ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

নতুন মন্ত্রিসভা সম্পর্কে আমার একটি পর্যালোচনা

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ৯ জানুয়ারি ২০১৯

নতুন মন্ত্রিসভা সম্পর্কে আমার একটি পর্যালোচনা

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। এই মন্ত্রিসভাকে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা বললাম এ জন্য যে, এটাতে মহাজোটের কেউ এখন পর্যন্ত নেই। সকল মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীই আওয়ামী লীগের। সুতরাং এই সরকারকে আপাতত আওয়ামী লীগ সরকার বলাই ভালো। পুরনো মন্ত্রীদের মধ্যে ঝানু পার্লামেন্টারিয়ান তোফায়েল আহমেদ ও বাম গণতান্ত্রিক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননসহ ৩৬ জন বাদ পড়েছেন। ১৯ জন প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে ১৫ জনই নতুন। একেবারে নতুন মন্ত্রী নয় জন। এটাকে রদবদল বলা যায় না। বলা যায় ছাঁটাই। শেখ হাসিনার নতুন মন্ত্রিসভায় রদবদল ও নতুন মুখ সংযোজন ভালো ছিল। কিন্তু এত বড় ছাঁটাই ভালো না মন্দ ফল দেবে তা এখন বলা যাবে না। তা বলবে ভবিষ্যত। সে যাই হোক, প্রধানমন্ত্রীসহ এই মন্ত্রিসভার পুরনো ও নতুন সদস্যদের অভিনন্দন জানাই। দেশবাসীর আশা, মন্ত্রিসভায় তরুণ ও নতুন রক্ত সঞ্চালনের ফলে এই সরকারের কর্মদক্ষতা ও গতিবেগ আরও বাড়বে। গত সরকারের ভুল-ভ্রান্তি ঝেড়ে ফেলে তারা দেশের মানুষের আশা আকাক্সক্ষা পূরণে আরও বেশি তৎপরতা দেখাতে পারবেন। নতুন সরকারের কাছে প্রায়োরিটি পাবে দুর্নীতি দমন। এই দুর্নীতি দমন ও দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এই সরকার যুদ্ধকালীন শক্তি ও কর্মোদ্যোগের প্রমাণ দেবে। এই মন্ত্রিসভায় আমার পরিচিতজনের সংখ্যা খুব কম। নতুনদের মধ্যেও তথৈবচ। ৩৬ জনের মধ্যে কয়েকটি পরিচিত ও বন্ধুস্থানীয় মুখ বাদ পড়ায় দুঃখ পেয়েছি। যেমন তোফায়েল আহমেদ, নুরুল ইসলাম নাহিদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, রাশেদ খান মেনন প্রমুখ। মন্ত্রী হিসেবে এদের সাফল্যের তালিকা খুব ছোট নয়। তাছাড়া অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবেও দেশ-বিদেশে এদের পরিচিতি আছে। এদের কর্মক্ষমতা অটুট, এখনও বুড়ো হয়ে যাননি। শেখ হাসিনা এদের কর্মক্ষমতা ও অভিজ্ঞতাকে তার সরকারের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কাজেও লাগাতে পারতেন। অবশ্য মন্ত্রিসভা গঠনের কাজ এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। এমনও হতে পারে সময় ও পরিস্থিতির চাপে অদূর ভবিষ্যতে এই প্রবীণ সাবেক মন্ত্রীদের কারো কারো মন্ত্রিসভায় ডাক পড়তে পারে। শেখ হাসিনার গত সরকার গঠনের সময়ও এমনটা হতে দেখা গেছে। তবে এই সরকারে ড. আবদুর রাজ্জাকের প্রত্যাবর্তন এবং আবদুল মোমেনের মতো একেবারেই নতুন মুখের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যোগদান আমাকে উল্লসিত করেছে। আমার চাইতে দু’জনেই বয়সে ছোট, কিন্তু দীর্ঘকালের বন্ধু। আবদুর রাজ্জাক কৃষি দফতরের দায়িত্ব পাওয়ার সবচাইতে উপযুক্ত লোক। আবদুল মোমেন যদিও মন্ত্রী হিসেবে সম্পূর্ণ নতুন মুখ, কিন্তু বেশ কিছুকাল নিউইয়র্কে বাংলাদেশ মিশনের প্রধানের পদে থাকায় বিদেশ নীতি ও কূটনীতি সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা প্রচুর। পশ্চিমা দেশগুলোর শীর্ষ কূটনীতিকদের সঙ্গে তার পরিচয় ও যোগাযোগও খুবই ঘনিষ্ঠ। তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদের দায়িত্ব দিয়ে শেখ হাসিনা দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে সাফল্য অনেক। কিন্তু দ্রুত পরিববর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের আরও গতিশীলতা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আবদুল মোমেন বড় ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস। তার সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত ভাইয়ের ছোট ভাই এবং তার নিজস্ব পরিচয়েও তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছেন। তিনি যখন আমেরিকার বোস্টন শহরে অধ্যাপনা করেন, তখন একবার চারশ’ মাইল দূরে নিউইয়র্কে এসে গাড়ি ড্রাইভ করে আমাকে বোস্টনে তার বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। বোস্টনে সাতদিন তার সঙ্গে ছিলাম। প্রেসিডেন্ট কেনেডি যে বাড়িতে জন্ম নিয়েছেন, সেই বাড়িতে ঢুকেছি। কেনেডি যে ছোট ডিঙ্গার মতো বোটে নৌবিহার করতেন তাতে চড়েছি। বছর দুই আগে আবদুল মোমেন যখন নিউইয়র্কে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান কর্মকর্তা তখন তার আমন্ত্রণে আমেরিকায় যাই। সঙ্গে আমার মেয়ে বিনীতা। তার বাসাতেই আতিথ্য গ্রহণ করি। দেখলাম তিনি শুধু একজন সফল কূটনীতিক নন, একজন সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্বও। তার বাড়িতে নিউইয়র্কের বাঙালী শিল্পী-সাহিত্যিকদের নিয়মিত আনাগোনা। তিনি মিশনে একটি সম্মেলন কক্ষ নির্দিষ্ট করে রেখেছেন সাংস্কৃতিক বৈঠক করার জন্য। নিউইয়র্কের বাঙালী মহলে তিনি একজন অজাতশত্রু মানুষ। তাকে নিয়ে আমার জীবনে একটি কাকতালীয় ঘটনা ঘটেছে। নিউইয়র্কে তার বাসভবনে থাকার সময়েই তার কূটনৈতিক পদের চাকরির টার্মিনেশনের নোটিস আসে। তিনি চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে ছিলেন। সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। সেই মেয়াদ বাড়বে আশা ছিল। তা বাড়ানো হয়নি। মোমেন তাতে মনোক্ষুণ্ণ হননি। বললেন, ‘অধ্যাপনা করতাম। আবার তাতে ফিরে যাব।’ আমি বলেছি, শেখ হাসিনাকে যতটা জানি, তিনি গুণী মানুষকে সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে জানেন। নিচু থেকে টেনে ওপরে তুলতেও জানেন। এখানকার চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ায় আপনি দেশে ফিরে যাচ্ছেন। দেশের মাটির রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য হাসিনা আপনাকে সুযোগ দিচ্ছেন, যাতে আগামী নির্বাচনে আপনি এমপি হতে পারেন। আপনাকে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে বসাবেন। ‘ঝড়ে কাক মরে, ফকিরের কেরামতি ফলে।’ আবদুল মোমেন এমপি হয়েছেন এবং এক্ষণে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েই আমাকে টেলিফোন করেছেন। মন্ত্রী হওয়ার পর তার কাছ থেকে সম্ভবত আরেকটি ধন্যবাদ পাব, যদিও এই ব্যাপারে আমার কোন কৃতিত্ব নেই। অর্থমন্ত্রী পদে আহম মুস্তফা কামালের (লোটাস কামাল) নিয়োগ আমার কাছে একটি সারপ্রাইজ, আমার ধারণা ছিল, সফল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বয়সাধিক্যে নির্বাচন ও মন্ত্রী পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর দরুন হয়তো ফরাসউদ্দীন অথবা আতিউর রহমান টেকনোক্র্যাট কোটায় এই পদে নিযুক্তি পাবেন। আমার ধারণা সত্য হয়নি। তাতে বিস্মিত হয়েছি, কিন্তু আশাহত হইনি। লোটাস কামাল এই পদের জন্য যোগ্য ব্যক্তি। অর্থমন্ত্রী হিসেবে মুহিত ভাই বারোটি বাজেট পেশ করেছেন এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে গতি সৃষ্টি করেছেন লোটাস কামাল তা শুধু ধরে রাখা নয়, আরও গতি সৃষ্টি করতে পারবেন বলে অনেকেরই বিশ্বাস। তার সুবিধা, তিনি একজন জনপ্রতিনিধিও। একজন ব্যুরোক্র্যাট অর্থমন্ত্রীর চাইতে জনগণের অর্থনৈতিক চাহিদা তার আরও বেশি জানা ও বোঝার কথা। আবদুল মোমেনের মতো তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আছে সে কথা বলব না, কিন্তু ভালো জানা শোনা আছে। অপ্রাসঙ্গিক হলেও সেকথাও এখানে লিখছি। তিনি লন্ডনে এলে একাধিকবার আমার বাসায় এসেছেন। তার সঙ্গে আলোচনায় লেখার অনেক খোরাক পেয়েছি। আমার হাঁটুতে আর্থারাইটিসের প্রচ- ব্যথা, দেশে ফিরে গিয়ে তিনি হার্বাল মেডিসিন পাঠিয়েছেন। এর আগে তার সঙ্গে যখন আমার পরিচয় ছিল না, তখন আমি বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে ‘পলাশী থেকে ধানম-ি’ ছবিটি নির্মাণে ব্যস্ত। আমার নিজের টাকা এবং বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে ডোনেশন নিয়ে ছবিটা করেছি। শূটিংয়ের শেষ পর্যায়ে দুই হাজার পাউন্ড ঘাটতি পড়ে যায়। একথা জেনে লোটাস কামাল সঙ্গে সঙ্গে আমাকে দুই হাজার পাউন্ড পাঠিয়ে দেন। তার প্রতি আমার একটা ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা বোধও রয়েছে। গত মন্ত্রিসভাতেও মন্ত্রী হিসেবে তার কৃতিত্ব ও সাফল্যের কথা আমি জানি। তাই অর্থমন্ত্রী পদে তাকে আমার অভিনন্দন। আমার ভাইজি ড. দীপু মনি এবং বন্ধু ড. আবদুর রাজ্জাক এবারের মন্ত্রিসভায় ফিরে আসায় আমি খুশি। এবারের মন্ত্রিসভায় আমার অনুজ প্রতিম ওবায়দুল কাদের, যার নাম দিয়েছি ‘মওদুদ বিজয়ী বীর’, সড়ক পরিবহন ও সেতু দফতরের মন্ত্রী পদে থেকে যাওয়ায় মন্ত্রিসভায় অনেক পুরনো সদস্যকে হারানোর ব্যথা ভুলেছি। এই মন্ত্রিসভার বৈশিষ্ট্য প্রবীণেরা বিদায় নিয়েছেন। নবীনেরা এসেছেন। মন্ত্রিসভায় তারুণ্যের প্রভা বেড়েছে। এই সরকারের জন্য ভবিষ্যতের আরও বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই তারুণ্যের প্রভা ও শক্তি দরকার। সবার উপরে শেখ হাসিনাতো নৌকার হাল ধরেই আছেন। এই মন্ত্রিসভার আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্যÑ এই সরকারে শেখ হাসিনার পরিবারের ঘনিষ্ঠ কেউ নেই। আমার ধারণা ছিল, ব্যারিস্টার তাপস প্রতিমন্ত্রী হিসেবে হলেও এই মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। ভবিষ্যতে দলের অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান ও মন্ত্রী হিসেবে এদের ট্রেনিং দরকার। এজন্য আমি বিকল্পধারার মাহী বি চৌধুরীকেও (বিকল্পধারা মহাজোটে থাকলে) মন্ত্রিসভায় যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। অবশ্য শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী। তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ত্রিশ বছরের বেশি সময়ের। তিনি যা ভালো মনে করেন, তাই করেছেন। প্রার্থনা করি, এই সরকার দেশ গঠন ও তার উন্নয়নে আগের সরকারের চাইতেও বেশি সাফল্য অর্জন করুক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন আবার ঘরে ফিরে আনুক। [লন্ডন, ৮ জানুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০১৯।]
×