চেয়ে ক্রিকেটই বেশি পছন্দ ছিল মুন্নির। একবার ক্রিকেট খেলতে লালমনিরহাটে গিয়েছিল সে। স্কুলের ধর্ম শিক্ষকের কথা শুনে ক্রিকেট ছেড়ে ফুটবল খেলায় নাম লেখায়। প্রথমবারের মতো খেলে বঙ্গমাতা ফুটবলে। সেটা ২০১৪ সালের কথা। সেবার ঢাকা পর্যন্ত গিয়ে খেলেছিল মুন্নিদের স্কুল (মুন্নি অবশ্য খেলেছিল রংপুরের রাবেয়া স্কুলের হয়ে)। মুন্নির বাবা মোহাম্মদ মোজাম্মেল নেই। না, বেঁচে আছেন ঠিকই। তবে মুন্নিদের সঙ্গে নেই। অন্যায়ভাবে দ্বিতীয় বিয়ে করে সংসার পেতেছেন আরেক জায়গায়। মুন্নিদের ভরণপোষণের জন্য একটি টাকাও দেন না! ফলে মুুন্নির মা-ই তাকে ছোট থেকে অনেক কষ্ট করে লালন-পালন করে আসছেন। তাদের থাকতে হয় মামাবাড়িতে। মুন্নিদের আর্থিক অবস্থাও ভাল নয়। সেলাই কাজ করে মা যা উপার্জন করেন, তা দিয়েই অনেক কষ্টে চলে তাদের সংসার। তাছাড়া প্রায়ই তার মা অসুস্থ থাকেন। ভাগ্যিস, মুন্নির কোন ভাই-বোন নেই। থাকলে অবস্থা যে আরও ভয়াবহ হতো, তাতে কোন সন্দেহ নেই। মুন্নিকে ও মাঝে মাঝে সেলাই কাজে সাহায্য করতে হয় তার মাকে। ‘মামারা অবশ্য মাঝে মাঝে সাহায্য করে। কিন্তু প্রতিদিন তো তারা আমাদের সাহায্য করবে না। কাজেই আমাদেরই তো যা করার করতে হবে।’ শুরুতে ফুটবল খেলতে গিয়ে অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে মুন্নিকে। পাড়া-প্রতিবেশীরা নানা নেতিবাচক-আজেবাজে কথা বলত। কিন্তু তাতে মোটেও দমে যায়নি মুন্নি। তার মা-ও তাকে সমর্থন যুগিয়েছেন। ফলে মুন্নির জন্য ফুটবল খেলাটা সহজ হয়েছে। ফুটবল খেলে অল্প বিস্তর কিছু আয়ও করে মুন্নি। সেটা বিভিন্ন জেলায় ‘খেপ’ খেলে। প্রতি খেলায় হাজারখানেক করে টাকা পায় সে। এই টাকা মায়ের হাতে তুলে দেয় সে। এভাবেই সংসার চালানোর জন্য এই বয়সেই ‘শ্রম’ দিতে শুরু করেছে মুন্নি। তার পরও মাঝেমধ্যেই হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে সে, ‘মাঝেমাঝেই ভাবি চার বছর ধরে ফুটবল খেলে এই জীবনে কি করলাম? কোন স্বপ্নই পূরণ করতে পারলাম না। এমনকি কেউ আমাদের কোন সাহায্যও করল না জাতীয় দলে ট্রায়াল দেয়ার বিষয়ে। আমাদের কোন পরামর্শক নেই, কোন গাইড নেই। আমরা পথ চলছি অন্ধকারের মধ্যে। তাই আমাদের ফুটবল-ভবিষ্যতও অনিশ্চিত। এ জন্য মাঝেমধ্যেই খুব কান্নাও পায়।’ নিজেকে সামলে নিয়ে আরও যোগ করে মুন্নি, ‘অ-১৪, ১৫, ১৬ জাতীয় দলের মেয়েরা যেভাবে চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে এবং প্রধানন্ত্রীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আর্থিক পুরস্কার পাচ্ছে, এগুলো দেখে আমি খুবই আশাবাদী ফুটবলকেই পেশা হিসেবে নিতে। স্বপ্ন দেখি ওদের মতো আমিও জাতীয় দলে খেলছি এবং ভাল খেলে পুরস্কার পাচ্ছি। ভাল রকম টাকা-পয়সা পেলে সংসারের উন্নতির জন্য মাকে সাহায্য করতে পারতাম। আমার নানা স্বপ্ন পূরণ করতে পারতাম। কিন্তু সেই সৌভাগ্য কি আমার হবে? সেই সুযোগ কবে আসবে?’ তবে জাতীয় দলে ঢোকার পথটা খুঁজে পাবার কোন পন্থা জানা নেই এই কিশোরী ফুটবলারের। দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী হাসনা বানু জানায়, ‘আমাদের সমস্যার কথা আমাদের কোচকে জানিয়েছি। উনি আমাদের শুধু ভাল করে অনুশীলন করতে বলেন। আসলে তার সমস্যাও আমরা বুঝি, তিনি অনেক কষ্ট করে একাডেমি চালান। তাকে যদি অন্তত ৫-৬ ধনী কেউ সাহায্য করতো, তাহলে তিনিও আমাদের সাহায্য করতে পারতেন।’ এই প্রসঙ্গে একাডেমির সভাপতি ভুবন জনকণ্ঠকে জানান, ‘আমরা যতদূর পারি এই মেয়েদের সাহায্য করার চেষ্টা করি। হাসনাকে তো আনসার দলে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। সেখানে সে অনাকাক্সিক্ষতভাবে ২০১৬ সালে হাঁটুতে ব্যথা পায়। রিকভারি করতে বেশ সময় নেয়। ফলে আনসার তাকে আর রাখেনি। বর্তমানে একাডেমি দলে যেসব মেয়ে আছে তাদের মধ্যে একমাত্র কুইনেরই জাতীয় বয়সভিত্তিক দলে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। বাকিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আছে, যারা জাতীয় বয়সভিত্তিক দলগুলোতে খেলার মতো যোগ্য। আমরা শীঘ্রই এদের মধ্য থেকে বাছাই করে চার-পাঁচজনকে নিয়ে ঢাকায় যাব এবং বাফুফের অধীনে ট্রায়াল দেয়ার ব্যবস্থা করব। তারপর দেখা যাক কি হয়।’ নীল-রাজ্যের এই কিশোরী ফুটবলারদের জাতীয় দলে খেলার সুপ্ত বাসনা পূরণ হবে কি?
×