ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

৮৭ হাজার গ্রামকে উন্নয়নের মূল ধারায় আনার লক্ষ্যেই এ বাজেট

সোয়া পাঁচ লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ৮ জানুয়ারি ২০১৯

সোয়া পাঁচ লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি

এম শাহজাহান ॥ দেশের ৮৭ হাজার গ্রামকে উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে আগামী বাজেট প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রতিটি গ্রামের প্রতিটি রাস্তা পাকাকরণ, আধুনিকায়ন পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদন ও ঘরে ঘরে বিদ্যুত ও ইন্টারনেট সংযোগসহ পনেরোটি বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। টানা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত সরকার তবে নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ কর্মসূচী সামনে রেখে নতুন বাজেট তৈরির কাজ শুরু করেছে। গত দশ বছরের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে ২০১৯-২০ সালের অর্থবছরের বাজেটের আকার বাড়ানো হবে। এ জন্য সোয়া ৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হবে দশ মেগা প্রকল্প ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দশ উদ্যোগ বাস্তবায়নে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আগামী বাজেট প্রণয়ন হচ্ছে। এছাড়া বাজেট প্রণয়নে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে দুই বছরের মধ্যে রূপকল্প-২১ বাস্তবায়নে। এ সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য সম্পূর্ণ দূর করে স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী পালন করবে সরকার। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারী বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। রূপকল্প-২১ এর মতো ’৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন, ’৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা এবং সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সুদীর্ঘ এক শ’ বছরের ডেল্টা প্ল্যান (বদ্বীপ) পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া আমার গ্রাম আমার শহর কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গ্রাম উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে। এজন্য কাঁচা রাস্তা পাকাকরণ, গ্রামের সব স্কুল কলেজ আধুনিকায়ন ও শিক্ষার মানোন্নয়ন, কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার, কৃষিভর্তুকি বাড়ানো ও উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা, ব্যাংকের শাখা গ্রামে বাধ্যতামূলক চালুকরণ, সহজশর্তে ব্যাংক হিসাব খোলা ও ঋণপ্রাপ্তি, ঘরে ঘরে বিদ্যুত সংযোগ, স্বল্প খরচে ডিশ ও ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান, এলপি গ্যাস সহজলভ্য করা, ভূমিহীনকে খাসজমি বরাদ্দ, গৃহহীনকে ঘর প্রদান, আধুনিক বাজার ব্যবস্থা চালু, সামাজিক সুরক্ষার আওতা বাড়িয়ে দারিদ্র্য সম্পূর্ণরূপে দূরীকরণ এবং ‘লাঙ্গল যার জমি তার, জাল যার জলা তার’ নীতি চালুকরণের উদ্যোগ নেয়া হবে। এছাড়া পর্যায়ক্রমে পয়ঃনিষ্কাশন ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে প্রতিটি গ্রামে। এ প্রসঙ্গে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জনকণ্ঠকে বলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার আগামী পাঁচ বছরের উন্নয়নে অসাধ্য সাধন করবে। উন্নয়নে সরকারের ধারাবাহিকতা থাকা একটি বড় বিষয়। গত দশ বছরে যেসব প্রকল্প ও কর্মসূচী নেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগই চলমান রয়েছে। ধারাবাহিকতা বজায় থাকায় চলমান প্রকল্পের কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরকার এখন দ্রুত শেষ করতে পারবে। তিনি বলেন, দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থান ও রফতানি আয় বাড়াতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে ও ওয়ানস্টপ সার্ভিস কার্যকরে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার তৃতীয়বারের মতো দেশ সেবার সুযোগ পাওয়ায় সবকিছুর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার বড় সুযোগ তৈরি হলো। তিনি বলেন, গত দশবছরেও ধারাবাহিক বাজেট দেয়া হয়েছে। প্রতিটি বাজেটই পূর্ববর্তী বাজেটের সঙ্গে সমন্বয় রেখে করা হয়েছে। ফলে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এদিকে, গত দশ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের দেয়া প্রতিটি বাজেটই আকারের দিক থেকে একটি অপরটিকে ছাড়িয়ে গেছে। জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী সরকারের জন্য যে বাজেট প্রাক্কলন করা হয়েছে তা-ও ইতিহাস সৃষ্টিকারী। সম্প্রতি সাবেক অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিতের সভাপতিত্বে বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির এক বৈঠকে আগামী অর্থবছরের বাজেটের একটি রূপরেখা প্রাক্কলন করা হয়েছে। এতে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক বাজেটের আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। যা এ অর্থবছরের বাজেটের চেয়ে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা বা সাড়ে ১৩ শতাংশ বেশি। এ অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা রয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বা এডিপির আকার প্রস্তাব করা হয়েছে এক লাখ ৯৮ হাজার ৪০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এখাতে ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহারের ঘোষণা বাজেটে অগ্রাধিকার ॥ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার সামনে রেখে বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান জনকণ্ঠকে গত বলেন, দশবছরের ধারাবাহিকতায় এবারও বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাজেট প্রণয়নে ইশতেহারের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার কর্মসূচী হিসেবে রাখা হবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। গ্রামের অবকাঠামো আধুনিকায়ন হলে জনসাধারণ শহরমুখী না হয়ে গ্রামেই বসবাস করতে উৎসাহী হবে। এজন্য আগামী বাজেটে গ্রাম উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি কর্মসূচী থাকবে। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ‘আমার গ্রাম আমার শহর উন্নয়ন’ দর্শন দেয়া হয়েছে। এই দর্শন বাস্তবায়নের মাধ্যমে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকীকরণের ব্যবস্থা, কুটিরশিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর করা সম্ভব। এর ফলে দেশের ৮৭ হাজার গ্রামে শহরের মতো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ একটি উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দর্শন। এর ফলে কাঁচা রাস্তা পাকা হবে, থাকবে বিদ্যুত ও ইন্টারনেট সুবিধা। এ দর্শনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি। তিনি বলেন, শহরের মতো গ্রামের মানুষ সব ধরনের নাগরিক সুবিধা পাবেন। তিনি বলেন, এটি একটি প্রশংসীয় ও ভাল উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, এদেশের ৮৭ হাজার ৩১৯ গ্রামে প্রায় সোয়া ৩ কোটি পরিবারের ৮০ শতাংশ মানুষ বসবাস করে। গ্রামেই প্রায় ১৩ কোটি মানুষের ঠিকানা। এ কারণে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। নিজস্ব অর্থে বাজেট প্রণয়নে তাগিদ ॥ বিদেশী ঋণ ও অনুদান নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্ব অর্থে বাজেট প্রণয়নে জোর দিচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার। এজন্য সরকারের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। এছাড়া কর রাজস্ব বাড়াতে ব্যাপক সংস্কার আনা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে নতুন বিশেষায়িত ইউনিট গঠনসহ চার খাতে সংস্কার আনা হতে পারে। এ প্রসঙ্গে পরামর্শ চেয়ে সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়ন সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে একটি সার-সংক্ষেপে বেশকিছু প্রস্তাব দিয়েছেন। ইতোমধ্যে প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে অনুমোদন দিয়েছেন মুহিত। এছাড়া সরকারের আয় বাড়াতে এনবিআর ২০২২-২৩ সালে নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা এক কোটিতে উন্নীত করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে। কর জিডিপি’র অনুপাত মধ্য মেয়াদে ১৬ শতাংশে ও দীর্ঘ মেয়াদে ২০ শতাংশ উন্নীত করা হবে। একই সঙ্গে আগামী বছরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে ২০ শতাংশ বা তারও বেশি হারে প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা সম্ভব হবে।
×