ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

১০ দিনেই চালকল মালিকদের পকেটে ঢুকেছে কয়েক শ’ কোটি টাকা

কৃত্রিম সঙ্কটে বাড়ছে চালের দাম

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৮ জানুয়ারি ২০১৯

কৃত্রিম সঙ্কটে বাড়ছে চালের দাম

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ সদ্য শেষ হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের আশায় সিন্ডিকেটের করসাজিতে চালের দাম বাড়িয়েছে চালকল মালিকরা। নির্বাচনের তিনদিন আগে ২৭ ডিসম্বের থেকেই মিলাররা বাজারে চালের সরবরাহ কমিয়ে দেয়। এর পেছনে খুচরা বিক্রেতাদের তারা ‘ছুটিতে কর্মচারী’ ও ‘পরিবহন বন্ধের’ অজুহাত দেখিয়েছিল। তবে, চালকল মালিকরা এখনও বাজারে সরবরাহ বাড়ায়নি। এমন পরিস্থিতিতে খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, ‘মিলাররা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চালের দাম বাড়িয়েছে। ভেবেছিল দেশে বড় ধরনের কোন বিশৃঙ্খলা হবে। দুই দলের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাড়তি মুনাফার উদ্দেশ্য ছিল তাদের। পুরোটা সম্ভব না হলেও মাত্র ১০ দিনেই চালকল মালিকদের পকেটে ঢুকেছে কয়েক শ’ কোটি টাকা।’ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মিনিকেট চালের দাম বেড়েছে কেজিতে সর্বোচ্চ ৫ টাকা। বর্তমানে ৫২ থেকে ৫৫ টাকায় মিনেকেট বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও এ জাতীয় চাল মিলেছে ৫০ টাকায়। আটাশ চালের দামও ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৫ টাকায়। আর বস্তা প্রতি সাধারণ চালের দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ২৫০ টাকা। তবে, বাজারে নাজির জাতীয় চালের দাম স্থির আছে। আর পোলাও চালের দাম বেড়েছে বস্তাতে ৫০০ টাকা। সদ্য শেষ হওয়া আমন মৌসুমে ধানের ফলন ভাল হয়েছে। মৌসুমটিতে চালের উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৫৪ লাখ ৫৯৪ হাজার মেট্রিক টন। ৫৩ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে থেকে এ পরিমাণ চাল পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। আর আগে আউশ ও বোরোর ফলনও ভাল হয়েছিল। বর্তমানে চলছে বোরো ধানের বীজতলা তৈরির কাজ। এদিকে, দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা মনে ধান বিক্রি হচ্ছে। ফল, বাজারে ধান ও চালের প্রচুর সরবরাহ রয়েছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। মন্তব্য জানতে চাইলে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এ সময়ে চালের দাম বাড়ার কোন যৌক্তিকতা নেই। চালের দাম বাড়ার পেছনে আমি সিন্ডিকেট ছাড়া অন্য কিছু দেখছি না। চালকলে আগে যারা মালিক ছিলেন, এখনও তারাই আছেন। ফলে দাম বাড়ার কারণটি তারাই ভাল বলতে পারবে।’ বাংলাদেশ অটো মেজর এ্যান্ড হাসকিং মিল ওনার্ন এ্যাসোসিয়শনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী বলেন, ‘মিলগুলোতে কর্মচারীরা নির্বাচনের ছুটিতে থাকায় চালের সরবরাহ কিছুটা কমেছে। তবে চালের দাম তেমন বাড়েনি।’ বাজারে মিনিকেটের দাম সর্বোচ্চ ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে জানালে লায়েক আরও বলেন, ‘মিনিকেট নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। এটা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে এ চালের দাম কিছুটা কম থাকলেও দিন যত বাড়তে থাকবে এ জাতীয় চালের দামও বাড়তে থাকবে।’ কাওরান বাজারের কিচেন মার্কেটের হাজী ইসমাইল এ্যান্ড সন্সের মালিক মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মিলাররা চালের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে তারা বলছিল নির্বাচন তাই এখন বেচাকেনা বন্ধ, পরে বেচবো। নির্বাচনকে ইস্যু করে ২৭ ডিসেম্বর থেকে মিলাররা গড়িমসি শুরু করেছে। নির্বাচনের পরে এখনও মিলাররা রেট দিচ্ছে না। বলছে, টাকা পাঠিয়ে দেন। যখন চাল সরবরাহ করা হবে তখন চালের দাম নির্ধারণ করা হবে।’ জসিম আরও বলেন, ‘মিলাররা আরও বলছে ধান পাচ্ছে না। এ কারণে দাম বাড়ছে। কিন্তু বৈশাখী ধান আসতে আরও ৪ মাস। তার মানে কী এই চার মাস মানুষ না খেয়ে থাকবে?’ কিচেন মার্কেটের চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মোঃ লোকমান বলেন, ‘নির্বাচনের চারদিন আগে থেকে মিলাররা চাল সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। তারা বলেছে ভোটকে সামনে রেখে সবাই ছুটিতে ছিল। নির্বাচনের আগে চালের ডেলিভারি দিতে পারেনি। তবে এখনও তারা সরবরাহ বাড়ায়নি। বরং নানা অজুহাত দিচ্ছে।’ একই ধরনের কথা বলেন লাকসাম ট্রেডার্সের কর্মচারী মোঃ মোশাররফ। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে দেখে গেছি চালের দাম ঠিকই আছে। এসে দেখি সব ধরনের চালের দাম বেড়ে গেছে। গাড়ি বন্ধ থাকবে এই অজুহাতে নাকি চালের দাম বাড়ানো হয়েছে।’ জনতা রাইস মিলের মালিক আবু ওসমান বলেন, ‘মিলাররা বলছে ধানের বাজার বাড়তি, তাই চালের দাম বাড়তি। রশিদের মিনিকেট আগে ২ হাজার ৪৫০ টাকা বিক্রি হলেও এখন ২ হাজার ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে এসিআইয়ের মিনিকেটের বস্তা ২ হাজার ৪৫০ টাকা বিক্রি হলেও এখন ২ হাজার ৫০০ টাকা। বস্তাতে চালের দাম ৮০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। কেজিতে এক থেকে দেড় টাকা।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসিআই রাইস মিলের এক কর্মকর্তা জানান, ‘কোম্পানিগুলো সরকারকে এখন চাল দিচ্ছে। ফলে বাজারে চালের সঙ্কট তৈরি হয়েছে। কাওরান বাজারে চাল কিনতে আসা ইস্কাটনের বাসিন্দা তাহমিনা পারভীন বলেন, ‘আগে ২৪০০ টাকায় মিনিকেটের বস্তা কিনতাম। আজ ২৫০০ টাকায় কিনতে হয়েছে। নির্বাচনের কারণে নাকি চালের দাম বেড়েছে। কষ্টের কথা বলে কী লাভ আছে। খাওয়া তো লাগবে।’
×