ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতারে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান

সুবর্ণচরের পর ঢাকায় তিন শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৯ জানুয়ারি ২০১৯

সুবর্ণচরের পর ঢাকায় তিন শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গৃহবধূ ধর্ষণের রেশ কাটতে না কাটতেই খোদ রাজধানীতে তিন শিশুকে ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যার অভিযোগ ওঠার ঘটনায় রীতিমতো তোলপাড় চলছে। সোমবার রাতে রাজধানীর ডেমরা থেকে উদ্ধার করা হয় দুই শিশুর লাশ। এই দুই শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে নিহতদের পরিবার ও এলাকাবাসীর দাবি। দুই শিশুকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে চিকিৎসকদের দাবি। এ ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত মোস্তফার স্ত্রী ও শ্যালকসহ মোট চার জনকে আটক করেছে পুলিশ। একই রকম দাবি উঠেছে গে-ারিয়া থেকে উদ্ধারকৃত শিশুর লাশ নিয়েও। এই শিশুটিকে ধর্ষণের পর বাড়ির তিনতলা থেকে ফেলে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত নাহিদ ও প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তার সপ্তম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েকে আটক করেছে পুলিশ। যদিও শিশু তিনটি ধর্ষিত হয়েছে কি না এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তা নিশ্চিত করতে পারেননি চিকিৎসকরা। ঘটনা তিনটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্তের পাশাপাশি তিন শিশু হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে বলে পুলিশ বলছে। গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন মধ্যরাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে স্বামী ও সন্তানদের বেঁধে রেখে এক গৃহবধূকে গণধর্ষণের পর তার বাড়িতে ভাংচুর চালানো হয়। ঘটনাটি দেশ-বিদেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করতে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে কড়া নির্দেশ জারি করা হয়েছে। সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নোয়াখালী জেলার পুলিশ সুপার মোঃ ইলিয়াছ শরীফ জনকণ্ঠকে বলেন, ওই ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে ইতোমধ্যেই ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যার মধ্যে সাত জন রিমান্ডে আছে। দুই জন আদালতে ঘটনার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী দিয়েছে। গত রবিবার ওই নারী জেলার ২ নম্বর আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নবমিতা গুহর কাছে ২২ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। জবানবন্দীতে গ্রেফতারকৃত ছাড়াও পলাতক আরও চার জনের নাম প্রকাশ করেছেন। পলাতকদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। এমন ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত শনিবার রাজধানীর গে-ারিয়া থানা এলাকায় ঘটে যায় এক লোমহর্ষক ঘটনা। লোভ দেখিয়ে তিন বছরের শিশু আয়েশাকে গে-ারিয়ার দীননাথ সেন রোডের একটি বাড়িতে নিয়ে যায়। সেখানে ওই শিশুকে ধর্ষণের পর বাড়িটির চতুর্থ তলা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয় বলে নিহতের পরিবার ও এলাকাবাসীর দাবি। যে চার তলা বাড়িটির পাশ থেকে আয়েশার লাশ উদ্ধার হয়েছে, দীননাথ সেন রোডের ৫৩/১/ছ নম্বর সেই চারতলা বাড়িটির পাশেই টিনশেড বস্তিতে পিতামাতা আর তিন বোনের সঙ্গে থাকত আয়েশা। সকালে আয়েশার মা-বাবা কাজে যান। আর আয়েশা শনিবার সাধনা ঔষধালয়ের গলিতে খেলতে যায়। সন্ধ্যার পর ওই বাড়ির পাশ থেকে আয়েশার লাশ উদ্ধার হয়। আয়েশার পরিবার ও এলাকাবাসীর দাবি, শিশুটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। চারতলা বাড়ির চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটের বাসিন্দা নাহিদ (৪৫) শিশুটিকে ধর্ষণ করে বাড়িটির তিনতলা থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। এমন ঘটনায় শনিবার সন্ধ্যা থেকেই বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এলাকাবাসী। রবিবার শিশুটির পিতা ইদ্রিস আলী গে-ারিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। আসামি গ্রেফতারে গড়িমসি করলে সোমবার এলাকাবাসী আসামি গ্রেফতারের দাবিতে গে-ারিয়া থানা ঘেরাও করে। এরই প্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত পুলিশ ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত নাহিদকে গ্রেফতার করে। নাহিদ এক সময় পুরনো ঢাকার ইসলামপুরে ব্যবসা করত। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর নাহিদ দ্বিতীয় বিয়ে করলে তিনিও চলে যান। নিহত আয়েশার মামা মোহাম্মদ আলীর দাবি, শিশুটিকে ধর্ষণের পর ফেলে দিয়ে হত্যা করেছে বাড়ির মালিক নাহিদ। নাহিদ বাড়ির তিন তলায় থাকে। খেলার সময় আয়েশাকে খিচুড়ি খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে নাহিদ ডেকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। এ বিষয়ে গে-ারিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মাহবুব আলম জনকণ্ঠকে বলেন, এ ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত নাহিদ ও তার মেয়েকে আটক করা হয়েছে। তদন্তে আয়েশাকে লোভ দেখিয়ে নাহিদের ডেকে নেয়ার অকাট্য প্রমাণ মিলেছে। নাহিদের সপ্তম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ের দেয়া তথ্য মোতাবেক, ঘটনার সময় সে পাশের রুমে শুয়ে ছিল। এ সময় পাশের রুম থেকে একটি নারী শিশু কণ্ঠে বার বার বলছিল, আমি মার কাছে যাব, আমি মার কাছে যাব। সে ওঠে দেখে রুমটির দরজা বন্ধ। এ সময় সে ডাকাডাকি করে। কিন্তু তার পিতা দরজা খোলেনি। এর কয়েক মিনিট পরেই বাড়ির পাশে কিছু একটা পড়ার শব্দ হয়। চিৎকারে সেখানে ব্যাডমিন্টন খেলতে থাকা যুবকরা দৌড়ে যায়। দেখে একটি শিশু মেয়ে পড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। ঘটনাস্থলেই শিশুটির মৃত্যু হয়েছে। এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে সেও মেয়েটিকে দেখতে যেতে উদ্যত হয়। এ সময় নাহিদ তার মেয়েকে কোথায় যায়, জানতে চায়। সে পিতার কথা অম্যান্য করে পড়ে মারা যাওয়া মেয়েটিকে দেখতে যায়। দেখে, যে মেয়েটি তার পিতার রুমে মায়ের কাছে যাব বলে কান্নাকাটি করছিল, সেই মেয়েটিই পড়ে আছে। মেয়ের জবানবন্দী মোতাবেক নাহিদকে গ্রেফতার করতে গেলে, সে তিন তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু পা ভেঙ্গে যাওয়ায় আর দৌড়াতে পারেনি। তাকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার করা হয়েছে। তার দুইটি পা ভেঙ্গে গেছে। এমন লোমহর্ষক ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত সোমবার রাত নয়টার দিকে ডেমরা থানাধীন কোনাপাড়ার হযরত শাহজালাল রোডের নাসিমা ভিলার নিচতলার একটি কক্ষ থেকে ফারিয়া আক্তার দোলা (৫) ও নুসরাত জাহান (৪) নামে দুই শিশুর লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটে। এমন ঘটনায় পুরো এলাকায় তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। শিশু দুইটি দুপুর থেকেই নিখোঁজ ছিল। নিখোঁজের বিষয়ে এলাকায় মাইকিং করা হয়। শেষ পর্যন্ত লাশ মিলে শিশু দুইটির। নুসরাত জাহানের মা ফাহিমা বেগমসহ পরিবারের সবার দাবি, তার মেয়েকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। নিহত অপর শিশু ফারিয়া আক্তার দোলার চাচা রাশেদুল ইসলামের দাবি, নিখোঁজের বিষয়ে মাইকিং করার সময় স্থানীয়রা জানান, স্থানীয় মোস্তফা নামের একজন দুপুরের পর শিশু দুটিকে ডেকে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে গেছে। এরপর সেই ফ্ল্যাটে যাই। শিশু দুইটিকে পড়ে থাকতে দেখেন। পরে শিশু দুইটির লাশ খাটের নিচ থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। এমন ঘটনায় এলাকায় টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। শত শত মানুষ বিক্ষোভ মিছিল থেকে মোস্তফার ফাঁসি দাবি করেছে। মোস্তফা পেশায় পোশাক শ্রমিক। স্ত্রী ও এক শিশুসন্তানকে নিয়ে ওই ফ্ল্যাটে সাবলেট থাকত। ডেমরা থানার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ সেলিম জনকণ্ঠকে জানান, মোস্তফাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। আর মোস্তফার স্ত্রী ও শ্যালককে আটক করা হয়েছে। শিশু দুইটির লাশ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে। সেখানে তাদের ফরেনসিক পরীক্ষার আলামত সংগ্রহ করা হয়। এ ঘটনায় নিহত নুসরাত জাহানের পিতা পলাশ হাওলাদার বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করছেন। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাঃ মাকসুদুর রহমান জানান, শিশু দুইটিকে শ্বাসরোধে হত্যা করার আলামত মিলেছে। নুসরাত জাহানের কপালে ও নাকের উপরে কালচে আঘাতের চিহ্ন আছে। ফারিয়ার গলার ডানপাশের সামনের দিকে কালচে দাগ আছে। তবে তাদের কান, নাক ও যৌনাঙ্গ স্বাভাবিক আছে। ডেমরা থানার ওসি মোঃ সিদ্দিকুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, এ ঘটনায় ওই বাসার ভাড়াটিয়া এক নারী পোশাক শ্রমিক ও তাদের প্রতিবেশী নুর হোসেন নামে আরও একজনকে আটক করা হয়েছে। একই ঘটনায় দুই শিশু নিহত হওয়ার কারণে নিহতের যে কোন একটি পরিবারের তরফ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হচ্ছে। মামলায় দুই জনকে আসামি করা হচ্ছে। মোস্তফাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
×