ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সৈয়দ আশরাফ ॥ এক আদর্শ সংস্কৃতিবান রাজনীতিবিদ

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ৯ জানুয়ারি ২০১৯

সৈয়দ আশরাফ ॥ এক আদর্শ সংস্কৃতিবান রাজনীতিবিদ

(গতকালের পর) ॥ চার ॥ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সেনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে ভেতরে ভেতরে মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের দল গঠনের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। তিনি দল করবেন না ঘোষণা দিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেন। ফেরদৌস কোরেশী এবং সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ইব্রাহিম প্রমুখ সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট দল গঠনের উদ্যোগে তেমন কোন সাড়া না পাওয়ায় তারাও নিষ্প্রভ হতে থাকেন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে সেনাবাহিনীর অভিযান, শিক্ষক ও ছাত্রদের গ্রেফতার প্রভৃতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং সেনাবাহিনীকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দলগুলোর মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের চেষ্টা চলতে থাকে। লন্ডনে বসে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা আওয়ামী লীগ নেতাদের ঐক্যবদ্ধ রাখতে, শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করেন। সেই সময় শেখ রেহানার সঙ্গে আমারও কথা হয়। তিনি জানান, শীঘ্রই সৈয়দ আশরাফ ঢাকায় ফিরে যাবেন। লন্ডন থাকাকালে সৈয়দ আশরাফের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার একজন প্রধান মাধ্যম ছিলেন এ্যাডভোকেট রেজা আলী, যিনি ২০০৮-এর নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। পর্দার অন্তরালে নানামুখী তৎপরতা চলতে থাকে। সৈয়দ আশরাফ লন্ডন থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন। আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমান দৃঢ়ভাবে দলের হাল ধরেন। জেল থেকে শেখ হাসিনার প্রেরিত নির্দেশনা ও পরামর্শমতো দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়া হয়। সৈয়দ আশরাফ ফিরে আসায় তিনি আবার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সংস্কারবাদীরা হতোদ্যম হয়ে পড়ে। আশরাফ আমার বাসায় বসেই একটি অঘোষিত কোর টিম গঠন করেন। জেলাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ, সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দলগুলোর সঙ্গে লিয়াজোঁ এবং কূটনৈতিক মহলে যোগাযোগের জন্য দায়িত্ব ভাগ করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় যারা এই সকল কাজে যুক্ত থাকবেন তারা প্রকাশ্য মিটিং-মিছিলে আপাতত বেশি যাবেন না। আশরাফ সুনির্দিষ্টভাবে আমাকে বললেন, আপানারা তো গোপন তৎপরতার ওস্তাদ। যে যাই বলুক আপনি নিজেকে এক্সপোসড্ করবেন না। ১/১১-এর এই পর্যায়টিতে আমরা বহুমুখী গোপন তৎপরতা চালিয়েছি। ইতিহাসের সকল সত্য সব সময় প্রকাশ করা যায় না। এমন অনেক কাজ, ঘটনা ও ব্যক্তি থাকেন, যাদের কথা কোনদিনই প্রকাশ করা সম্ভব হবে না। আত্মপ্রচারবিমুখ সৈয়দ আশরাফ এ ব্যাপারে খুবই সতর্ক ছিলেন। এমন অনেক স্পর্শকাতর বিষয় আছে, যা আমরা তৃতীয় কারও কাছেই প্রকাশ করতে পারব না। এটা কোন বাহাদুরি নেয়ার বিষয় নয়। এটাই হলো সত্যনিষ্ঠ রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ॥ পাঁচ ॥ তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষণা করে। যদিও তখন সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষিত হয়নি। তবে নির্বাচনের প্রস্তুতির লক্ষ্যে ঘরোয়া রাজনৈতিক তৎপরতার ওপর পূর্বের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণের জন্য আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহ্বান করা হয়। জিল্লুর রহমানের বাসায় সভাপতিম-লীর বর্ধিতসভা আহ্বান করা হয়। ওয়ার্কিং কমিটিতে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কোন সিদ্ধান্ত সে সভায় নেয়া হয়নি। ইচ্ছে করেই সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে জিল্লুর রহমান ও আশরাফ বিরত থাকেন। এই সভার পর আরও ছোট আকারে জিল্লুর রহমানের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়। সেখানে নেত্রীর পরামর্শ আমাদের জানানো হয়। আমি নেত্রীর ওই পরামর্শের আলোকে একটি লিখিত প্রস্তাব ওয়ার্কিং কমিটিতে উত্থাপনের কথা বলি। আমাকে প্রস্তাবটি লিখতে বলা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ওয়ার্কিং কমিটিতে দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বর্ধিত সভা আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আরও সিদ্ধান্ত হয়, জিল্লুর রহমান জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বা পৃথক পৃথকভাবে কথা বলবেন এবং তাদেরকেও ঐক্য প্রক্রিয়ায় শামিল করবেন। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে ধানম-ি ৩/এ-এর সভানেত্রীর কার্যালয়ে কার্যনির্বাহী সংসদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এক পর্যায়ে আমি লিখিত প্রস্তাব পাঠের অনুমতি চাই। এক প্যারা পাঠের পরই একজন অতিউৎসাহী তৎকালীন মধ্যমস্তরের সংস্কারবাদী নেতা আমাকে বাধা দেন। তিনি আমার এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। প্রস্তাব পাঠ বন্ধ হয়। সভাপতি অন্য কারও কোন প্রস্তাব আছে কিনা জানতে চান। কেউ কোন কথা বলেন না। সৈয়দ আশরাফ সাজেদা আপাকে বলেন, অন্য কারও যেহেতু কোন প্রস্তাব নেই, তাহলে আমরা লেনিন ভাইয়ের প্রস্তাব শুনতে পারি। বাধাদানকারী নেতা বলেন, এটা যদি তার ব্যক্তিগত প্রস্তাব হয় তাহলে তিনি পাঠ করতে পারেন। সভাপতি সাজেদা চৌধুরী আমাকে প্রস্তাব পাঠ করতে বলেন। প্রস্তাবটির ভাষা ব্যক্তিগত ছিল না। ছিল, এই সভা প্রস্তাব গ্রহণ করেছে যে...। ইত্যাদি। প্রস্তাবের মূল কথা ছিল মুক্ত শেখ হাসিনাকে ছাড়া আওয়ামী লীগ কোন নির্বাচনে যাবে না এবং নির্বাচন হতেও দেবে না। প্রকাশ্যে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করার সাহস তখন কারও ছিল না। সমস্বরে কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্যগণ এই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানায়। কার্যনির্বাহী সংসদ বর্ধিত সভার সিদ্ধান্ত এবং তারিখ নির্ধারণ করে। বর্ধিত সভার আগে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে সকল জেলা কার্যালয়ে (তখনও প্রকাশ্য সমাবেশ নিষিদ্ধ) ঘরোয়া সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দ্বিতীয়ত, নির্বাহী সংসদে গৃহীত এই প্রস্তাবটিই বর্ধিত সভায় উত্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। জেলায় জেলায় ঘরোয়া সমাবেশের তারিখ নির্ধারণের দায়িত্ব ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের ওপর অপির্ত হয়। পর্দার অন্তরালে তখন নানা ঘটনা ঘটছে। সব কিছু আমার পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। আশরাফও কিছু বলছেন না। এদিকে জেলায় জেলায় সমাবেশের কোন তারিখ তিনি ঘোষণা করছেন না। ব্যক্তিগতভাবে আমি এ বিষয়ে কথা বলেও কোন সদুত্তর পেলাম না। আমার মনে হলো এই দীর্ঘসূত্রতার ফলে আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আমি সভাপতিম-লীর সদস্যদের উদ্দেশে ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়ার অনুরোধ করে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি লিখি। চিঠি পাঠানোর ২/৩ দিন পর দেখি দৈনিক সমকাল ও জনকণ্ঠ আমার প্রস্তাব ছেপে দিয়েছে। একেবারেই বিব্রতকর পরিস্থিতি। স্বভাবতই আশরাফ আমার ওপর ক্ষুব্ধ হবেন। আমি তার সঙ্গে দেখা করি, আমি যে সংবাদপত্রে ওই প্রস্তাব পাঠাইনি তা জানাই। আশরাফ আমাকে বিশ^াস করেন। তিনি প্রতিবাদলিপি পাঠাতে বলেন। জনকণ্ঠ আমার প্রতিবাদ ছাপায়। পরে বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ড. রাজ্জাক আমাকে জানান, তোফায়েল আহমেদের (তৎকালীন প্রেসিডিয়াম সদস্য) কাছ থেকে তিনি আমার প্রস্তাবের ফটোকপি নেন এবং তিনিই বিষয়টি পত্রিকায় ফাঁস করে দেন। এটা কোন অসৎ উদ্দেশ্যে করা হয়নি। পরবর্তীতে আশরাফ অবশ্য আমাদের জানান, বর্ধিত সভা বিঘ্নিত হতে পারে আশঙ্কা করেই তিনি জিল্লুর রহমানের সঙ্গে কথা বলেন, জেলার সমাবেশ আপাতত না করার চিন্তা করেছেন। এগুলো বর্ধিত সভার পর জেলার সমাবেশ করা হবে। আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভাটি ছিল রাজনীতিতে টার্নিং পয়েন্ট। জেলা থেকে আমন্ত্রিত ছাড়াও বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী বর্ধিত সভায় যোগদান করেন। বর্ধিত সভা বিপুল উদ্দীপনার সঙ্গে মুক্ত শেখ হাসিনা ছাড়া আওয়ামী লীগ কোন নির্বাচনে অংশ নেবে না, হতেও দেবে নাÑ এই ঘোষণা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে। কিছুদিনের মধ্যেই দৃশ্যপট বদলে যায়। শেখ হাসিনাসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পর্যায়ক্রমে মুক্তি পান। শেখ হাসিনা তার কানের চিকিৎসার জন্য অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্র গমন করেন। নির্বাচনের তফসিল ও তারিখ ঘোষিত হয়। প্রকাশ্য রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজ শুরু করে। মাসাধিক পর শেখ হাসিনা চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসেন। ॥ ছয় ॥ ইতোমধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। স্বাভাবিকভাবেই অনেকের ধারণা ছিল আশরাফ আর ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক থাকবেন না। কিন্তু দলের সভানেত্রী সৈয়দ আশরাফকে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব অব্যাহত রাখতে বলেন। ব্যতিক্রমী হলেও সৈয়দ আশরাফ পরবর্তী কাউন্সিল পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দুঃসময়ে বিশ^স্ততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের নজির স্থাপন করায় শেখ হাসিনা নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার লক্ষ্যে সৈয়দ আশরাফকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রেখে দেন। শেখ হাসিনার অসম সাহসী প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব এবং তার সঙ্গে সৈয়দ আশরাফের মতো সৎ, বিশ^স্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বলেই ১/১১-এর সঙ্কট উত্তরণ এবং ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয় লাভ সম্ভব হয়েছে। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের কাউন্সিলে আশরাফ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ॥ সাত ॥ আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে ক’জন আছেন, যে বা যারা রাজনীতির বাইরে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করেন, আড্ডা দেন? আশরাফ লন্ডন গিয়েছিলেন উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে। কিন্তু সেখানে তার শিক্ষা সমাপ্ত হয়নি। দৃশ্যত তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাস। বড় কোন ডিগ্রী তার নেই। অথচ ইংরেজী সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য এবং বিশ^ সাহিত্যে তার অবাধ বিচরণ আমাদের বিস্মিত করেছে। শেক্সপিয়র থেকে গ্যটে, তলস্তয় থেকে রবীন্দ্রনাথ সর্বত্র ছিল তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ। বিশ্ব ইতিহাস, ইউরোপীয় রেনেসাঁ, চিত্রকলা ও স্থাপত্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সব কিছুতেই সমান উৎসাহ ছিল। আমার মতে সৈয়দ আশরাফ ছিলেন আমাদের দেশে বিরলপ্রজ এক সুশিক্ষিত, ধীশক্তিসম্পন্ন, সৎ, নিষ্ঠাবান, মার্জিত রুচির সংস্কৃতিবান রাজনৈতিক নেতা। দোষেগুণে মানুষ ছিলেন তিনি। দলের দৈনন্দিন সাংগঠনিক কাজে তার এক ধরনের নির্লিপ্ততা ছিল। জনারণ্যেও যেন একা থাকতে পছন্দ করতেন। কিন্তু তার দেশপ্রেম, সততা, বিশ^স্ততা এবং শেখ হাসিনার প্রতি তার আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। তিনি প্রায়শ বলতেন, আমার বাবা কোনদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। আমিও শেখ হাসিনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি তা প্রমাণ করেছেন। বিশ^স্ত ও অনুগত ছিলেন; কিন্তু স্তাবক বা আত্মমর্যাদাহীন অন্ধ ভক্তিবাদী ছিলেন না। (সমাপ্ত) লেখক : আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য
×